ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

নাথুলা-সাঙ্গু হয়ে ফিরে এলাম গ্যাংটক

সিয়াম সারোয়ার জামিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৭, ৩০ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নাথুলা-সাঙ্গু হয়ে ফিরে এলাম গ্যাংটক

পুরো দিনটিতে আমি তিন জায়গায় বেড়াব বলে ঠিক করলাম। সাঙ্গু লেক, বাবা মন্দির এবং নাথুলা পাস। সকাল সাড়ে আটটার দিকে হোটেল ম্যানেজার মান্নুদা জানালেন- ট্যাক্সি এসে পড়েছে। দ্রুত বের হতে হবে।

নাস্তা আগেই সেরেছিলাম। রুটির সঙ্গে বয়েলড চিকেন। বাংলাদেশের মতো না হলেও সুস্বাদু! দ্রুত বের হলাম। হোটেলের গেটে ট্যাক্সি দেখে মন নেচে উঠল। স্বস্তি পেলাম। হাসিমুখেই হাত এগিয়ে দিলেন ড্রাইভার রবিন থাপা।  তাড়া দিলেন দ্রুত সরতে হবে। না হলে ট্রাফিক জরিমানা করবে। এখানকার ট্রাফিক আইন খুব কড়া। তিনি ঠিকঠাক বাংলা বোঝেন। বলতেও পারেন। তবে ভাঙা ভাঙা। আমরা খুশি হলাম।

গাড়িতে উঠেই কথাপ্রসঙ্গে জানা গেল রবিন থাপা ১২টি ভাষা বোঝেন। তবে হিন্দি আর ইংলিশই শুধু ঠিকঠাক বলতে পারেন। বাকিগুলো ভাঙা ভাঙা। আমরা অবাক হয়ে সবাই ওর দিকে তাকালাম। জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে পারেন?

সুদর্শন রবিন হেসে বললেন, ‘দাদা, শিখে নিয়েছি। আমার বউ বাঙালি।’ আমরা আরো বিস্ময় নিয়ে তাকালাম- ‘কীভাবে?’

‘আমি পশ্চিমবাংলায় দুবছর ট্যাক্সি চালিয়েছি। সেসময় আপনার বউদির সাথে প্রেম। পরে বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে এসেছি।’  বলেই রবিন থাপা লজ্জা পেলেন যেন।

ট্যাক্সি ক্রমশ ওপরের দিকে উঠছে। আমার নার্ভাসনেস ক্রমশ উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। ওপরের দিকে কী আছে? আমি কি স্বর্গের দিকেই যাচ্ছি? শুধু উঠছি আর উঠছি- শেষ হবে কখন? এসব প্রশ্ন মাথায় ভিড় করছে একসঙ্গে। জ্যাকেট ভেদ করে ঠান্ডা বাতাস আমার মুখে চুমু খাচ্ছে যেন। প্রথম দৃশ্যটা পরিষ্কার হলো। তারপর মেঘ ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হলো। পুরো এলাকা মেঘে ঢাকা। হঠাৎ মনে হলো- আমি যেন মেঘে ভাসছি। রাস্তাটা খুবই সরু। বিপজ্জনকও বটে। দুর্ঘটনায় পড়েও যেতে পারে গাড়ি। তবে গাছের গুড়িগুলো স্বস্তি দিচ্ছে আমাদের।

নাথুলা পাসে গাড়ি ঢুকতেই আমি প্রকৃতির সৌন্দর্যে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম যেন। ট্যাক্সি থামিয়ে দিলেন রবিন থাপা। সবাই নেমে পড়লাম। আমি সন্দিহান হয়ে পড়ছিলাম বারবার। আসলে কোথায় এসেছি! আমার হাত আর ঠোঁট ঠাণ্ডায় কাঁপছে। আমার পুরোটাই কুপোকাত যেন। যদিও জ্যাকেট পরে আছি। তবে গ্লাভস নেই। ক্যাপও নেই। স্থানীয় এক বৃদ্ধা বললেন, ‘সাবধান! উত্তেজনায় মরতে বসো না আবার। এখানে অক্সিজেন লেভেল খুবই কম। খুব সাবধান!’ আমি হঠাৎ দেখলাম, ইন্ডিয়ান আর্মির দুই সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে। অবিচল, অটল ভঙ্গিমায়। যেন কিছুতেই নড়ানো যাবে না। বুঝলাম যে, এটাই তাদের দায়িত্ব। এই সৈনিকদের জন্যেই ভারতবাসী গর্ব করেন। ‘জয় হিন্দ’ স্লোগান দেন।

নাথুলা পাস থেকে আমরা বাবা মন্দিরের দিকে ছুটলাম। যখন সবাই ক্যাফেটেরিয়ার দিকে যেতে ব্যস্ত বা কেনাকাটায়, আমি তখনও প্রকৃতি দেখতে মত্ত। আমার সিকিম সফর সফল হলো, যখন আমি আরেকটু এগিয়ে দেখলাম, একটি অতীব সুন্দর আর নীরব একটা লেক। যা ঘিরে আছে সবুজ পাহাড়। নাম সাঙ্গু লেক।

