ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা’

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৮, ৬ নভেম্বর ২০২১   আপডেট: ১১:১৬, ৬ নভেম্বর ২০২১
‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা’

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। বাংলাদেশের ক্রিকেটে অনেক আক্ষেপের এক নাম। অথচ ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে বাংলাদেশের উড়ার কথা ছিল। স্বপ্নের ডানা মেলে দৃষ্টিসীমানার বাইরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২৪০ বলের ক্রিকেটটা বাংলাদেশের কাছে এখনো অজানা, দুর্বোধ্য, রহস্যময়, জটিল!

তাই তো বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা খেলোয়াড় (১১০) বলে দেন, ‘এই ফরম্যাটে আমরা এখনো পায়ের নিচে মাটি খুঁজছি।’ তিনি অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ।

কেন বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টিতে এখনো পরাশক্তি হয়ে উঠতে পারেনি, কেন এ ফরম্যাটে বাংলাদেশের হিসাব মেলে না? উত্তর খুঁজেছে রাইজিংবিডি,

পরিকল্পনাতেই গলদ!

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট মানেই চার-ছক্কার ধুন্ধুমার লড়াই। অথচ এ ফরম্যাটে বাংলাদেশ এগিয়ে যায় গড়পড়তা স্কোর নিয়ে। ব্যাটসম্যানরা স্বাচ্ছন্দ্যে শট খেলতে পারেন না। বল কখন উঠবে, কখন নামবে সেই চিন্তাতেই শেষ! বল সহজে ব্যাটে আসবে, গতি থাকবে, বাউন্স হবে এমন উইকেট টি-টোয়েন্টির আদর্শ। কিন্তু বাংলাদেশের ২২ গজের ভাষাই ভিন্ন। ক্রিকেটের এ ফরম্যাটের জন্ম দর্শকদের বিনোদন এবং স্বল্প সময়ে আকৃষ্ট করতে। সঙ্গে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য তো রয়েছেই। কিন্তু বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অব ক্রিকেট এখানে সম্পূর্ণ উল্টো। রানের ফোয়ারা নেই। উইকেট রান প্রসবা না হওয়ায় বড় স্কোর দেখা যায় না। তাতে ব্যাটসম্যানদের মনোবলও শক্ত হয় না। ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর ইংল্যান্ড দল পরিকল্পনা নেয়, সারা বছর স্কোরিং উইকেটে খেলবে। প্রতিপক্ষ দল যত রানই করুক না কেন তারা সেটা তাড়া করবে। ফল পেয়ে যায় চার বছরেই। ২০১৯ ওয়ানডেতে তারা চ্যাম্পিয়ন। সেই ব্র্যান্ড অব ক্রিকেট কিন্তু এখনো চলমান। ভারতের ব্যাটসম্যানরা সারা বছর রান করেন। দেশের মাটিতেও করেন, বিদেশেও করেন। আপস অ্যান্ড ডাউন তো থাকেই। কিন্তু রান করা যে অভ্যাস সেটা কখনো তারা ভোলেন না। সেভাবেই তাদের গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়। তাতে সফলও হন তারা। 

বাক্সবন্দি ব্যাটসম্যানরা

ধরে খেলতে হবে। এমন মানসিকতায় টি-টোয়েন্টি চলে না। অথচ এই মানসিকতায় ২২ গজে মাঠে নামছে বাংলাদেশ। ফলে সার্কেল সুবিধা ব্যবহারে আটকে যাচ্ছেন ব্যাটসম্যানরা। ধরে খেলার নেতিবাচক মনোভাবের কারণে রান তোলার থেকে উইকেট আকঁড়ে রাখার কাজটা বেশি হচ্ছে। পরিকল্পনা থাকে শেষ দিকে ঝড় তোলার। কিন্তু বাংলাদেশ দলে দেড়শ বা দুইশ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করার সামর্থ্য কজনের আছে? স্লগার কোনো ব্যাটসম্যানও নেই। মাহমুদউল্লাহ এক সংবাদ সম্মেলনে যেমন বলেছিলেন, ‘উইকেটে গেলে আমাদের প্রত্যেকের থিতু হতে সময় লাগে। আমাদের স্লগার কোনো ব্যাটসম্যান নেই। রান করার অভ্যাস না থাকায় বাড়তি কিছুর তাড়নাও নেই। নতুন শট, আগ্রাসন কিংবা ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা খুব একটা চোখে পড়ে না। সেসব কারণে রানও আসে না। নিজেদের বাক্সবন্দি এবং একই অবস্থানে রাখায় উন্নতিগুলো খুব একটা চোখে পড়ে না। শুরুতে যেই আলোচনা হলো, ধরে খেলা। সেই ধরে খেলার কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ে ডট বল। তাতে চাপ বাড়ে পরবর্তী ব্যাটসম্যানদের ওপর। শেষমেশ ওই হিসাব আর মেলে না। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সুপার টুয়েলভের পাঁচ ম্যাচে বাংলাদেশ ডট বল খেলেছে ২৪৪টি। গড়ে প্রায় ৪৯ বলই ডট! ভাবা যায়?   

