ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

বোস কেবিনের কাটলেট

সুমন্ত গুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩৪, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বোস কেবিনের কাটলেট

ভোর পাঁচটা। ঘুমিয়ে ছিলাম। ঈশাণ কোণ থেকে পবিত্র ফজর-এর আযানের ধ্বনি ভেসে এলো। সুমধুর সেই ধ্বনিতে ঘুম ভেঙে গেল। খুব ভালো লাগছিল। জানালা খুলে দিলাম। নরম হাওয়ায় শীতের অনুভূতি ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। আলস্য এসে ভর করল শরীরে। চাদর গায়ে টেনে আয়েশ করে কখন যে আবার ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি। স্বপ্ন দেখলাম- বাসায় ডাকাত পড়েছে। সবাইকে বেঁধে রেখেছে। ইয়া বড় গোঁফ একেকজনের! আমি সবাইকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু হাত-পা কিছুই নাড়াতে পারছি না।

হঠাৎ ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নের ঘোর থেকে বাস্তব জগতে এলাম। আমার নতুন ভ্রমণসঙ্গী সানন্দা গুপ্ত ডাকছেন আমায়। তাড়াতাড়ি ওঠো- মামাবাড়ি যাবে না? হ্যাঁ, তাই তো। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল নয়টা প্রায়। দ্রুত বিছানা ছাড়লাম। মামাবাড়ি যেতে হবে। বলে রাখা ভালো, আমার মামাবাড়ি প্রাচ্যের ডান্ডি অর্থাৎ নারায়ণগঞ্জ শহরে। প্রস্তুত হতে হতে সকাল দশটা। নাস্তা করেই বেরিয়ে পড়লাম।

গুলিস্তান থেকে আমরা শীতল বাসে উঠলাম। প্রায় পঞ্চাশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। গাড়ি থেকে নামতেই দেখি আনন্দ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা ওকে নিয়ে এগিয়ে চললাম। অনেক দিন পর শহরটাকে দেখছি। সেই চিরচেনা শহরের অনেক পরিবর্তন চোখে পড়ল।

মামাবাড়িতে পেট পূজা শেষ করেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। এতদিন পর এসেছি ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়? মনে মনে ভাবতে লাগলাম। ভ্রমণসঙ্গী আনন্দ বললো- দাদা বোস কেবিনে যেতে পারো। শত বর্ষে পা দিতে চলেছে ঐতিহ্যবাহী বোস কেবিন। আমি বললাম, যাওয়া যায়, সেই ছোটবেলা গিয়েছিলাম। ওখানকার মাংসের চপ, ডিমের চপ, কাটলেটের নাম-ডাক অনেক শুনেছি। এককথায় হ্যাঁ বলে দিলাম। ঘড়ির কাটায় দুপুর একটা। তিন চাকার মানবযানে উঠলাম। এগিয়ে চললাম বোস কেবিনের দিকে। নারায়ণগঞ্জ ১ ও ২ নম্বর রেল গেটের মাঝামাঝি, ফলপট্টির কাছাকাছি রেল লাইনের পাশেই বোস কেবিন। ১৯২১ সালে একটি টং ঘরে এই বোস কেবিনের যাত্রা শুরু। গাড়ি এসে থামল বোস কেবিনের সামনে। আমরা নামলাম। কেবিনের সামনে বেঞ্চ পাতা। কয়েকজনকে দেখলাম চা নিয়ে খোশগল্প করছে। কেউ পেপার পড়ছেন। আমরা ভিতরে গিয়ে বসলাম।

