ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

গৃহযুদ্ধে মা হারানো সেই ছেলেটি এখন লাখো শরণার্থীর অনুপ্রেরণা

ক্রীড়া ডেস্ক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৪০, ২৭ জুলাই ২০২১   আপডেট: ১৭:৪৮, ২৭ জুলাই ২০২১
গৃহযুদ্ধে মা হারানো সেই ছেলেটি এখন লাখো শরণার্থীর অনুপ্রেরণা

পোপোলে মিসেঙ্গা

২০০১ সালে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে মারা যান পোপোলে মিসেঙ্গার মা। ওই সময় তার বয়স ছিল ৯ বছর। এক সপ্তাহ ধরে একা একা হেঁটে বেড়ান নিরুদ্দেশ, তারপর উদ্ধার করে তাকে নেওয়া হয় কিনশাসায়, সেখানেই জুডোর সঙ্গে প্রথম পরিচয়।

সেই মিসেঙ্গা দ্বিতীয়বার শরণার্থী অলিম্পিক দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন। গতবার ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে অভিষেক হয়েছিল তার, ২০১৩ সাল থেকে সেখানেই বসবাস করছেন। ৮ বছর আগে ব্রাজিলে বিশ্ব জুডো চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে গিয়েই জীবন বদলে যায় মিসেঙ্গার। কঙ্গোর টিম ক্যাম্প ছেড়ে পালান একেবারে খালি হাতে। কোনো টাকা-পয়সা, পাসপোর্ট কিংবা খাবার ছিল না সঙ্গে। কেন পালিয়েছিলেন? পদক জিততে না পারার কারণে কোচদের বাজে আচরণের শিকার তিনি, গালিগালাজও শুনতে হয়েছে।

গৃহযুদ্ধে বেঁচে যাওয়ার পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে ব্রাজিলে কঠিন জীবন পার করেছেন মিসেঙ্গা। তবে স্বপ্নের কথা কখনো ভোলেননি। তার একটাই চাওয়া, বিশ্বকে দেখাতে চান যে কোনো কিছু সম্ভব।

এই জুডোকার সংগ্রামী জীবনই তুলে ধরেছে আল জাজিরা। কাতারভিত্তিক এই গণমাধ্যমকে তিনি জানান, কীভাবে জুডো তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী করে তুলেছে। এখন তার স্বপ্ন পূরণ করার পালা।

২০১৩ সালের পর থেকে আপনি কঙ্গোতে ফিরেননি। দেশের কোন জিনিসটা আপনি সবচেয়ে বেশি অনুভব করেন?

মিসেঙ্গা: আমার শুধু ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। ফোনে আমাদের স্বাভাবিক কথা হয়। কিন্তু ২০১৩ সাল থেকে আমাদের দেখা হয়নি।

২০১৩ সালে টিম ক্যাম্প থেকে পালিয়েছিলেন। ওই সিদ্ধান্ত কতটা কঠিন ছিল। এখন ফিরে দেখলে কি মনে করেন যে ওটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল?

মিসেঙ্গা: আমি ব্রাজিলে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম না, এটা হয়ে গেছে। ওই মুহূর্তে জাতীয় দলের কোচদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। তারা আমাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করত না, আমাদের খেয়াল রাখত না। সবকিছু ছিল বাজে এবং তারা কখনও থামত না। আমরা ক্ষুধার্ত ছিলাম, টাকা ছিল না। আমাদের কোনও টাকা দিত না। একবার তিন দিন না খেয়েছিলাম। আর পারছিলাম না। ঘুমানোর জায়গা ছিল না। ঘর-পরিবার তো দূরের কথা। তাই মনে হচ্ছিল, যখন হারানোর কিছুই নেই তখন ব্রাজিলে থেকে নতুন জীবন শুরু করতে পারি। সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল। এখন আমার স্ত্রী-সন্তান আছে, যাদের ভালোবাসি। বাবা হতে পারব, কখনও ভাবিনি।