আগ্রাসী নন বোলাররা

এবারের বিশ্বকাপে কোনো বোলার যদি হতাশ করে থাকেন তা নিঃসন্দেহে মোস্তাফিজুর রহমান। আইপিএলে ভালো সময় কাটিয়ে আসলেও জাতীয় দলের জার্সিতে বাঁহাতি পেসার নিষ্প্রভ। অনেকেই মনে করেন এ পেসারের বিশ্রামের দরকার ছিল। তাকে বেশ ক্লান্ত লাগছিল। পারফরম্যান্স অবশ্য বলে সেটা ভুল না। কিন্তু এবার মোস্তাফিজকে বাদ দিয়ে একটা বার্তা দিয়েছে টিম ম্যানেজমেন্ট, কেউই অটোমেটিক চয়েজ নয়। বলা হয় বোলিংয়ে যত বেশি আগ্রাসী হবেন তত বেশি সাফল্য পাওয়ার হার বেড়ে যাবে। কিন্তু তাসকিন আহমেদ বাদে বাকিদের সেই আগ্রাসন দেখতেই পাওয়া যায়নি। তাতে একপ্রান্তে চাপ বাড়লেও অন্য প্রান্তে রানের ফোয়ারা। এ ফরম্যাটে রান আটকানোর বড় উপায় উইকেট নেওয়া। এজন্য আগ্রাসন, লাইন ও লেন্থ ধরে এক লাগাতারে বোলিং করা অতি জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশের বোলারদের কাজটা করতে দেখা গেছে সামান্যই। ফলে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিং দিয়েও সাফল্য পাওয়া যায়নি। দেশের মাটিতে ধীর গতির ও অসমান বাউন্সের উইকেটে সাফল্য পাওয়ায় মেকি আত্মবিশ্বাস বাড়ে যা বড় মঞ্চে বড় বাধা হয়ে দাড়ায়।    

দূরদর্শীতার অভাব

‘ঘরের মাঠে যে দুইটি সিরিজ খেলেছি আমাদের এখনকার সমস্যার সূত্রপাত ওখান থেকেই শুরু হয়েছিল। আমরা যেটাকে বলছি, আত্মবিশ্বাস! সেটা আমাদের জন্য উল্টো শাপে বর হয়েছে। যা এখন ভোগাচ্ছে। যে আত্মবিশ্বাস, যে দলীয় জয়ের কথা আমরা বলছি সত্যিকার অর্থে কোনো কাজে আসছে না। এটা অনেকটা না পড়াশোনা করে পাস করার মতো।  আজ বাংলাদেশ কেন পারছে না সেটার মূল আসলে সেই দুই সিরিজ। সেই মেকি আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হলাম। ওয়ার্মআপ থেকে শুরু হয়েছিল। ওয়ার্মআপ থেকে ওই মেকি আত্মবিশ্বাস উন্মুক্ত হওয়া শুরু হলো এবং সেখান থেকেই নেতিবাচক ফল, বাজে পারফরম্যান্স আসার সূত্রপাত। ’- বলেছেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম। খেলোয়াড়দের কিন্তু স্কিল বদলে যায় না। যেটা হয় আত্মবিশ্বাস এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়। বিশ্বকাপের আগে সেই দূরদর্শীতা দেখাতে পারেনি বিসিবি। ফলে মেকি আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিশ্বমঞ্চে গিয়ে ভরাডুবি হয়েছে বাংলাদেশের।

