মৃত্যুকূপ থেকে বেরিয়েই মৃত্যুকূপে তাদের সমাধি
ইউরোর ছয় গ্রুপের ড্র চূড়ান্ত হওয়ার পর অন্য প্রতিযোগিতার মতোই সবার আগ্রহ ছিল ‘মৃত্যুকূপ’ নিয়ে। এবারও হয়নি তার ব্যতিক্রম। খুঁজতে খুঁজতে যখন মৃত্যুকূপের দেখা মিললো, তখন চোখ ছানাবড়া হওয়া স্বাভাবিক। একই গ্রুপে যে পড়েছে গত আসরের চ্যাম্পিয়ন পর্তুগাল, রানার্সআপ ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স এবং সর্বোচ্চ তিনবারের শিরোপা জয়ী জার্মানি। গ্রুপে লড়াইটা হলো সমানে সমান, মানে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। তিন দলই মৃত্যুকূপ থেকে বের হতে সফল। কিন্তু তারপর....। মৃত্যুকূপ থেকে বেরিয়ে বেশিদূর যেতে পারেনি তারা, একে একে পা হড়কে পড়েছে সেই মৃত্যুকূপেই।
মৃত্যুকূপে পর্তুগাল, ফ্রান্স ও জার্মানির সঙ্গে ছিল হাঙ্গেরি, যাদের জন্য এটি ছিল চতুর্থ ইউরো। মূলত লড়াইটা ছিল পর্তুগাল, ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে। কিন্তু হাঙ্গেরি ছেড়ে কথা বলেনি। তাদের বিপক্ষেই পর্তুগাল শুরু করে ম্যাচ। বুদাপেস্টের পুসকাস অ্যারেনায় ৩-০ গোলে জেতে গতবারের চ্যাম্পিয়নরা। স্কোর দেখে ম্যাচের অবস্থা বোঝা বড় দায়। কারণ ৮৩ মিনিট পর্যন্ত হাঙ্গেরি পর্তুগালকে ঠেকিয়ে রাখে। ৮৪ মিনিটে রাফা গেরেইরো খোলেন গোলমুখ, তারপর জোড়া গোল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর।
পর্তুগালের এমন শুরু আভাস দিয়েছিল বড় কিছুই করতে বসছে তারা। এদিকে ফ্রান্স মুহুর্মুহু আক্রমণে কাঁপিয়ে দেয় জার্মানিকে। মিউনিখে নিজেদের মাঠ অ্যালিয়েঞ্জ অ্যারেনায় প্রথম ম্যাচে নাকানিচুবানি খেতে বসেছিল তিনবারের চ্যাম্পিয়নরা। ছয় বছর পর ফেরা করিম বেনজেমা ও তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পে জালের দেখাও পান, কিন্তু অফসাইড বিপত্তি বাধায়। শেষ পর্যন্ত রক্ষণের কারণেই ডুবেছে জার্মানি। দুই বছর পর দলে ফেরা ম্যাটস হামেলস করেন আত্মঘাতী গোল। ১-০ গোলে জিতে ফ্রান্সও দারুণ কিছুর ইঙ্গিত দেয়।
সেই ফরাসিরাই দ্বিতীয় ম্যাচে ধরা খায় হাঙ্গেরির কাছে। প্রথমার্ধের যোগ করা সময়ে ফিওলার গোলে পিছিয়ে পড়ে গতবারের রানার্সআপরা। ম্যাচের এক ঘণ্টা যাওয়ার পর তাদের রক্ষাকর্তা হয়ে আসেন আন্তোয়ান গ্রিয়েজমান। তার ৬৬ মিনিটের গোলে এক পয়েন্ট উদ্ধার করে ফ্রান্স। হাঙ্গেরির বিপক্ষে উড়ন্ত শুরু করা পর্তুগাল ১৫ মিনিটের মাথায় রোনালদোর অবিশ্বাস্য গোলে এগিয়ে যায়। রক্ষণে একটি কর্নার ক্লিয়ার করেই দৌড় দেন তিনি। বের্নার্দো সিলভা দারুণ এক থ্রু বাড়ান ডিওগো জোতাকে। ততক্ষণে রোনালদো জার্মান ডি বক্সে। জোতার বল থেকে ট্যাপ ইন করে অসাধারণ গোল করেন।
কিন্তু জার্মানরা চুপ করে বসে থাকেনি। তাদের তেড়েফুঁড়ে আসা আক্রমণ সামাল দিতে গিয়ে পর্তুগিজরা চার মিনিটের ব্যবধানে দুটি আত্মঘাতী গোল দিয়ে বসে। ৩৫ মিনিটে রুবেন দিয়াস, আর গেরেইরো ৩৯ মিনিটে, ২-১ গোলে এগিয়ে যাওয়া জার্মানরা দ্বিতীয়ার্ধে আরও দুটি গোল করে হাভার্জ ও গোসেন্সের মাধ্যমে। জোতা পরে গোল শোধ দিলেও তা কেবল ব্যবধান কমায়। ৪-২ গোলে জিতে জার্মানি ঘোষণা দেয়, তারা দমে যাওয়ার পাত্র নয়।
