ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

আনতালইয়া এক প্রাচীন জনপদের হাতছানি: সূচনা পর্ব

ফাতিমা জাহান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৯, ২৩ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আনতালইয়া এক প্রাচীন জনপদের হাতছানি: সূচনা পর্ব

ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশি ছুঁয়েছে আকাশের নীল

তুরস্কের আনতালইয়া শহরে পৌঁছালাম সকাল ছ’টায়। সূর্য কখন উঠে সোনালী আভা ছড়িয়েছে; সেই ভোর সাড়ে চারটায়, চলন্ত বাস থেকেই সূর্যোদয় দেখা মিস করিনি। কফি পান করাও শেষ। এসেছি আরেক রাজ্য কাপাদোকিয়া থেকে। সারারাত বাস ভ্রমণ। এ দেশের দূরপাল্লার বাসে কিছুক্ষণ পরপর চা, কফি, জুস, কুকিস, কেইক সার্ভ করার নিয়ম আছে। আর গান শোনা, মুভি দেখা, গেইম খেলার জন্য প্লেনের মতো স্ক্রিন দেয়া আছে সিটের সামনে। যাত্রীদের একঘেঁয়ে হবার অবকাশ নেই।

এখানকার বাসস্ট্যান্ডকে বলে অতোগার। আমি হোটেলে যাবার জন্য আরেকটি বাস ধরলাম, হোটেল আগে থেকেই অনলাইনে বুক করে রেখেছিলাম; মূল ট্যুরিস্ট এলাকায়। বাস নামিয়ে দিল আনতালইয়া ওল্ড টাউনে। হোটেলের ঠিকানা পথে খুঁজে পাওয়া একমাত্র পথচারী জানে না। দোকানপাটও খোলেনি যে জিজ্ঞেস করব। পথিমধ্যে একজন মেহেরবান যিনি লম্বা লম্বা বনরুটি বিক্রি করছিলেন একটি কার্টে, তিনি পাশের জুতোর দোকানিকে জিজ্ঞেস করলেন। দোকানি নিজের ফোনে খুঁজে বের করে বললেন, আরো এক কিলোমিটার পথ হাঁটতে হবে। আমি হাঁটা ধরলাম। সকালের মিষ্টি রোদ ছড়িয়ে পড়ছে, গ্রীষ্মকাল তবে গরম নেই, ভালোই লাগছে হাঁটতে। নতুন শহর, অচেনা চারপাশ, যেন নতুন বইয়ের প্রথম পাতার মতো।

আনতালইয়া শহর ধীরে ধীরে মুখর হতে চাইছে। আরো খানিকক্ষণ হেঁটে একটা কফিশপে ঠিকানা জিজ্ঞেস করতেই আমাকে তাদের ওয়াইফাই ধার দিল। বসতে বলল। আহা, মানুষ এত ভালো হয়! আমি যে কোনো দেশে ভ্রমণ করলে মোবাইল ফোনের সংযোগ নেই না। প্রয়োজন পড়ে না। রাস্তা হারিয়ে ফেললে গুগল ম্যাপের চেয়ে পথের মানুষ আমার পরম বন্ধু হয়ে পাশে থাকে। আমার হোটেলটি খুব কাছে। কয়েকটি স্ট্রিট পরেই। দোকানিকে ধন্যবাদ জানিয়ে চললাম হোটেলের উদ্দেশ্যে।

হোটেলে ঢুকে মাথা ঘুরে গেল। এত সস্তায় থ্রি স্টার হোটেল পেলাম কী করে! হোটেল রিসিপশনিস্টের নাম হাফিযেহ। খুব মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে। চাবি নিয়ে রুমে গিয়ে দিলাম ঘুম। উঠে দেখি বেলা ১২টা বাজে। কিছু খেতে হবে, শহরটাও দেখতে হবে যে! নিচে রিসিপশনে হাফিযেহ’র কাছ থেকে জেনে নিলাম কতদূরে কী কী দর্শনীয় স্থান আছে। হোটেল থেকে বেরোলেই ট্রামওয়ে। আমি এত বোকা, ট্রামে করে বাসস্টেশন থেকে আসতে পারতাম, এত কাছে হোটেল থেকে। এ আর নতুন কি আমার জন্য। আলাভোলা মানুষ, ভুল করবোই। জীবনেও সোজা পথে হাঁটিনি।

