ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

জোগো বোনিতোর ব্রাজিল ফুটবলে আমার অনন্ত প্রেম

সালেক সুফী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:১০, ১০ জুলাই ২০২১   আপডেট: ২০:২০, ১১ জুলাই ২০২১
জোগো বোনিতোর ব্রাজিল ফুটবলে আমার অনন্ত প্রেম

১৯৫৮, ১৯৬২ সালের দিকে খেলাধুলা বা ফুটবল সবে বুঝতে শিখেছি। বাবা আবুল খালেক কলকাতা ফুটবল লিগের স্বর্ণযুগের খেলোয়াড় ছিলেন। তাই আমাদের পরিবারে খেলাধূলা দেখা, শোনা এবং খেলার চর্চা ছিল। বাবার ঘরে একজন সুঠামদেহী কালো মানুষের ছবি দেখেছিলাম, মনে পড়ে ১৯৬০ সালের দিকের কথা হয়তো। পত্রিকার পাতার কাটা ছবি। বাবা বলেছিলেন দক্ষিণ আমেরিকার এই কালো মানুষটি পেলে, ফুটবল খেলেই বিশ্ব মানচিত্রে ওর দেশ ব্রাজিলকে উজ্জ্বল করেছিল। 

আমার ডাকটিকিট জমানোর শখ ছিল। শুনলাম পেলে নামের খুদে ছেলেটি নাকি ১৭ বছর বয়সে ধুমকেতুর মতো আবির্ভুত হয়ে জাদুকরী পরশে ব্রাজিলকে বিশ্বজয়ী করেছিল ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালে। ব্যাস আমিও পেলে এবং ব্রাজিলের অনুরাগী হয়ে গেলাম। কিশোর বয়সের সেই প্রেম আজও ৭০ ছোঁয়া জীবনে অক্ষুন্ন আছে। 

শুধু পেলে কেন এই দলের গারিঞ্চা, ভাবা, দিদি, তোস্তাও, কার্লোস আলবার্তো, রিভেলিনো, জিজিনহো কত না অনুপম ফুটবল শিল্পী ছিল। ছোট পাসের ছন্দময়, নান্দনিক ফুটবল ছিল শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবি। আনন্দে সাম্বা ছন্দে দুলতো বিশ্ব জোড়া হলদে নীলের রঙে আঁকা পাখি। ১৯৫৮, ১৯৬২ বিশ্বজয়ী ব্রাজিল কিন্তু ১৯৬৬ সালে ছিটকে পড়েছিলেন পেলে আহত হয়ে । ইংল্যান্ড নিজের মাটিতে জার্মানিকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতেছিল। পরে যখন ডকুমেন্টরিতে সেই ঘটনার চিত্র দেখেছিলাম অনেক কেঁদেছিলাম মনে আছে। ১৯৭০ এর সেই ব্রাজিল আবারও অপরাজেয় ফুটবল দল নিয়ে বিশ্ব জয় করল।

সর্বকালের সর্বযুগের সেরা ফুটবল দলটির ইতিহাস যাদের জানা নেই, তারা ব্রাজিলকে হয়তো আজকালের কিছু কিছু দলের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। কিন্তু আমার প্রেমের ব্রাজিল সেই দল, যারা একমাত্র দল, যারা ফুটবল বিশ্বকাপের প্রতি আসরে অংশগ্রহণ করেছে। চার মহাদেশ (উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়া) থেকে পাঁচবার বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছে। বিশ্বকাপ, কনফেডারেশন কাপ ও অলিম্পিক শিরোপা জিতেছে। কখনও আর্জেন্টিনা, কখনও উরুগুয়ে, অধিকাংশ সময় ইতালি, জার্মানি ওদের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে আবির্ভুত হয়েছে। ইউরোপে ফুটবলের ব্যাপক জনপ্রিয়তার পর এখন পর্তুগাল, স্পেন, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ব্রাজিলকেই বিশ্ব আসরে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে।  

