ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

দেখে এলাম দিঘা

সুমন্ত গুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৫, ৩১ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দেখে এলাম দিঘা

সুমন্ত গুপ্ত: ঘড়িতে তখন রাত প্রায় ১২টা। আমি আর মামা জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। মামীর ডাকে আড্ডা ভঙ্গ হলো। বললেন, অনেক রাত হতে চললো আর কতক্ষণ? সকালবেলা ট্রেন ধরতে হবে। ঘুম থেকে উঠতে দেরী হলে আর দিঘা যেতে হবে না। মামীর কথায় যুক্তি ছিল। সায় দিয়ে মামাও বললেন, ভাগিনা চলো এবার নিদ্রা যাই। সক্কাল সক্কাল উঠে হাওড়া যেতে হবে ট্রেন ধরতে। যে কথা সেই কাজ। আমি গেলাম নিদ্রা দেবীর আশ্রয়ে। কিন্তু ঘুম আর ধরে না, সকালে যদি ঘুম না ভাঙে তবে ট্রেন মিস! দুশ্চিন্তা নিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম টেরই পেলাম না। রাত তখন সাড়ে চারটা হবে, মা আর মামী মিলে শুরু করলো ডাকাডাকি- এই ওঠ, তৈরি হয়ে নে! আমার শান্তির ঘুম আবার মার খুব অপছন্দের। শেষ পর্যন্ত ভোর পাঁচটার দিকে ঘুম থেকে উঠতেই হলো। মা আর মামীর তাড়ার চোটে দ্রুত তৈরি হয়ে নিলাম। সূর্যদেব আঁখি মেলে তাকানোর আগেই আমরা বেড়িয়ে গেলাম ট্রেন ধরার জন্য।

ট্যাক্সি সোজা হাওড়ার দিকে ধাবমান। বেশ ভালো লাগছে। জানালা দিয়ে চারপাশটা দেখছি। কলকাতার স্নিগ্ধ সকাল। কোলাহল মুক্ত আমরা চলছি এগিয়ে। হাওড়া ব্রিজ পেড়িয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম স্টেশনে। হাজার হাজার লোকের পদচারণায় মুখরিত হাওড়া স্টেশন। যে যার মত চলছে- কেউ শহরে ঢুকছে, কেউ বের হচ্ছে। সকাল ছয়টায় ট্রেন ছাড়ার কথা আমরা ভোর সারে পাঁচটার মধ্যেই উপস্থিত। আমাদের ট্রেন এখনো প্ল্যাটফর্ম-এ আসে নাই। কি আর করা, মা আর মামাকে বসিয়ে রেখে আমি স্টেশনের এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত হাঁটতে লাগলাম। মাটির হাড়িতে চা বিক্রি করছে দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। যদিও আমি চা পান করি না, তারপরও মাটির ভারের চা চেখে দেখলাম। অসাধারণ স্বাদ! আমার চা পান দেখে মামাও এলেন। এদিকে আমাদের ট্রেন লাইনে চলে এসেছে। ট্রেনের প্রতিটি কামড়ার সামনে যাত্রীদের নাম আর কোচ নাম্বার দেয়া। আমরা নাম দেখে উঠে পরলাম। ঠিক সময়ে ট্রেন ছেড়ে দিলো গন্তব্যপানে।

মামা বলছিলেন দিঘা পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র সমুদ্রকেন্দ্রীক ভ্রমণকেন্দ্র। কলকাতা থেকে মাত্র ১৮৭ কিলোমিটার দূরে মেদিনিপুর জেলায় সমুদ্র, বালিয়াড়ি, ঝাউবন আর অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মিলিয়ে অপেক্ষা করছে প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের জন্য। ৭ কিলোমিটার লম্বা সমুদ্রতট, একপাশে গভীর সমুদ্র, অন্যপাশে ঝাউ গছের অগভীর জঙ্গল। ভেঙে পড়া ঢেউয়ের  জলে পা ভিজিয়ে হেঁটে যাওয়া যায় দীর্ঘ পথ। আমরা চলছি দ্রুতগতির সঙ্গে দিঘার পানে। কিছু সময় পরপর হকাররা সব লোভনীয় খাবার নিয়ে আসছে। আলুর চপ, বাদাম ভাজা, হরেক রঙ্গের বুট ভাজা, পাকুরা, চিরা ভাজা আরো কতো কি। দেখে খুব লোভ লাগছিলো কিন্তু অনেক দূরের যাত্রা তাই ভয়ও পাচ্ছিলাম। শেষ পর্যন্ত ভয় দূর করে আলুর চপ খেলাম। অসাধারণ স্বাদ! সকাল দশটার মধ্যে আমরা এসে পৌঁছলাম  দিঘা স্টেশনে। মামা বললেন হোটেল থেকে গাড়ি পাঠাবে তাই বাইরে গিয়ে কিছু সময় অপেক্ষা করতে হতে পারে। যাই হোক কিছু সময়ের মধ্যেই আমাদের বহনকারী মিনি বাস চলে এলো। উঠে বসতেই বাস ছুটে চললো হোটেল পানে। আমি ক্যামেরা বের করে আশপাশের ছবি তুলতে লাগলাম। অসাধারণ পরিবেশ! চারপাশে শুধু গাছ আর গাছ- যেন পরিকল্পিত বনায়ন। স্বল্প সময়ের মধ্যে আমরা এসে পৌঁছলাম হোটেলে।

 

