‘আমি কারো বিপক্ষে খেলি না, সবার সঙ্গে খেলি’
ক্রীড়া প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম
ক্রিকেট নিয়ে তার ভাবনা ছিল এমনই, ‘আমি কারো বিপক্ষে খেলি না, সবার সঙ্গে খেলি।’ জীবনের সঙ্গে ব্যাট-বলের খেলাটিকে এমনভাবে মিশিয়ে নিয়েছিলেন যিনি, ক্রিকেট হয়ে উঠে তার জীবনের নিউক্লিয়াস। জাতীয় দৈনিক কালের কন্ঠে এক সাক্ষাৎকারে তিনি ক্রিকেট ও তার জীবনের রসায়ন ফুটিয়ে তুলেছিলেন এভাবে, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক ক্রিকেট। আমি যতটুকু হয়েছি, যা হয়েছি, মানুষ হিসেবে সমাজে যেটুকু মুখ ভাসাতে পেরেছি-সবটুকুর জন্যই ক্রিকেটের কাছে কৃতজ্ঞ। ক্রিকেটের কাছে আমার সবচেয়ে বড় ঋণ।’
আরও পড়ুন: চলে গেলেন ক্রিকেট গুরু
গত ১০ সেপ্টেম্বর আম্পায়ার নাদির শাহর মৃত্যুর খবর শুনে তিনি ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন, ‘সে ছিল আমাদের ক্রিকেট সমাজের আনন্দপাখী।’ অথচ একদিন আগে তিনি নিজে ছাড়া পেয়েছিলেন হাসপাতাল থেকে। ১ সেপ্টেম্বর শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। আটদিনের চিকিৎসা থেকে বোনের বাড়ি ফিরে ফেসবুকে লিখলেন, ‘বিপন্ন ফুসফুস নিয়ে আরো কিছুদিন ঠেলাধাক্কার জীবনযাপনের অনুশীলন করতে হবে। এ পর্যন্ত যাপিত জীবনের সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে প্রাত্যহিকতা পালন করতে হবে এখন থেকে। সুস্থ থাকার জন্য প্রিয় অভ্যাস ভুলে থাকার সাধনায় হতেই হচ্ছে হিমকাতর। এ কাতরতা অজেয় নয়। সবাই শুভকামনা রাখবেন।’
সেই ঠেলাধাক্কার জীবন, সুস্থ থাকার তীব্র ইচ্ছা ও অজেয়কে জয় করা হলো না পরম শ্রদ্ধেয় জালাল আহমেদ চৌধুরীর। স্বনামধন্য ক্রিকেট কোচ ও ক্রিকেট লেখক আজ সকালে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। হাসপাতালে দ্বিতীয়বার ভর্তি হয়ে আর নীল আকাশ দেখা হলো না তার। এবার তাকে রাখা হয় ভেন্টিলেশনে, ছিলেন আইসিইউতে। ফুসফুসের সংক্রমণ ও শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগে শেষ পর্যন্ত জীবনের লড়াইয়ে হেরে যান তিনি। দেশের অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার তার হাতে গড়া।
১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি বিজয়ী দলটি তৈরি করেছিলেন তিনি। তার অধীনেই শুরু হয়েছিল প্রস্তুতি। পরবর্তীতে দায়িত্ব পান গর্ডন গ্রিনিজ। কিন্তু তার জীবনের চিরকালীন আক্ষেপ ছিল, ১৯৯৭ সালে চ্যাম্পিয়ন হওয়া দলটির সংবর্ধনায় তার নামটা একবারও উচ্চারিত করেনি দেশের ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিসিবি।
এক জীবনে আড্ডা দিয়ে কেটেছে জালাল আহমেদের জীবন। আজিমপুর, ধানমন্ডি, পল্টন, ইসলামিয়া হোটেল ছিল তার দিন-রাত কাটানোর জায়গা। ক্রীড়াঙ্গান ও সাহিত্যঙ্গনের বড় বড় তারকার সঙ্গে ওই আড্ডাগুলো তার জীবনের সেরা সময় বলে দাবি করতেন। ১৯৬৫-৬৬ সালে উদিতি ক্লাব দিয়ে খেলা শুরু করেন তিনি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর ইয়াং পেগাসাসের হয়ে প্রথম বিভাগে খেলা শুরু। এরপর আবার উদিতিতে ফেরেন। ১৯৭৮ সালে ধানমন্ডিতে শেষ ক্রিকেট খেলেন তিনি।