বোস কেবিনে আভিজাত্য নেই, আছে ঐতিহ্যের ছোঁয়া। আমরা বসতেই একজন এগিয়ে এলেন। হাসি মুখে জানতে চাইলেন- কী খাবেন? বিশাল এক ফিরিস্তি দিলেন মেন্যুর। মাংসের চপ, ডিমের চপ, কাটলেট, ভাজা মুরগি, মাংসের সঙ্গে সাদা পোলাও, বাটার টোস্ট- আরো কতো কি! আমরা মাংসের চপ, ডিমের চপ, কাটলেট, দই দিতে বললাম। আমাদের ভ্রমণসঙ্গী সুজন মামা এই ফাঁকে বোস কেবিনের ইতিহাস বলতে শুরু করলেন। বোস কেবিনের প্রতিষ্ঠাতা নৃপেন্দ্রচন্দ্র বসু ওরফে ভুলু বোস। বিক্রমপুরে জন্ম। ১৯২০ সালে তিনি দারোগার চাকরি পেয়েও করেননি। তার চিন্তায় তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর বাঙালিদের মধ্যে এক গোপন সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন ২১ বছরের যুবক ভুলু বোস। কলকাতা থেকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের চিঠি আদান-প্রদানের বাহক ছিলেন তিনি। কিন্তু চিঠি আদান-প্রদান নিয়ে একটি সমস্যা দেখা দেয়। কীভাবে কলকাতার চিঠি তিনি নির্দিষ্ট ঠিকানায় পাবেন তা নির্ধারিত ছিল না। সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯২১ সালে নারায়ণগঞ্জ শহরের ১ নং রেলস্টেশন ও স্টিমার ঘাটের কাছে বোস কেবিন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কেবিনের ঠিকানায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের চিঠি আসত। ১৯৩৭ সালে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু নারায়ণগঞ্জ এলে পুলিশ গ্রেফতার করে। খবর পেয়ে ভুলু বাবু কড়া ও হালকা লিকারের দুই কেতলি চা বানিয়ে ছোটেন নেতাজীর কাছে। সেই চা পান করে খুব খুশি হয়েছিলেন নেতাজী। আশীর্বাদ করে বলেছিলেন- তুমি একদিন ভালো করবে, বড় হবে।

একসময় বোস কেবিনে বিখ্যাত ব্যক্তিদের পদধূলি পড়েছে। বোস কেবিনে চা পান করেছেন নেতাজী, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। আরো যাদের পা পড়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এর মধ্যেই আমাদের মাঝে মাংসের চপ, ডিমের চপ, কাটলেট, দই পরিবেশন করা হলো। আমি কালক্ষেপণ না করেই খাওয়া শুরু করলাম। স্বাদের ব্যাপারে কোনো কথা হবে না- অসাধারণ! আমরা প্রতিটি আইটেম চেখে দেখলাম। আমার সহধর্মিণী সানন্দা গুপ্ত খুব খুশি। আমি একের পর এক ছবি তুলতে লাগলাম। আমাদের মত অনেকেই এসেছেন ঐতিহ্যবাহী বোস কেবিনে। নগর জীবনে ব্যস্ততার মাঝে শান্তি খুঁজে পেতে সময় পেলেই অনেকে আসেন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। অফিসে কাজের ফাঁকে সহকর্মীর সঙ্গে লাঞ্চ ব্রেক কিংবা টি ব্রেকে গল্পের আসর জমে ওঠে। বোস কেবিনে চায়ের কাপে ঝড় তুলে চলে তুমুল ম্যারাথন আড্ডা। তবে এক্ষেত্রে প্রবল আড্ডাবাজ হিসেবে এগিয়ে থাকবেন লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীরা। আমরাও খাবারের ফাঁকে আড্ডা দিলাম অনেকক্ষণ।

বোস কেবিনে সকালের নাস্তায় পাওয়া যায় পরোটা, দাম ৫ টাকা। ডাল ও হালুয়া ১০ টাকা। ডিমের ৬ রকমের পদ ছাড়াও খাসি ও মুরগির মাংস। দুপুর ১২টা থেকে পাওয়া যায় আলুর চপ- ১৫ টাকা। পোলাও ৫০ টাকা। মোরগ পোলাও ৮০ টাকা। কারি ৯০ টাকা। মাটন কাটলেট ৫৫ টাকা। চিকেন ফ্রাই ৭৫ টাকা।  এখানে দুপুরে ভাত বিক্রি হয় না। নেতাজী যে চা পান করে প্রশংসা করেছিলেন, কড়া লিকারের সেই চা বড় কাপে পান করতে পারবেন মাত্র ১৫ টাকায়। সবসময় এখানে চা পাওয়া যায়। অনেকে এখানে আসেন কেবল কাটলেটের স্বাদ নিতে। বোস কেবিনের কাটলেট এক কথায় অসাধারণ। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে বোস কেবিন। শুরু থেকেই এই নিয়মে চলছে। ছুটির দিনগুলোতে এখানে তিল ধারণেও জায়গা থাকে না।

গুলিস্তান থেকে উৎসব, বন্ধন, বিআরটিসি বা শীতল বাসে সরাসরি নারায়ণগঞ্জের কালীরবাজার নেমে রিকশায় বা হেঁটে চেম্বার রোডে গেলেই পেয়ে যাবেন বোস কেবিন। বাসে ভাড়া ৩৬ থেকে ৫৫ টাকা। আপনি চাইলে ট্রেনে কমলাপুর থেকে সরাসরি নারায়ণগঞ্জ যেতে পারেন। ভাড়া জনপ্রতি ১৫ টাকা।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়