রিও ফাভেলায় থাকার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

মিসেঙ্গা: সহজ ছিল না। যুদ্ধের মধ্যে দেশ ছেড়েছিলাম এবং এখানে এসে আরেকটা যুদ্ধের মধ্যে পড়েছিলাম। প্রায় সময় এই যুদ্ধ হতো, দ্বিধায় পড়তাম। বন্দুকের গোলাগুলি সব জায়গায়। নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলত। গুলি থেকে বাঁচতে লোকজন আমার বাসায় আশ্রয় নিত। তারপরও আমি থেকে গেছি।

এখন আমি ব্রাজিল ছাড়ার সুযোগ চাই এবং আমার সন্তানদের বিদেশে পড়াশোনা করাতে চাই। তাদের জন্য একটা সুন্দর জীবন আর ভালো ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে চাই।

ব্রাজিলে কখন ট্রেনিং শুরু করলেন?

মিসেঙ্গা: রেয়াকাও ইনস্টিটিউটে ট্রেনিং শুরু করি, সাবেক অ্যাথলেট ফ্লাভিও কান্তোর গড়া একটা এনজিও ওটা। ওই সেন্টারে সহপ্রতিষ্ঠাতা ও অভিজ্ঞ অলিম্পিক কোচ জেরাল্ডো বার্নার্দেসের কাছ থেকে সহায়তা পেয়েছি, তিনি ব্রাজিলিয়ান জাতীয় জুডো দলেরও কোচ ছিলেন। আর তখন থেকেই অলিম্পিকে খেলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি।

২০১৬ সালে আপনার প্রথম অলিম্পিক ছিল, আপনার জীবন কীভাবে পাল্টে গেল?

মিসেঙ্গা: সবকিছু বদলে গেল। ভাগ্য ভালো যে ফাভেলা থেকে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি ও আন্তর্জাতিক জুডো ফেডারেশনের আর্থিক সমর্থন ছিল। এখন আমি নিরাপদ জায়গায় থাকি যেখানে সবসময় বন্দুকের গুলির আওয়াজ শুনতে হয় না।

শরণার্থী অলিম্পিক দলের অংশ হতে পারার অভিজ্ঞতা বলুন

মিসেঙ্গা: আমরা, শরণার্থীরা, স্বপ্ন দেখি ঠিক অন্যদের মতোই। আমরা স্বপ্ন দেখি কিছু হতে, অন্যদের মতো কিছু করতে এবং আমরা হাল ছাড়ি না। আমি অনেক শরণার্থীদের জন্য দৃষ্টান্ত যারা এখন স্কুলে যেতে পারে। আমি আমার স্বপ্ন নিয়ে কাজ করতে পেরেছি এবং আমি লাখ লাখ শরণার্থীদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে আরও বেশি স্বপ্ন দেখুন এবং তা বাস্তব করুন।

টোকিও গেমসে আপনার প্রত্যাশা কী? প্রস্তুতি কেমন আর চ্যালেঞ্জ কতটা ছিল?

মিসেঙ্গা: সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল করোনাভাইরাস মহামারি। আমি নিজের অনেক যত্ন নিয়েছি, সবসময় হাত পরিষ্কার রেখেছি, অ্যালকোহল জেল দিয়ে পরিষ্কার করেছি, মাস্ক পরেছি। লকডাউনের কারণে যখন অন্যদের সঙ্গে অনুশীলন করতে পারিনি, তখন ঘরে একা অনুশীলন করেছি। এটা শুধু আমার জন্য নয়, বিশ্বের সবার ক্ষেত্রে হয়েছে।

এখন আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ও পদক পাওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। আমার মন এখন একটা জায়গায়: আমাদের দলের জন্য একটি পদক জেতা।

আপনার গল্প বিশ্বের অগণিত মানুষের অনুপ্রেরণা। তাতে আপনার অনুভূতি কী এবং বিশ্বের লাখ লাখ শরণার্থীর জন্য আপনার বার্তা কী?

মিসেঙ্গা: আমার বার্তা সহজ। কখনও আপনার স্বপ্নকে মরতে দিবেন না। তা অর্জনের চেষ্টা করে যাবেন। আমার দলের জন্য পদক জেতার অনেক স্বপ্ন দেখি আমি। বিশ্বের লাখ লাখ শরণার্থীকে বলার মতো অনেক সুন্দর গল্প আছে। সেসব বলার খুব কাছে আমি।

ঢাকা/ফাহিম

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়