আমরা বা আমাদের আগের প্রজন্ম যারা ফুটবল অনুরাগী তাদের স্মরণে আছে অনেক তারকার নাম। পর্তুগালের ইউসেবিও, হাঙ্গেরির পুসকাস, ইংল্যান্ডের গর্ডন ব্যাংকস, রাশিয়ার লেভ ইয়াসিন, ইংল্যান্ডের জর্জ বেস্ট, রোনালদিনহো, জিকো, সক্রেটিস নান্দনিক ফুটবল দিয়ে মাঠ মাতিয়েছেন। পরবর্তীতে ডিয়েগো ম্যারাডোনা, ইয়োহান ক্রুইফ, বেকেনবাওয়ার, দিনো জফ ও আজকালের ফুটবল নায়ক লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো আপন মহিমায় ফুটবলকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন।

এই যে নান্দনিক ফুটবলের অনুপম দল বাজিল। ওদের ফুটবল কিন্তু গল্প, কবিতা বা রূপকথার চিত্রায়ন। পায়ে পায়ে সৃষ্ট জীবন্ত ইতিহাস। আসল ও আদি ব্রাজিল ফুটবলের নান্দনিক রূপ এখনও যদিও ইউরোপের ধাঁচের পাওয়ার ফুটবলের মিশ্রণে অনেকটাই অনুপস্থিত, তবুও তার প্রতিফলন চমক দেয় মাঝে মাঝে পর্তুগাল বা স্পেনের খেলায়। দুটো দেশের কিন্তু ব্রাজিল সংযোগ আছে।  

ব্রাজিল নিয়ে যখন বলছি, তখন দক্ষিণ আমেরিকার আরেক সেরা ফুটবল দল আর্জেন্টিনাকে নিয়ে বলতেই হবে। এই দলেই খেলে বিশ্ব মাতিয়েছেন সর্বযুগের অন্যতম সেরা ম্যারাডোনা। যিনি একাই একটি দল হয়ে বিশ্ব জয় করে আর্জেন্টিনাকে হিমালয় চূড়ায় তুলেছিলেন, যেই দল এবং বিশ্ব ফুটবলের অমূল্য সম্পদ এখন বাঁ পায়ের জাদুকর লিওনেল মেসি। ম্যারাডোনাকে দেখে যারা আর্জেন্টিনাকে ভালোবেসেছেন বা মেসিকে দেখে যারা আর্জেন্টিনাকে ব্রাজিলের সঙ্গে তুলনা করেন তাদের অবশ্য ফুটবলের ইতিহাসটা একটু পরে দেখা সমীচীন।

এবার যে দলটি কোপার ফাইনাল খেলবে, অধুনা অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভুত মেসির আর্জেন্টিনার বিপক্ষে তাদের খেলায় কিন্তু কিছুটা হলেও স্বর্ণযুগের ধ্রুপদী ফুটবল ছন্দ আছে। অন্তত সেমিফাইনালে পেরুর বিপক্ষে কিছু সময়ের জন্য ফুটবল বিশ্ব তা দেখেছে।

কী সেই ছন্দ? ছোট ছোট পাস, ছন্দময় গতি, সাগরতরঙ্গের মতো আক্রমণ, শিল্পীর ছোঁয়ায় গড়া আক্রমণের মাদকতায় প্রতিপক্ষকে বিমোহিত করে জয় করে নেওয়া। আজকের ব্রাজিল, আজকের যান্ত্রিক ফুটবলের যুগে সেই সময়ের ফুটবল অনুপস্থিত। আজকের যুগে হয়তো আর ব্রাজিল ফুটবলের অকৃত্রিম রূপ ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। যুগের বিবর্তনে রূপ পাল্টে গেছে। আমাদের সময়ের ফুটবল প্রজন্ম সর্বকালের সেরা ব্রাজিল দলের খেলা দেখেছি বলে আধুনিক ফুটবলের সঙ্গে তুলনা করতে পারি।

বর্তমান প্রজন্ম যারা ফুটবল ভালোবাসেন, তারা অনুগ্রহ করে নিজ নিজ দলকে ভালোবাসার পাশাপাশি সুন্দর ফুটবল ভালোবাসেন। কোপা ও ইউরো ফাইনাল খেলা দুটি মনেপ্রাণে উপভোগ করুন।

 

সালেক সুফী: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, ক্রীড়া অনুরাগী 

 

মেলবোর্ন/ সালেক/ ফাহিম/ এমএম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়