ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ দুর্গাপূজা

সুমন্ত গুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩১, ৩ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ দুর্গাপূজা

বছরের সেই সময় উপস্থিত। ভোর পাঁচটায় উঠে ঘুমকাতুরে চোখে রেডিও খুলে ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে…’ শুনে দিন শুরু করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। মহালয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় দিন গণনা, দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমনের সময়। এই দিন থেকেই মূলত শুরু হয় দেবী বন্দনা। এর কয়েকদিন পরেই পূজা।

সেবার পূজায় কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায় ঠিক করতে পারছিলাম না। পূজার পরিক্রমা আগে থেকে ঠিক করতে না পারলে অফিস থেকে ছুটি পাওয়া খুব মুশকিল। পূজায় দশমীতে বন্ধ থাকে অফিস। মূলত দশমীতে তেমন কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই দেবী বিসর্জন ছাড়া। তাই আগের চার দিন অনেক কষ্ট করে ছুটি নিতে হয়। এবারও তাই হলো। ছুটি প্রার্থী আমিসহ আরো চারজন। পূজায় ছুটি পাওয়া মানে যুদ্ধ জয়ের মতো; অন্তত আমাদের অফিসে। যাই হোক, অনেক কষ্ট করে তিনদিন ছুটির ব্যবস্থা করলাম। আমার সব সময়ের ভ্রমণসঙ্গী মাকে বললাম ছুটির কথা। কিন্তু নতুন কোথায় যাওয়া যাই এই পূজায়। ভাবছি আর অফিস করছি। হঠাৎ মনে হলো সুজন মামাকে ফোন দিলে মন্দ হয় না। মামা নতুন জায়গার সন্ধান দিতে পারবে। যেই ভাবা সেই কাজ। দিলাম ফোন। কিছু বলার আগেই মামা বলে উঠলেন- কোথায় যাচ্ছিস এবার পূজায়? আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, কোথায় যে যাবো ঠিক করতে পারছি না। তাই তোমাকে ফোন দেয়া। মামা কিছু সময় ভেবে বললেন, তুই খুলনার হাকিমপুর শিকদার বাড়ির পূজা দেখে আয়। উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ দুর্গাপূজা হয় সেখানে। বললাম, যাবো কীভাবে? মামা বুঝিয়ে বললেন কীভাবে যেতে হবে। আমি  ঠিক করে ফেললাম এই পূজায় তাহলে শিকদার বাড়িই হবে আমাদের গন্তব্য।

 

 

সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা জেলা বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম জেলা। শিল্প বাণিজ্য, প্রকৃতি ও লোকজ সংস্কৃতির অভূতপূর্ব মিলন ঘটেছে এই জেলায়। রূপসা, ভৈরব, চিত্রা, পশুর, কপোতাক্ষসহ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নদী রয়েছে খুলনায়। এবার মাতৃদেবের অনুমতির অপেক্ষা। মাকে বলতেই মা রাজি হলেন। লঞ্চ অথবা ট্রেনে খুলনা যাওয়া যায়, হাওয়াই জাহাজেও যাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে যশোর নেমে তারপর বাসে উঠতে হয়। আগের থেকে খুলনার বাসের টিকিট করে রাখলাম। কারণ পূজার সময় টিকিট না পেলে সর্বনাশ! পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।

নির্দিষ্ট দিন বাসা থেকে ত্রি-চক্র যানে  বেরিয়ে পড়লাম সায়দাবাদ অভিমুখে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম হানিফ পরিবহনের কাউন্টারে। আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন বাসমহাশয়। উঠে পড়তেই কাল বিলম্ব না করে ছুটে চললেন গন্তব্য পানে। বলা হলো না- সেদিন দেবী বন্দনার দ্বিতীয় দিন মানে সপ্তমী। বলে রাখা ভালো, পুরাণের বিবরণ অনুযায়ী, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালবাসী মহিষাসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। দেবতারা মহিষাসুরকে বধ করতে তাঁদের শক্তির সম্মিলন ঘটান। আর তখন মহাশক্তি নারীরূপে আবির্ভূতা হন মহামায়া দেবী দুর্গা। পুরাণে বলা হয়েছে, ভগবান শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কাজয়ের আগে সীতাকে উদ্ধারের জন্য অসময়ে দুর্গাপূজা করেছিলেন। এজন্য দুর্গাপূজাকে দেবীর অকাল বোধনও বলা হয়। অশুভ শক্তি বিনাস করতে, শান্তি প্রদান করতে মা দুর্গা ধরাধামে আসেন বারবার। সময়ের সাথে সাথে আমরা ছুটে চলেছি গন্তব্য পানে। ফেরি পার হবার সময় আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দ্রুত বেগমান কাজ দেখলাম।

 

 

ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে কিন্তু কখন পৌঁছাব তাই ভাবছিলাম। প্রায় সাড়ে আট ঘণ্টা যাত্রার পরে আমরা পা দিলাম খুলনা শহরে। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল পাঁচটা। সূর্য দেবের বিদায় বেলা চলে এলো বলে। রাতের বাসে আবার ফিরতে হবে, তাই দেরি না করে একটি আবাসিক হোটেলে উঠে বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম শিকদার বাড়ির উদ্দেশ্যে। আমাদের যেতে হবে হাকিমপুরে। কীভাবে যাবো জানতে চাইলে পথিক বললেন, সামনে পাবেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। আপনাকে পৌঁছে দেবে। পথিকের কথা মত আমরা চেপে বসলাম সেই গাড়িতে। মূল সড়ক থেকে ছোট রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি। দেখতে দেখতে আমরা এসে পৌঁছলাম শিকদার বাড়ির প্রবেশ দ্বারে। পূজাকে কেন্দ্র করে ছোটখাটো মেলা বসে গেছে। চারপাশে রঙিন আলোর ঝলকানো রূপ আমাদের বিমহিত করলো। মন্দির প্রাঙ্গণে দর্শনার্থীদের ভিড়। পদব্রজে আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম। মন্দিরের আদলে তৈরি করা হয়েছে বিশাল প্যান্ডেল। প্যান্ডেলে আলাদা আলাদাভাবে বিভিন্ন দেব-দেবীর প্রতিমা সাজিয়ে রাখা। মা দুর্গার মূল মণ্ডপের সঙ্গে কয়েকটি সারিতে যুক্ত করা হয়েছে বিভিন্ন দেব-দেবীর প্রতিমা। দেখলে মনে হবে পূজা প্যান্ডেল যেন দেবালয়। বিভিন্ন দেব-দেবী, মা দুর্গার সঙ্গী হয়ে ধরাধামে এসেছেন একসঙ্গে।

