ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

আনতালইয়া এক প্রাচীন জনপদের হাতছানি: দ্বিতীয় পর্ব

ফাতিমা জাহান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪৬, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আনতালইয়া এক প্রাচীন জনপদের হাতছানি: দ্বিতীয় পর্ব

মওলানা জালালুদ্দিন রুমির সমাধি

‘যখন আমি তোমার সাথে থাকি,
তখন সবকিছুই প্রার্থনা।’
      - মওলানা জালালুদ্দিন রুমি  

কবে থেকে মওলানাকে পড়ছি মনে নেই। হয়তো-বা ১৬/১৭ বছর বয়স থেকে, যখন থেকে একটু একটু বোধের সাথে অবোধের পার্থক্য শিখতে শুরু করলাম তখন থেকে। আনতালইয়া শুধু নয়, তুরস্কে আসার আমার মূল উদ্দেশ্য হলো মওলানা জালালুদ্দিন রুমির সমাধিসৌধ দেখা। আজ আমার অনেক দিনের স্বপ্ন সফল হতে চলছে! আজ আমি মওলানাকে দেখতে যাচ্ছি। যাবার পথটা খুব সহজ নয় বা হয়তো-বা সহজই, উৎকণ্ঠায় আমি ভাবছি কঠিন। আনতালইয়া শহর থেকে ছয় ঘণ্টার পথ। বেশ অনেকটা দূরত্ব। মনে হয়েছিল দূর থেকেই মওলানার আরাধনা করা শ্রেয়। বেশি কাছে গেলে কোন গুস্তাখি আবার না হয়ে যায়! আবার মনে হয়েছে- না গেলে আমি কি গুনাহগার রয়ে যাব আজীবন?

কত আবেগ, ভালোলাগা হৃদয়ের পাতায় মুড়ে রেখেছি কত বছর ধরে শুধু মওলানাকে দেখব বলে। কতই না রাত-দিন ভেবেছি তাঁর লেখা কবিতা কীভাবে যাদুময় হয়ে উড়ে বেড়ায় আমার ঘরের আনাচে-কানাচে! বড্ড অদ্ভুত সেই সংযোগ।

মওলানার শহর কোনইয়া বা কোনিয়া। কাপাদোকিয়া থেকে যখন আনতালইয়া আসি তখন কোনিয়া হয়েই আসতে হয়েছিল। কী এক অজানা কারনে কোনিয়ায় নেমে যাইনি, কেন যে দেখা দেইনি জানা নেই।  প্রস্তুতি নিতে হবে অনেক সেটা মূখ্য ছিল।  

আনতালইয়া শহর থেকে কাকডাকা ভোরে বেরিয়ে পড়লাম মওলানা জালালুদ্দিন রুমির আস্তানার সন্ধানে। ট্রাম পথ পেরিয়ে বাস স্টেশন, সেখান থেকে টিকেট কেটে প্রাচীন শহর কোনিয়ার বাসে চড়ে বসলাম। ছয় ঘণ্টার পথ নির্বিঘ্নে কাটাবার জন্য বাসে কত ধরনের ব্যবস্থাই না করা আছে। চা, কফি, কুকিস, জুস ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন বা স্ক্রিনে ম্যুভি দেখা, গান শোনা বা বই পড়া। আমার মন পড়ে আছে মওলানার ডেরায়। এসবে তো মন ভোলে না।

মওলানার শহরে যাবার পথে রোড ডিভাইডারে রডোডেন্ড্রন গাছ ফুলের গোলাপী ভারে নুয়ে পড়েছে। খানিক পথ পেরোলেই সবুজ পাহাড়ের হাতছানি আর তার সামনে সবুজ সবজি ক্ষেতের বিপুল ভাণ্ডার। এ দেখেই তো এক জীবন পার করে দেয়া যায়। পথের দু'ধারে সারি সারি আপেল, কমলা, ডালিম বাগান। আর যে পথ মওলানার দিকে ধায় সে পথজুড়ে যে ফুল বাগানের ঝালর থাকবেই। রোড ডিভাইডার ছেয়ে আছে গোলাপী অথবা সাদা রডোডেন্ড্রনে। যেন স্বাগত জানাচ্ছে সকলকে যেভাবে মওলানা রুমি মানুষকে আশ্রয় দান করেছেন তাঁর কবিতায়, গানে, আধ্যাত্মিকতায়।

কোনিয়া শহরটি প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। এ রাজ্য শাসন করেছে ক্রমান্বয়ে ফ্রিজিয়ান, হিটিয়ান, হেলিনিস্টিক, রোমান, সেলজুক, অটোম্যান শাসকেরা। কোনিয়া শহরে পৌঁছাবার আগেই বাসচালক ও তাঁর সহকারী জানালেন- বাস থেকে নেমে আরেকটি মিনিবাস ধরে যেতে হবে মওলানার রওজা মোবারক দর্শনে। বাসের সুপারভাইজার সাহেব তো আমাকে বাস-স্টেশনের বাইরে মিনিবাস স্ট্যান্ড অবধি এগিয়ে দিলেন পথ চিনতে যাতে অসুবিধে না হয়। আধ ঘণ্টার মতো সময় লাগল জালালুদ্দিন রুমির ডেরায় পৌঁছাতে। আমার যেন তর সইছিল না।