দু’টো স্ট্রিট পেরোতেই দেখি একটা শপিং মলের পেছনে মানুষের আড্ডাস্থল। বেশিরভাগই চা পান করছেন আর পাশার মতো এক ধরনের খেলা খেলছেন ছোট ছোট টেবিল-চেয়ারে বসে। গোল গোল ক্যারামের গুটির মতো গুটি গুনে কী সব হিজিবিজি হিসাব করে খেলতে হয়। একটা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে চাইলেই খেলায় মগ্ন এক ভদ্রলোক আমাকে জোর করে বসিয়ে দিলেন পাশের একটা চেয়ারে, যেন কত দিনের চেনা, অনেক দিন বাদে দেখা হলো। আমার জন্য চা আনতে বললেন চায়ের দোকানিকে। ভদ্রলোকের নাম মেতিন, বয়স হবে পঁয়ষট্টি, পেশায় দর্জি ছিলেন। এখন তাঁর অবসর, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় কাটে। তারা একমনে খেলে যাচ্ছিলেন।

বিভিন্ন স্বাদ ও ঘ্রাণের টার্কিশ চা 

মেতিন অ্যান্ড ফ্রেন্ডসকে পেছনে ফেলে আমি দুপুরের খাবার খেতে চললুম। ফাঁকা দেখে একটা রেস্টুরেন্টে বসে পড়লাম। ডোনার খেতে ভালোবাসি, তাই ডোনারই সই। রেস্টুরেন্টের কুক জেলাল নাকি দুবাইয়ে কাজ করেছে। ইংরেজিও ভালোই জানে। ভারতবর্ষ থেকে এসেছি জেনে হেসেখেলে গাদাখানেক মরিচ দিয়ে দিল আমার ডোনারে। আর খাওয়ার সময় বলল, ‘ইন্ডিয়ান ফুড ভেরি টেস্টি।’

একে তো ঝাল খাই না, দুইয়ে জেলালের দাঁত বের করা হাসি দেখে এক ঝাড়ি দিতে ইচ্ছে হলো। পরে ভাবলাম বেচারারই বা কি দোষ! আমাদের এদিককার সবাই তো খুব ঝাল খাবার খায়।    

খেয়ে রওনা হলাম ওল্ড কোয়ার্টারের দিকে। আমার হোটেল থেকে ওল্ড কোয়ার্টার অবধি রাস্তার দু’পাশে শুধুই বিশাল বিশাল শপিং মল। সকালে সব বন্ধ ছিল তাই বুঝতে পারিনি, এসেছি এ পথ ধরেই। রমজান মাস, সামনে ঈদ। প্রত্যেকটা পণ্যে ৫০ শতাংশ বা আরো বেশি ডিসকাউন্ট দিচ্ছে সবাই। আমাদের দেশে এখন সব জিনিসের দাম চারগুণ হয়ে গিয়েছে। দেশের মতো দমবন্ধ করা ভিড় না হলেও মোটামুটি ভিড় তো আছেই ঈদের বাজার করতে আসা মানুষের।

ওল্ড কোয়ার্টার যেন আধুনিক শহরের মাঝখানে এক পুরনো জেল্লাময় দাদা, পরদাদাদের আবাসস্থল।

পারগামনের রাজা আতালুস (২) আনতালইয়া শহর প্রতিষ্ঠা করেন খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে। গ্রীক ভাষায় শহরটির নাম ছিল আতালিয়া৷ গ্রীক সম্রাটের নৌবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি ছিল এটি। রোমান সম্রাট আনতালইয়া শহর দখলের পর বেশ কিছু রোমান স্থাপনার নিদর্শন মেলে। এরপর হাতবদল হয় সেলজুক সালতানাত হয়ে অটোম্যান সাম্রাজ্যে ১৪২৩ খ্রিস্টাব্দে। সে লম্বা ইতিহাস। আর সে কারণেই এই ওল্ড কোয়ার্টারে রয়েছে সকল সালতানাতের নিদর্শন। তবে অটোম্যান সাম্রাজ্য চলাকালে ওল্ড কোয়ার্টার আকর্ষণ হারিয়ে ফেলতে থাকে আর বিরাণ হয়ে যায় এ জনপদ। তুরস্কের স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর এলাকাটিকে ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