মহিষাসুরকে যেভাবে বধ করেছিলেন দেবী দুর্গা, বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্রতিমার মাধ্যমে। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিমায়। প্রতিমাশিল্পীরা হাতের নিপুণ ছোঁয়া আর রঙ-তুলিতে অপরূপ সাজে প্রতিমা সাজিয়েছেন। চলতি পথে একটি সতর্কবার্তা আমায় থামিয়ে দেয়। পকেটমার হতে সাবধান! লেখাটি দেখেই আমি পকেটে হাত দেই মানিব্যাগ ঠিক আছে কি না দেখতে। না, মানিব্যাগ তার অবস্থানেই আছে, তবে আমি আরেকটু সাবধানী হয়ে পথ চলতে লাগলাম। বিশাল ওই প্যান্ডেল ঘুরে দেখতে পেলাম, ঘোড়ায় চড়ে দুর্গার মর্ত্যলোকে আগমন, নারায়ণের অনন্ত শয্যা, বিশ্বদেবের শরশয্যা। কুম্ভু অবতার, মৎস্য অবতার, রামচন্দ্রের অকালবোধন, সীতাকে হরণ, রামচন্দ্রের রাবণ বধ, মহিনাথ পর্বত, অষ্টশখীর জলকেলি, অভিমন্যু বধ, শ্রীকৃষ্ণের ভক্তপূজা, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, একমূর্তিতে শিব এবং মা দুর্গা, সীতার জন্ম, হরপার্বতী, পঞ্চপাণ্ডবের বনবাস এবং দোলায় চড়ে দুর্গার গমনসহ নানা বিষয় প্রতিমার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এমনকি লালন ফকির এবং টেলিফোনের আবিষ্কারক আলেকজেন্ডারকে দেখানো হয়েছে প্রতিমার মাধ্যমে। পূজা প্যান্ডেলের পাশে পুকুরে ৪৫ ফুট উঁচু লক্ষ্মী ও নারায়ণ স্থাপন করা হয়েছে।

 

 

কথা হচ্ছিল ঐ এলাকার শম্ভুদার সাথে। তিনি বলছিলেন ২০১১ সালে বৃহৎ এই পূজা সর্বপ্রথম ২৫১টি প্রতিমা তৈরির মাধ্যমে শুরু করেন দুলালকৃষ্ণ শিকদার। ২০১৬ সালে প্রতিমার সংখ্যা ছিল ৬০১টি। ২০১৭ সালে ছিল ৬৫১টি। আর ২০১৮ সালে এই মণ্ডপে ৭০১টি প্রতিমা তৈরি করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে তা বেড়ে আজ ৮০১টি প্রতিমা স্থাপনের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে। দীর্ঘ ৬ মাস অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে ১৫ জন শিল্পী দিন-রাত পরিশ্রম করে নিপুণ দক্ষতায় গড়ে তুলেছেন এমন সব তথ্যবহুল প্রতিমা। এখানে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি- চার যুগের কাহিনি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতিমার সংখ্যার দিক দিয়ে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পূজামণ্ডপ। কথা বলছি আর পৌরাণিক কাহিনির আদলে তৈরি করা মূর্তি দেখে অভিভূত হচ্ছি। আমাদের মতো শতশত মানুষ এসেছেন দেবী দর্শনে। সবার মুখে একই কথা- আগামী কাল থেকে মানে অষ্টমী, নবমীর দিন পূজা মণ্ডপে প্রবেশ করাই না কি কঠিন হবে। তাই আজকেই তারা এসেছেন। দেখতে দেখতে কীভাবে যে সময় পার হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। ঘড়ির কাটায় তখন রাত আটটা। অল্প সময় পরেই আমাদের ফিরতি পথে যাওয়ার জন্য বাস ধরতে হবে। মন্দির প্রাঙ্গণ, এই কোলাহল ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছিলো না। কিন্তু নগর জীবনে আবার ফিরে যেতে হবে জীবিকার প্রয়োজনে। তাই আর কালবিলম্ব না করে ছুটে চললাম শহর পানে।

যাবেন কীভাবে: শিকদার বাড়ির দুর্গাপূজা দেখতে হলে প্রথমে খুলনা অথবা বাগেরহাট আসতে হবে। জায়গাটি এই দুই জেলা শহরের প্রায় মাঝামাঝি। সেখান থেকে মংলা রাস্তা ধরে চুলকাঠি বাজার আসতে হবে। পথের পাশেই পূজা মন্দিরের বড় তোরণ দেখতে পাবেন। তাছাড়া খুলনা থেকে হাকিমপুর আসতে সময় লাগে মাত্র ২০ মিনিট। খুলনায় অনেক আবাসিক হোটেল রয়েছে। সুতরাং রাতে থাকার কোনো সমস্যা হবে না। 



ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়