এর আগে অবশ্য টাউন ক্লাবকেও প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৭৯ সালে ১০ মাসের ক্রিকেট কোচিং ডিপ্লোমা কোর্স করার জন্য গিয়েছিলেন পাতিয়ালাতে। ১৬-১৭ জনের মধ্যে সেই কোর্সে তিনি প্রথম হয়েছিলেন। পাতিয়ালা থেকে ফেরার পর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে চাকরি নেন তিনি। এরপর বিভিন্ন সময় জাতীয় দলকে কোচিং করিয়েছেন। সঙ্গে আজাদ স্পোর্টিং, মোহামেডান, আবাহনী, ভিক্টোরিয়া, পিডাব্লিউডিসহ অনেক ক্লাবে কোচিং করিয়েছেন।
সবশেষ ২০১৮ সালে কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের কোচ ছিলেন জালাল আহমেদ। ক্রিকেটটাকে এতটাই ভালোবাসতেন যে জাতীয় দলের খেলোয়াড়ের নামে নিজের ছেলের নাম রেখেছিলেন। সেটাও মজার এক ঘটনা। ১৯৮২ সালে ভারতের ডেকান ব্লুজ ময়মনসিংহে খেলতে এসেছিল। ম্যাচ শুরুর আগে খেলোয়াড়দের ডেকে নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আজ বাংলাদেশের হয়ে যে বেশি রান করবে তার নামে ছেলের নাম রাখবো। নাজিম সিরাজি সেই ম্যাচে সর্বোচ্চ রান করে, সম্ভবত ৪৮। ছেলের নাম রাখি নাজিম জালাল চৌধুরী।’
পড়াশোনা শেষ করেছেন ঢাকা কলেজ থেকে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বিসিএসে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় টিকেও তিনি যাননি ক্রিকেটের টানে। সাহিত্য চর্চা ছিল তার নেশা। গদ্য লেখক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তার সবচেয়ে পছন্দের। এছাড়া প্রমথ চৌধুরী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক ও সুনীলের ভক্ত ছিলেন তিনি। এছাড়া পদ্য লেখক হিসেবে ভারতচন্দ্র, জ্ঞানদাস, জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ, শক্তি-সুনীল, নির্মলেন্দু গুণ-আবুল হাসান তার খুব প্রিয় ছিল।
১৯৮২ সালে ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ হয়। যোগ দেন নিউ নেশনে। এরপর টাইমসে যোগ দেন। পরবর্তীতে সেখানকার ক্রীড়া সম্পাদক হয়েছিলেন। ইংরেজি ও বাংলা ভাষার অসামান্য দক্ষতা তার। শব্দ নিয়ে খেলাধুলা করতেন। প্রায় সব কটি জাতীয় দৈনিকে বিভিন্ন সময় তার লেখা সমৃদ্ধ করেছে দেশের ক্রিকেট সাংবাদিকতাকে।
দেশের পেশাদার ক্রীড়া সাংবাদিকদের সংগঠন বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। আজিমপুরে একটি ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন তিনি। তার সন্তানরা রয়েছে দেশের বাইরে। ছেলের সঙ্গে আমেরিকাতে গ্রিন কার্ড নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু ১০-১১ মাস থেকে আবার দেশে ফিরে আসেন তিনি।
জালাল আহমেদের জন্ম ১৯৪৭ সালে। ২০২১-এ অলস সকালে নিভে গেল জীবনের প্রদীপ। মাঝের সময়টা জালাল আহমেদ নিজের জীবন রাঙিয়েছেন নিজের মতো করে, রংধনুর সাত রং ছড়িয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট ক্যানভাস রঙিন করেছেন।
প্রায়ই বলতেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট আজ যে পর্যায়ে এসেছে তাতে তার আনন্দ সীমাহীন। সেই সীমাহীন আনন্দ নিয়েই হয়তো অনন্তের পথে যাত্রা শুরু করলেন। আজিমপুরের কীর্তি সন্তানের শেষ ঠিকানা হতে যাচ্ছে সেখানেই।
ঢাকা/ইয়াসিন/ফাহিম
আরো পড়ুন