ওল্ড কোয়ার্টারের ছায়ানীবিড় পথ

ওল্ড কোয়ার্টারে ঢুকতেই হাতের বাঁ দিকে পড়বে ইয়ুভলিমিনার মসজিদ। ১২৩০ খ্রিস্টাব্দে ‘আলাদ্দিন কে কুবাদ’ নির্মাণ করেন এই মাসজিদ। মসজিদটির মিনার দেখতে অনেকটা বাঁশির মতো। আনতালইয়ার অন্যতম প্রাচীন এই মসজিদটিতে এখনো মুসল্লিরা আসেন নামাজ পড়তে। আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, মসজিদের ভেতরের মেঝেতে এখনো পানির একটি কূপের অস্তিত্ব রয়ে গেছে, যা আসলে ব্যবহৃত হতো আলাদাভাবে পানি গরম ও ঠান্ডা রাখার জন্য। মসজিদে ঢোকার ব্যাপারে তেমন বাধানিষেধ নেই। লম্বা পোশাক না পরে এলে মসজিদের প্রবেশ দ্বারেই রাখা আছে লম্বা স্কার্ট আর মাথা ঢাকার জন্য স্কার্ফ। মসজিদ দেখা হয়ে গেলে আবার পোশাক যথাস্থানে রেখে দিলেই হয়। মসজিদের আরেক পাশে রয়েছে সে আমলের বিশিষ্টজনদের কবর।

ইয়ুভলিমিনার মসজিদ পার হয়ে ওল্ড কোয়ার্টারের অলিগলির পথ ধরলাম। এ যেন এক প্রাচীন গ্রীক নগরী। পথ খণ্ডখণ্ড পাথর দিয়ে বাঁধাই করা, দু’পাশে অনুচ্চ দালান। অবশ্য একতলা ভবনগুলোর বেশিরভাগই এখন বিভিন্ন ধরনের পশরা সাজিয়েছে পণ্যের। সবই বলতে গেলে হস্তশিল্প। ল্যাম্প, বাসনকোশন, শো-পিস, স্কার্ফ, গয়না, টার্কিশ চা আরো কত কি! টার্কিশ চায়ের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলাম। দোকানি ধরে বসিয়ে দিল, এক কাপ চা রাখলো সামনে, অগত্যা ব্যাগ ক্যামেরা রেখে চা পান করতে বসলাম। স্বভাবসুলভ আলাপচারিতা শুরু হয়ে গেল। রং চা তাও আবার বাহারি তার ফ্লেভার, একেকটা চা একেক ফ্লেভারের। নামগুলোও মজার- সুলতান টি, হারেম টি ইত্যাদি। গরম বা ঠাণ্ডা যে কোনোভাবেই পান করা যায়। দোকানি বাংলাদেশ চেনে না। জিজ্ঞেস করলাম ভারতবর্ষের নাম তো শুনেছ। সে কথা শোনার সাথে সাথেই দোকানি উচ্চস্বরে বলিউড মুভির গান গেয়ে উঠল,

‘ম্যায় শায়ের তো নেহি, মাগার এ্যায় হাসিন

জাবসে দেখা, ম্যায়নে তুঝকো...!’

দোকানির বলিউড প্রীতিতে মুগ্ধ হয়ে গেলাম, যদিও হিন্দী উচ্চারণ তার ঠিকমতো আসছিল না। তবুও চেষ্টার তারিফ করতে হয়। এ যাবতকালে যত দেশে গিয়েছি প্রায় সব দেশেই বলিউড এক উচ্ছ্বাসের নাম। গান শোনা শেষ হলো, দোকানি আমাকে ভালো মানুষ পেয়ে দুই ধরনের চা গছিয়ে দিল। সবই ঠিক আছে কিন্তু তুর্কী দেশের বিড়াল যে আমায় ছাড়ে না, আগেও এমন হয়েছে। দেখি আমার ব্যাকপ্যাকের উপর একটি বিড়ালের বাচ্চা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। সে দৃশ্য দেখতে আশপাশের দোকানি আর ট্যুরিস্টদের ভিড় জমে গেল। বিড়ালছানার নিদ্রাভঙ্গ হলো কোলাহলে, তিনি উঠে চলে গেলেন। তবেই আমার মুক্তি মিলল।