গ্রুপের ধুন্ধুমার দ্বিতীয় রাউন্ড শেষে চার দলই নকআউটের আশা নিয়ে শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হয়। ফ্রান্স ও পর্তুগালের লড়াইয়ে ছিল যুদ্ধের আঁচ। যদিও ফরাসিরা এক ম্যাচ হাতে রেখেই নিশ্চিত করেছিল শেষ ষোলো। জমে উঠেছিল রিয়ালের সাবেক দুই সতীর্থ রোনালদো ও বেনজেমার লড়াই। ৩১ মিনিটের পেনাল্টি থেকে রোনালদো এগিয়ে দেন দলকে, প্রথমার্ধের যোগ করা সময়ে একইভাবে পেনাল্টিতে ফ্রান্সকে সমতায় ফেরান বেনজেমা। রিয়াল তারকা দ্বিতীয়ার্ধে ফিরেই এগিয়ে দেন ফরাসিদের। গত ফাইনালে হারের ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার স্বপ্ন দেখছিল তারা। কিন্তু বাঁচা-মরার লড়াইয়ে রোনালদো পেনাল্টি থেকে করেন সমতাসূচক গোল। তাতে ২-২ গোলের ড্রয়ে পর্তুগাল সেরা তৃতীয় দল হয়ে নকআউটে জায়গা করে নেয়। গত আসরে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে গ্রুপে মাত্র তিন পয়েন্ট সংগ্রহ করতে পেরেছিল তারা, এবার একটি বেশি পয়েন্ট আসে।
আরেক ম্যাচে দুইবার এগিয়ে গিয়ে জার্মানিকে বিদায়ের পথ দেখাতে শুরু করেছিল হাঙ্গেরি। ১১ মিনিটে সালাইয়ের গোলে লিড নেয় তারা। ৬৬ মিনিটে হাভার্জ শোধ দেন। দুই মিনিট পর স্কাফার গোল করে আবার পেছনে ফেলেন জার্মানদের। কিন্তু খেলা শেষ হওয়ার ৬ মিনিট আগে গোরেৎকার গোল জার্মানিকে বাঁচায়। পর্তুগালের সমান পয়েন্ট পেলেও গোলপার্থক্যে এগিয়ে থেকে গ্রুপ রানার্সআপ হয় জার্মানরা।
মৃত্যুকূপ থেকে বেরিয়ে তিন দল প্রস্তুতি নিতে থাকে শেষ ষোলোর মঞ্চে লড়াই করার জন্য। গ্রুপে দুর্দান্ত পারফর্ম করা পর্তুগাল যেন বেলজিয়ামের সঙ্গে নিজেদের হারিয়ে ফেলেছিল। আক্রমণভাগের অপারগতা ছিল দৃশ্যমান। থরগান হ্যাজার্ডের একমাত্র গোল গড়ে দেয় পার্থক্য। ১-০ গোলে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয় পর্তুগালের। গ্রুপে সর্বোচ্চ ৫ গোল করেও দলকে কোয়ার্টার ফাইনালে না নিতে পারার কষ্ট রোনালদোর চোখেমুখে ছিল স্পষ্ট।
ফ্রান্স নেমেছিল সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে, চার আসর খেলে যাদের সেরা সাফল্য ছিল শেষ ষোলো পর্যন্ত। এমবাপ্পে, বেনজেমা ও গ্রিয়েজমানের ক্ষুরধার আক্রমণভাগ সহজ জয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছিল মাঠে নামার আগে। এমনকি ১৫ মিনিটে সেফেরোভিচের গোলের পরও তারা ছিল অদম্য। বেনজেমার জোড়া ও পল পগবার গোলে ৩-১ এ লিড নেয় ফ্রান্স। ৮০ মিনিট পর্যন্ত দুই গোলে পিছিয়ে ছিল সুইশরা। কিন্তু আগের ম্যাচেই স্পেনের বিপক্ষে ক্রোয়েশিয়ার অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিল তারা। শেষ ১০ মিনিটে দুই গোল শোধ দিয়ে ফরাসিদের চমকে দেয় তারা। অতিরিক্ত সময়েও স্কোর ৩-৩ থাকলে পেনাল্টিতে গড়ায় ম্যাচ। টাইব্রেকারেও জমজমাট লড়াই, পাঁচ শটের সবগুলো থেকে জাল খুঁজে পায় সুইশরা। আর পঞ্চম শটে এমবাপ্পে মিস করেন, গত বিশ্বকাপে নায়ক বনে যাওয়া পিএসজি স্ট্রাইকার হয়ে যান খলনায়ক। টাইব্রেকারে ৫-৪ গোলে হেরে বিদায় নেয় ফ্রান্স।
পরের দিন ইংল্যান্ডের মাঠে নেমেছিল জার্মানি। দুই দলের লড়াইয়ে ছিল তীব্র উত্তেজনার আঁচ। কিন্তু ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ৪০ হাজার দর্শক ছিল ইংল্যান্ডের পেছনে। ১৯৯৬ সালের ইউরো সেমিফাইনাল ও ২০১০ সালের বিশ্বকাপের শেষ ষোলোতে এই জার্মানদের কাছে হারের ক্ষত এতদিনেও শুকায়নি। শেষ পর্যন্ত সেই ক্ষতে তারা প্রলেপ দিলো। রহিম স্টার্লিং ও হ্যারি কেইনের অসাধারণ গোল শেষ করলো জার্মানির অভিযাত্রা। হামেলসের সঙ্গেই দুই বছর পর জাতীয় দলে ফেরা মুলারও আস্থার প্রতিদান দিতে পারেননি। প্রথম গোল খাওয়ার পরই একা গোলরক্ষককে পেয়েও গোলপোস্টের বাইরে দিয়ে মারেন। চার আসরের মধ্যে প্রথমবার সেমিফাইনাল না খেলেই বিদায় নেয় জার্মানি।
মৃত্যুকূপ থেকে বেরিয়েই ফের মৃত্যুকূপেই সমাধি হলো পর্তুগাল, ফ্রান্স ও জার্মানির।
ঢাকা/ফাহিম
আরো পড়ুন