তুরস্কে তেমন অসুবিধা হয় না পথেঘাটে চলতে। কারণ ইংরেজি অক্ষরে সবকিছু লেখা, কোথাও একটুও ঠেকে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। শহরে প্রাচীনকালের ছাপ প্রকট। পথে পথে ফারসি লেখা কবিতা দেয়ালে খোদিত। পথের দু'ধারে গোলাপ বাগান মাইলের পর মাইল শোভা বাড়ায়।

মওলানা রুমির সমাধিসৌধ দেখা যাচ্ছে বাউন্ডারি ওয়ালের বাইরে থেকে। বাইরে ভ্রমণার্থীদের ওযু করার জন্য বিশাল গোলাকার ওযুখানা। নারীপুরুষ পাশাপাশি যে যার মতো ওযু করে নিচ্ছেন পূণ্যস্থানে প্রবেশের পূর্বে। মওলানার আবাস পাথরের পাঁচিলে মোড়া। ঢুকতে হয় পেছনের দরজা দিয়ে। তাঁর সমাধিসৌধের দেয়ালের রং ধূসর আর গম্বুজ, মিনারাতের রং টারকোয়েয বা সমুদ্রাভ সবুজ।

মওলানা জালালুদ্দিন রুমির সমাধি    

মওলানার সামনে দিয়ে প্রবেশ করার ধৃষ্টতা কেনই-বা দেখাব! মওলানা যে ঘরটায় আছেন তার বাইরের প্রাঙ্গনে অনেকগুলো সমাধি, সাদা রঙের এপিটাফে লেখা তাঁদের হৃদয় গাঁথা। তাঁরা ঘুমোচ্ছেন লাল টকটকে গোলাপ বাগানে। অনিন্দ্য সুন্দর সমন্বয়! মওলানার আঙিনায় লাল, গোলাপী গোলাপ বাগান। পূণ্যবানেরা থাকেন তার মাঝে। এক পা, দু' পা করে প্রবেশ করলাম মওলানা জালালুদ্দিন রুমির রওজা মোবারকে। কী অসাধারণ কারুকাজ খচিত সে ভবনের ভেতরের দেয়াল আর ছাদের সূচারু নকশা! ভক্তগণ এসেছেন পৃথিবীর একেক প্রান্ত থেকে। প্রবেশ মুখে কয়েকজন ভক্তের সমাধি, ভারী মখমল কাপড়ের উপর সোনালি সুতোর কারুকাজ যেন আরো মহিমান্বিত করেছে পরিবেশ। ভক্তরা যে যার মতো দোয়া পড়ছেন প্রিয় পথ প্রদর্শকের রূহের মাগফিরাত কামনা করে। ভক্তদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম মওলানার সমাধির সামনে। বিশালের সামনে ক্ষুদ্রের অনুভূতি যেন!

মওলানা বলেছিলেন: ‘তোমার কাজ ভালোবাসা খুঁজে ফেরা নয়।/ তোমার কাজ তোমার ভেতরের দেয়ালের খোঁজ করা এবং ভাঙা যার জন্য ভালোবাসা তোমার কাছে আসতে পারে না।’

মওলানাকে ভালোবাসি। আমার সকল প্রশ্নের উত্তর তিনি দিয়ে গেছেন। আমার অন্য কারো কাছে যাবার প্রয়োজন হয় না। তাঁর রেখে যাওয়া দর্শন আমাকে ওড়ায়, ভাসায় কিন্তু বেঁধে রাখে না। মওলানা জড়িয়ে আছেন খয়েরি মখমলে। সেখানে ভারী সোনার কাজে লেখা তাঁর কবিতা, গজল। সেই মুহূর্তে আমার প্রিয় রং খয়েরি। মওলানার দেয়ালে লাল, নীল, সাদা, সোনালি হরফে লেখা পবিত্র কোরানের বাণী আর মওলানার কবিতা। সেগুলো শোভা পায় পারস্যধাঁচ নকশায়। সে দেয়ালে যে কারো প্রাণ আটকে যায়। মওলানার কাছেই ঘুমোচ্ছেন তাঁর বাবা, ভাই, পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা।

আমি কল্পনায় শুনি মওলানার বাজানো রুবাবের তালে তালে তাঁর গান সামা আর তাঁর বাঁশি, যেন ভূমধ্যসাগর ভেদ করে আমায় নিয়ে যায় সেই ঐন্দ্রজালিক পারাপারে যেখানে তিনি গাইছেন-

‘হৃদয় ভাঙতে থাকো,
যতক্ষণ অবধি তা না খোলে।’