আবার পথ ধরে চললাম সাগর পানে। পথের পাশের প্রাচীন দালানগুলো যেন কথা বলে ওঠে নিজেদের মধ্যে। কত রাজা বাদশাহ, কত হাত-বদলের সাক্ষী এই ভবনগুলো। এখন পরিত্যক্ত আধখোলা জানালা, শক্তপোক্ত রক্ষী দরজা আর তার কারুকাজ বলে যায় কত ত্যাগ স্বীকার করেছে তারা এই জনপদকে জীবন্ত রাখতে গিয়ে।

দেখা মেলে স্থাপত্য কলার অনন্য নিদর্শন

পথের শেষ প্রান্তে মিলবে ভূমধ্যসাগরের তীর। আমাদের মতো ভ্রমণার্থীদের অবকাশ যাপন কেন্দ্র। বলা হয়ে থাকে আনতালইয়ার এই সমুদ্র বন্দরটি তুরস্কের সবচেয়ে বিখ্যাত অবকাশ যাপন কেন্দ্র। সমুদ্রতীরে মানুষের ভিড় জানান দিচ্ছে এর বিখ্যাত হবার ইতিহাস। এখন রোদ পশ্চিমের দিকে হেলে পড়েছে প্রায়। সমুদ্রতটে বাঁধা আছে ছোটবড় পালতোলা বোট বা ইঞ্জিন নৌকা, পরিচ্ছন্ন সাদা রং তাদের। যেন গাঢ় নীল সাগরের মাঝে একরাশ মেঘ। সমুদ্রসৈকতে নানান মানুষের সমাগম। কেউ স্থানীয়, কেউ দেশী ভ্রমণার্থী, কেউ বা বিদেশি। পর্যাপ্ত পরিমাণে রেস্তোরাঁ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফুটে ওঠা বুনোফুলের মতো। কিছুক্ষণ সাগরপাড়ে হাঁটাহাঁটি করে ওল্ড কোয়ার্টার ধরে আরেকটি পথ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। অলিগলির অভাব নেই ওল্ড কোয়ার্টারে। পরবর্তী গন্তব্য হেড্রিয়ান গেইট।

পৃথিবীতে রাজা হেড্রিয়ানের সম্মানে চারটি গেইট তৈরি করা হয়েছিল প্রায় একই সময়ে। এথেন্স, আনতালইয়া, ইতালি আর জর্ডানে। তবে একেকটা গেইট দেখতে একেক রকম। আনতালইয়া শহরের গেইটটির নির্মাণকাল ১৩০ খ্রিস্টাব্দ। পাথরের তৈরি বিশাল এই গেইট বা তোরণ উচ্চতায় তিনতলা বাড়ির সমান, গায়ে রোমান স্থাপত্যশিল্পের ছাপ প্রকট, খোদাই করা আছে ফুল, পাতা, নকশা।  হেইড্রিয়ান গেইটের আশেপাশে বসেছে মানুষের মেলা। কেউ আড্ডা দিতে এসেছেন তো কেউ এসেছেন বাচ্চাদের নিয়ে, বাচ্চারাও মহানন্দে ছুটোছুটি করছে। আমার মতো ভ্রমণার্থীদের মেলাটিও ছোট নয়।

হেড্রিয়ান গেইট পার হয়ে হাঁটতে থাকলাম আমার হোটেলের দিকে। মাগরেবের আযান পড়ল বলে। ঘড়িতে বাজে সোয়া আটটা। তুরস্কে এমন সময়ই মাগরিবের ওয়াক্ত হয়। পথে ফুটপাতে গিটার বাজিয়ে গান করে পথচারীদের মন ভোলাতে চাইছেন দুজন যুবক। গান শুনলে এমনিতেই আমি ভুলে যাই স্থান-কাল-পাত্র। আর তুর্কী সুর যেন আরো মোহময়!   (চলবে)

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়