শান্ত, স্থীর, নীরব। আমি জানি না, আর কী কী উপমা দেয়া যেতে পারে। লেকের পানি স্বচ্ছ।  জলের গহীনে থাকা পাথর দেখা যায়। মনে হয়, হাত বাড়ালেই ছোয়া যাবে। আমি জীবনের সবচেয়ে সুন্দর কিছু সময় অতিবাহিত করলাম। কথা বললাম লেকের সঙ্গে। প্রকৃতির সঙ্গে। আমার শহর থেকে, পরিবার থেকে অনেক দূরে এই পৃথিবীটাকে নতুন করে অনুভব করলাম যেন। আমি হেসে ফেললাম। আবেগে কাঁদলামও।

এখন পর্যন্ত সবকিছুই ঠিক চলছিল। কোনো ঝামেলা নেই। স্পিড ব্রেকার নেই। আমি দারুণভাবে আমার সময়গুলো উপভোগ করছিলাম। আমি ভুলে গেছিলাম, আমার টাকা কমে এসেছে। আমার অর্থ দরকার। সামনে আরো খরচ আছে। টাকাটা দরকার। পথে আমি একবার থামলাম। এটিএম পেলাম। কিন্তু টাকা উঠলো না।  ভাগ্যটা ভালো না বলতেই হচ্ছে। ফাঁকা এটিএম বুথ। কী করবো? অবশ্য দাদার কাছে টাকা আছে। সেখান থেকেই নেয়া যায়। কিন্তু আবারও চেষ্টা করলাম। অবাক করা বিষয়, ট্রানজেকশন ফেইলড দেখাল। কিন্তু টাকা ডেবিট দেখাচ্ছে। হঠাৎ করে আকাশ ভেঙে পড়ল আমার মাথায়। আমি রাস্তার মাঝখানে ক্লুলেস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। আমি একটা অচেনা জায়গায় অচেনা পথে অচেনা শহরে টাকা ছাড়া দাঁড়িয়ে আছি। ভাবতেই কেমন লাগল। অসহায় মনে হলো। ভুলে গিয়েছিলাম আমি একা নই। দাদা, বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, একদম টেনশন করিস না। আমি দিচ্ছি। পরে দিয়ে দিস।

পরদিন ভোরে আমি যখন ঘুম থেকে উঠলাম। তখন ভাবলাম, আমি এখানে মন খারাপ করতে আসিনি। কষ্ট পেতে আসিনি। সুখ আমার হাতের মুঠোয়। আমি আবারও সেই বুথে গেলাম। আমি রুপি উঠাতে পারলাম। একইসঙ্গে আমার ডেবিট হওয়া রুপি ফেরত চেয়ে ব্যাংকে একটা অভিযোগও দিলাম। হঠাৎই মনে হলো, এসব করে সময় নষ্ট করছি আসলে। অন্যদেরও বিরক্ত করছি। আমি এসব করতে আসিনি এখানে। ঘুরতে এসেছে। প্রকৃতি উপভোগ করতে এসেছি। হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলাম, এইরকম পরিস্থিতিতে আসলে কীভাবে মনটা খারাপ হয়ে যায়। মন কীভাবে ভালো করতে হয়, সেটাও শিখলাম। বুঝতে পেরে, খুশি লাগল।

সবকিছু করার পর আমি স্থানীয় ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থানগুলোতে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রথমেই হনুমান টক। আমরা প্রাইভেট ট্যাক্সি নিলাম আবার। পরিচয় হলো, ড্রাইভার তামাং শিং এর সঙ্গে। ধর্মীয়ভাবে তিনি বৌদ্ধ। তিনি জানালেন রাস্তার ধারে উড়তে থাকা বুদ্ধিস্ট ফ্ল্যাগগুলো সম্পর্কে। কী হয়, যখন একজন মারা যান? কীভাবে মৃত ব্যক্তিকে পোড়ানো হয়। তিনি জানালেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা ট্র্যাক সম্পর্কেও। তার সঙ্গে কথোপকথনগুলো মনে রাখার মতো। এই শহরটার গুরুত্ব তুলে ধরলেন তিনি। কীভাবে এটা বারবার নিগৃহীত হয়েছে ভারতীয় সরকার দ্বারা। হঠাৎই আমার মনে হলো, দর্শনীয় স্থান ঘোরার চেয়ে তার সঙ্গে গল্প করতেই বেশি আনন্দ। স্বস্তিদায়ক।

আমার হঠাৎ ফেলে আসা ড্রাইভার আকাশ, রবিনকে মনে পড়ল। গত দুদিনের ঘোরাঘুরির স্থানগুলো মনে পড়ল। আসলেই অনেককিছু জমেছে আমার মনে। স্মরণ করার মতো এ দুইদিনে। সবগুলো দর্শনীয় স্থান ঘোরার পর সঙ্গীদের হোটেল রুমে বিশ্রামে রেখে আমি শহরটা হেঁটে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভাবলাম, গ্যাংটকবাসীর দৈনন্দিন জীবন পর্যবেক্ষণ করব।

পাহাড়ি পথ বেয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই কানে হালকা রক ব্যান্ডের সাউন্ড শুনতে পেলাম যেন। অসম্ভব মিষ্টি। কাছে টানার মতো। আমি কিছুটা এগিয়ে গেলাম শব্দের উৎপত্তিস্থলের দিকে। আমি একটি বারে এসে পৌঁছলাম। ভেতরে ঢুকে দেখলাম, এটা কোনো ব্যান্ড নয়, বারে এক কাস্টমার গান গাইছে। কারাওকে। আমি কিছুক্ষণ বসলাম। গলা মেলালাম তাদের সঙ্গে। মন ভরে গেল। নতুন করে প্রেমে পড়লাম শহরটার। মনে হলো মায়ায় আচ্ছন্ন।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়