মওলানা জালালুদ্দিন রুমির জন্ম ৩০ সেপ্টেম্বর ১২০৭ খ্রিস্টাব্দে, বালখ্ নামক স্থানে যা বর্তমানে আফগানিস্তানে বা মতান্তরে ওয়াখস্, তাজাকিস্তানে। তাঁর মাতৃভাষা ছিল ফারসি। বালখ সে সময়ে পারস্য আর সুফি সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র ছিল। পিতা বাহাউদ্দীন ওয়ালাদ ছিলেন বিচারক এবং সাধক। মা মুমিনা খাতুন। ১২১৫ সালের দিকে মঙ্গল রাজা মধ্য এশিয়া আক্রমণ করলে রুমির পিতা তাঁর পরিবার ও অনুসারীদের নিয়ে ইরান চলে যান। সেখানে রুমির পরিচয় হয় ফারসি কবি আত্তারের সাথে। আত্তার রুমির অন্তরাত্মাকে পড়ে ফেলেন। ভবিষ্যতে রুমির কবিতায় কবি আত্তারের প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায়। ইরান থেকে বাহাউদ্দীন ওয়ালাদ এরপর হিযরত করেন বাগদাদে। বাগদাদ থেকে মক্কা। এই কাফেলা সাত বছর দামেস্ক, মালাতিয়া, সিভাস, কায়সারি পার হয়ে থিতু হয় কারামান নামক স্থানে। কারামানে রুমি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন গওহর খাতুনের সাথে ১২২৫ সালে।

বাহাউদ্দীন ছিলেন মাদ্রাসা প্রধান। তাঁর মৃত্যুর পর রুমি মাত্র ২৫ বছর বয়সে মাদ্রাসা প্রধানের দায়িত্বে নিয়োজিত হন। টানা ৯ বছর বাবার কাছ থেকে সুফিবাদের দীক্ষা নিয়েছিলেন। এবং বাবার মৃত্যুর পর তাঁর সামাজিক যোগাযোগের ব্যপ্তি বাড়ে। তিনি একাধারে কোনিয়া শহরের বিচারক ও মসজিদের ফতোয়া বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মওলানা শব্দের অর্থ পথপ্রদর্শক বা শিক্ষক। রুমি তখন থেকেই মওলানা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। ১২৪৪ সালে দামেস্কে মওলানা রুমির পরিচয় হয় দরবেশ শামস-এ তাবরিজির সাথে। সে সাক্ষাৎ রুমির জীবনকে আমূল পালটে দেয়। রুমির পরিচয় তখন সাধক হিসেবে ভক্তদের মাঝে।

রুমি ক্রমাগত গজল আর কবিতা লিখতে থাকলে তা লিপিবদ্ধ হয় ‘দিওয়ান শামস এ তাবরিজি’ গ্রন্থে। তিনি ইসলামিক দার্শনিক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন এবং ইসলাম ছিল তাঁর আরাধনা। তাঁর ছাত্ররা ধর্মগ্রন্থের সাথে সাথে তাঁর লেখা দর্শন পড়তেন। তিনি মানুষে মানুষে বন্ধনে বিশ্বাসী ছিলেন, জাতি, ধর্ম, গোত্র ভেদ করে। মানুষের ভালোবাসার খোঁজ ছিল চিরকালের। তাঁর কবিতা আত্মার মুখোমুখি করে, অহঙ্কার ত্যাগী হতে শেখায়, ভালোবাসা শেখায় যা শুধু ভালোবাসাতেই বেড়ে ওঠে। তাঁর গভীর আধ্যাত্মিক দৃষ্টি মানব চরিত্রের ক্ষুদ্রতা, দৈন্য ছাপিয়ে আরো বিস্তৃত হতে শেখায়। তিনি লিখেছেন-

মওলানা জালালুদ্দিন রুমির সমাধি    

‘এসো, এসো
তুমি যেই হও না কেন,
ভবঘুরে, মূর্তিপূজারি, অগ্নি উপাসক,
তবুও এসো, যদি তুমি হাজারবার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে থাকো।
এসো, বারবার এসো।
আমাদের এ কাফেলা হতাশার নয়।’   

রুমির প্রিয় বাদ্যযন্ত্র ছিল রুবাব আর বাঁশি। এই বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে 'সামা' গাইতে গাইতে তিনি চলে যেতেন আধ্যাত্মিক জগতে। তাঁর কবিতা, গজল সবচেয়ে বেশি পঠিত হয়েছে ইরান, তুরস্ক, দক্ষিণ এশিয়া, আমেরিকা, আজারবাইজান ইত্যাদি দেশে।

ঘূর্ণায়মান দরবেশ নাচের ধারণা মওলানা রুমি প্রথম প্রচলন করেছিলেন। দু’ চোখ বন্ধ করে, মাথা খানিকটা আকাশের দিকে মেলে ধরে, দু’ হাত বুকের কাছাকাছি রেখে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে এক স্থানে ঘুরে ঘুরে পরিবেশিত হয় এ নৃত্য আরাধনা। মওলানা রুমি আমাদের ছেড়ে চলে যান ১৭ ডিসেম্বর,  ১২৭৩ খ্রিস্টাব্দে। তাঁকে সমাহিত করা হয় তুরস্কের কোনিয়া শহরে যেখানে তিনি কাটিয়েছেন জীবনের বেশিরভাগ সময়।

তাঁর সমাধির পাশেই রয়েছে তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মিউজিয়াম। (চলবে)


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়