দুর্বল মানসিকতা

এবারের বিশ্বকাপে ক্রিকেটারদের শারীরিক ভাষা ছিল হতশ্রী। হারের আগেই হার মেনে নেওয়া, দুর্বল মানসিকতা, কঠিন পরিস্থিতিতে লড়াইয়ের সদিচ্ছার ঘাটতি, ন্যূনতম তাড়না না থাকায় মাঠের পারফরম্যান্সে বেহাল দশা। নিবেদনে ঘাটতি থাকায় তীব্র লড়াই করতে পারেনি। সেসবের সংমিশ্রণে ফিল্ডিং ছিল একেবারেই তলানিতে। যদি নেগিটিভ মার্কিং করা যেত বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা তেমন কিছুই পেতেন। সব মিলিয়ে ৯ ক্যাচ ও ১ স্ট্যাম্পিং মিস বাংলাদেশের! দুর্বল মানসিকতার না হলে এমনটা হয়?

 

জাতীয় দলের পাশাপাশি স্থানীয় কোচরা কি দায় এড়াতে পারেন?

বিদেশি কোচদের তত্ত্বাবধানে সারাবছর কাটান ক্রিকেটাররা। তাদের ভুল শুধরে দেওয়ার আসল কাজটা তাদের। তাদের ব্যাটিং, বোলিং উন্নতি করার জন্য আলাদা আলাদা কোচও নিয়োগ দেওয়া হয়। দলের ব্যর্থতায় তারা কি কোনোভাবে দায় এড়াতে পারেন?

খেলা চলাকালীন এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ক্রিকেটারদের সবচেয়ে পছন্দের কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বলেছিলেন, ‘আমি বাংলাদেশের ক্রিকেটের খেলা দেখা বাদ দিয়ে দিয়েছি। কেন? গত ৪-৫ বছর আগে ওরা যে মানের ক্রিকেট খেলত এখন ঠিক সেখানেই আছে। কোনো উন্নতি হয়নি। সৌম্য-লিটনরা একই খেলা খেলছে। তাহলে একই পারফরম্যান্স দেখতে আমি কেন টিভির সামনে বসব?’

সালাউদ্দিন স্পষ্টভাবে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করলেও কথার পিঠে তো কথা থাকে! যেমন, এই ৪-৫ বছরে তো সৌম্য, লিটন, মেহেদীদের নিয়ে তিনি বিপিএল বা ঢাকা লিগে কাজ করেছেন। নিশ্চয়ই দিনের পর দিন, সেশনের পর সেশন ব্যাটিং, বোলিং বা ফিল্ডিং নিয়ে কাজ করেছেন। অবসরে সময় কাটিয়েছেন। প্র্যাকটিকাল ক্লাসের সঙ্গে হোম ওয়ার্কও করেছেন। তাহলে কেন তাদের উন্নতি হয়নি? স্থানীয় কোচ সালাউদ্দিন কি সেই ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারেন? ঠিক একই কাজ তো খালেদ মাহমুদ সুজন, মিজানুর রহমান বাবুলসহ আরো স্থানীয় কোচরা করেছেন। ক্রিকেটারদের উন্নতি না হওয়ার তাদের দায় কি নেই? 

টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের সাফল্য নেই বলা যাবে না মোটেও। দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে তাদের মাটিতেই ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জয়, একটু এদিক-সেদিক হলে মহাপরাক্রমশালী ভারতকে হারিয়ে নিদাহাস ট্রফি জিততে পারত বাংলাদেশ, বিশ্বকাপ মঞ্চে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বধ এবং ভারতের বিপক্ষে ২ রানের হারের ম্যাচটি আক্ষেপ হয়ে থাকলেও সেই ম্যাচের পারফরম্যান্সকে খাটো করা যাবে না। তবে এসব সাফল্য এসেছে কালেভদ্রে, লম্বা বিরতিতে। এজন্য টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটটায় উন্নতি হয়নি। এবারের বিশ্বকাপের পাফরম্যান্স চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে,  ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিব কোথা।’

মাহমুদউল্লাহ পরিবর্তন, উন্নতির কথা বলেছেন বিশ্বকাপের ব্যর্থ মিশন শেষেই। সত্যিই পরিবর্তন, উন্নতি হবে তো?

ঢাকা/ইয়াসিন

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়