দিঘায় দুটি সৈকত রয়েছে। একটি পুরনো দিঘার সৈকত, অপরটি নতুন সৈকত। ট্রেন থামে নতুন সৈকত এলাকায়। আর বাসস্ট্যান্ড পুরনো দিঘায়। আমরা পুরনো দিঘার সমুদ্র সৈকতের পাশেই হোটেলে উঠেছি। হোটেলে আমাদের রুমে প্রবেশ করে বারান্দায় দাঁড়িয়েই মন জুড়িয়ে গেলো। বারান্দা থেকে সমুদ্র দেখা যায়। শত শত মানুষের পদচারণায় মুখোর সৈকত এলাকা। একটার পর একটা, ক্লান্তিহীন, অবিরত সমুদ্রের বুকে তৈরি হওয়া বিরাট বিরাট ঢেউ আছড়ে পড়ছে সমুদ্রতটের বালিয়াড়িতে। যতদূর চোখ যায়, ঠিক যেখানে জল আর আকাশ একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে। আমি ক্যামেরা নিয়ে একের পর এক ছবি তুলতে লাগলাম। এদিকে আকাশের মন খারাপ। একটু পরেই শুরু হলো অঝোর ধারায় বৃষ্টি। হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির সাথে সমুদ্রের গর্জন বেশ উপভোগ করছিলাম আমরা।

মামা হঠাৎ বললেন, তোমার পেটে লাগে নাই? আমার তো পেটে রাম রাবণের যুদ্ধ চলছে! আমি বললাম, আমারও তো ঠিক সেই রকম অবস্থা। কালক্ষেপণ না করে হোটেলের ক্যান্টিনে ফোন দিলাম- কী কী আছে খাবারের আয়োজন? ওপাশ থেকে বলা হলো- ভাত, ডাল, লাবড়া, ছোলা বাঁটুরা, ছানার তরকারি, কাঁঠালের তরকারি, সামুদ্রিক মাছ, মাংস, নান। আমরা নান, লাবড়া, ডাল, মাংসের অর্ডার দিলাম। স্বল্প সময়ের মধ্যে ওয়েটার খাবার নিয়ে উপস্থিত। কোনো কথা না বলেই আমি খাওয়া শুরু করে দিলাম। মসলার আধিক্য কম, তবে স্বাদে অতুলনীয়। পেট পূজা শেষ করে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম সৈকতে। রাস্তায় দেখি অনেক লোক! সবাই যাচ্ছে সমুদ্র দেখতে! রাস্তার দুইপাশে সার দেওয়া দোকান। রংবেরঙের অনেক কিছু সাজিয়ে রাখা। আরো সামনে এগিয়ে যেতেই একেবারে সমুদ্রের মুখোমুখি হলাম। বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে সামনের পাথরগুলোর উপর। আমাদের গায়ে এসেও পড়ছে জলের ছিটা। এখন ভাটা চলছে তাই সমুদ্র আরও কাছে চলে এসেছে। আমরা সমুদ্রের পারে বসে লোনা জলের খেলা দেখছিলাম। মামা বললেন, দিঘার প্রকৃত নাম বীরকুল যা অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে অবিষ্কৃত হয়। ভাইসরয় ওয়ারেন হেস্টিংস-এর লেখা একটি চিঠিতে এটিকে 'প্রাচ্যের ব্রাইটন' বলে উল্লেখ রয়েছে। ১৯২৩ সালে জন ফ্রাঙ্ক স্মিথ নামে এক ব্রিটিশ ভ্রমণকারী এখানকার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দিঘায় বসবাস শুরু করেন। তাঁর লেখালেখির ফলে দিঘা সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। ভারতের স্বাধীনতার পর তিনি পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়কে উৎসাহ দেন এখানে পর্যটন সুবিধা বৃদ্ধি করতে।

এদিকে সূর্য দেবের বিদায় বেলা চলে এসেছে। রাতের আঁধারে সমুদ্র পারের দোকানগুলো যেন নতুন মনে হলো। আমরা দোকানগুলো ঘুরে দেখতে লাগলাম। হরেক রকমের পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানী। ঝিনুকের তৈরি নানা ধরনের সামগ্রী। ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম বিভিন্ন প্রকার সামুদ্রিক মাছ নিয়ে বসেছেন মহিলারা। আপনি যে মাছ খেতে চাইবেন সাথে সাথে ভেজে দিবে। রূপচাঁদা, চিংড়ি, কোরাল, সামুদ্রিক ইলিশ আরও কতো নাম না-জানা মাছ। আমি রূপচাঁদা আর চিংড়ি মাছের ভাজা নিলাম। এদিকে খাবার পর্ব শেষ না-হতেই মামা তাড়া দিতে লাগলেন- চল রুমে ফিরে যাই। কাল সকাল সকাল বের হতে হবে নতুন গন্তব্যে। কীভাবে যে সময় কেটে গেল টেরই পেলাম না। 

 

কীভাবে যাবেন

দিঘা যেতে হলে প্রথমে আপনাকে যেতে হবে কলকাতা। কলকাতা থকে ১৮৭ কিলোমিটার দূরত্বের এই সমুদ্র শহরে যাওয়ার জন্য রয়েছে রেল ও সড়কপথ। কলকাতা থেকে রেলে সাড়ে ৩ ঘণ্টা লাগে। এছাড়া কলকাতার বিভিন্ন জায়গা (ধর্মতলা, লেকটাউন, করুণাময়ী, উল্টোডাঙা, গড়িয়া প্রভৃতি) থেকে সারাদিন বিভিন্ন সময়ে দিঘার বাস ছেড়ে যায়। বাসে ৫ থেকে সাড়ে ৫ ঘণ্টা লাগে। 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ জুলাই ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়