ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

রাতের রাংপো পেরিয়ে গ্যাংটকের পথে

সিয়াম সারোয়ার জামিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৬, ২৫ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রাতের রাংপো পেরিয়ে গ্যাংটকের পথে

সকালবেলা চারদিক সুনসান। খুব ঠান্ডা! চারপাশে কুয়াশা- মেঘের মিলন। হাত দুটো জ্যাকেটের পকেটে ঢোকানো। তবু অলিগলি দিয়ে পকেটে ঢুকছে বাতাসের শেল। বিধছে চামড়ায়। নিজেকে উষ্ণ রাখতে একটা হট চকলেট অর্ডার করলাম। এলোও দ্রুত। চকলেট খেতে খেতে ক্যাফে থেকে দৃশ্যটা খুব চমৎকার লাগল!

পুরো এলাকা পাহাড় ঘেরা। তার মাঝে সবুজ আর সবুজ। পাহাড়ের থরে থরে ঘরবাড়ি। ঝরনা। যেন পটে আঁকা ছবি- দুর্দান্ত! ছবি তুলছিলাম। পেছনে বাজছিল এ আর রহমানের কম্পোজ করা দারুণ সব গান। কিছুক্ষণ পরে মেঘ যখন পরিষ্কার হয়ে গেল, আমি পাহাড়ের ওপর দিয়ে তাকালাম। এতদূর থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের চূড়া বরফ আচ্ছাদিত। অনেকটা সম্রাটের মুকুট যেন। সূর্য রশ্মির কারণে আরো ঝলকে উঠেছে। সে এক দম বন্ধ করা বিস্ময়কর ছবি! আমি ফ্রেম বন্দি করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না। বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে চেষ্টা করলাম। ক্যামেরায় জুম ইন, জুম আউট করলাম। শাটার স্পিড, এপার্চার পরিবর্তন করলাম। কিন্তু ছবি তুলে কোনোভাবেই সন্তুষ্ট হতে পারছি না। ঠিক তখনই আমি বুঝলাম, কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য ক্যামেরায় ধারণ করা সম্ভব না। চোখে দেখেও সাধ যেখানে মিটছে না সেখানে ক্যামেরার চোখে দেখায় আর কত তৃপ্তি মিটবে।

৩০-৪০ মিনিট মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। বুকের মধ্যে কেউ যেন একটা স্বস্তির পরশ বুলিয়ে গেল। আমার হৃদযন্ত্র যেন পূর্ণ হয়েছে খুশিতে, কানায় কানায়। আমি বুঝলাম, অচেনা অজানা মানুষের মাঝে আমি শান্তি খুঁজে পেয়েছি। এর শেষ কোথায় জানি না।

দার্জিলিং এবং সিকিম ভ্রমণ বাকেট লিস্টের শুরুতেই ছিল। কিন্তু নানা কারণে ব্যাটেবলে মিলছিল না। এবারের পরিকল্পনা একেবারে 'না' থেকে হঠাৎ করেই 'হ্যাঁ' হয়ে গিয়েছিল। কারণ প্রমথেশদা। তিনি রাজি হচ্ছিলেন না। তার স্ত্রী অস্ট্রেলিয়া থাকেন। কিছুদিন পরেই দেশে ফেরার কথা। তাকে নিয়ে আরেক টুরে যাওয়ার কথা তার। এর মধ্যে এরকম শর্ট টুর দিবেন কিনা- সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন। তারপর হঠাৎ 'হ্যাঁ' বলে ফেললেন। ব্যাগপ্যাক করাই ছিল। দ্রুত করলাম টিকিট বুক। রাতে সোজা স্টেশন। ভিসাও করা ছিল। কিন্তু যাচ্ছিলাম খুবই অপরিকল্পিতভাবে। অফিস শেষ করে ট্রেনটা ঠিকমতো ধরতে পারব কিনা, সংশয়ে ছিলাম।

তবে আমি স্টেশনে আগে পৌঁছালেও জ্যামে আটকে পড়েছিল দাদা। টেনশনে সব গুলিয়ে ফেলছিলাম। এয়ারপোর্ট স্টেশন থেকে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ হুঁইসেলের শব্দ শুনলাম। শব্দটার উৎসের দিকে তাকিয়ে রইলাম। খানিকটা এগিয়েও গেলাম। বিশৃঙ্খল এক পরিস্থিতি। সবাই হুড়োহুড়ি করছে ট্রেনে ওঠার জন্য। অথচ আমি স্থির। দাদা কই? উঠব কি উঠব না? অবিশ্বাস্য এক গল্প যেন। হঠাৎ দাদা এসে আমাকে গুতোলেন- ওই ব্যাটা, এদিকে আয়। দৌড় দে। যাবি না?

হ্যাচকা টানে আমার হাত ধরে দিলেন দৌড়। আমিও যেন সম্বিত ফিরে পেলাম। দাদার পেছন পেছন দিলাম দৌড়। ঠেলেঠুলে উঠে পড়লাম ট্রেনে। খুঁজে খুঁজে বসে পড়লাম নিজেদের সিটে। বাঁ দিকে। জানালার পাশে বসলাম আমি। পাশে দাদা। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম!

ঢাকা থেকে পঞ্চগড় যেতে এগারো ঘণ্টা লাগল। ৬৩৯ কিলোমিটার রেলপথ। এর মধ্যে সম্ভবত ১০টা জেলা পার হয়েছি। প্রতি স্টেশনে যেন সবকিছু আলাদা। অন্যরকম ভালোবাসা। অন্যরকম অনুভূতি। একদল নতুন মানুষ। নতুন ভ্রমণসঙ্গী। কিছুটা ঘুমিয়েছি। রাতের আঁধার ভেদ করে জানালায় চোখ রেখেছিলাম পুরোটা সময়। দৃশ্য বদলেছে প্রতিনিয়ত। ধানক্ষেত, নদী, ছোট ছোট সবুজ গ্রাম পেরিয়ে ভোর সাতটার দিকে দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটা স্লো হয়ে গেল। চোখে পড়ল ইটের দালান। রিকশা। মানুষ। বুঝলাম- পঞ্চগড় পৌঁছে গেছি। দাদা গুতোলেন, নামবি না? পঞ্চগড় এসে গেছি তো।

আমি কিছুটা বিব্রত। দাদা বারবার আমাকে তাগাদা দিচ্ছেন। অথচ নিজেই ট্রেনটা মিস করছিলেন আরেকটু হলে।

এবারও আমাকে গুতো দিয়ে দৌড় দিলেন। আমি একটু পিছিয়ে পড়ছিলাম যেন। পঞ্চগড় স্টেশনে পা দিয়ে সৌন্দর্যটা চোখে পড়ল। সবাই দৌড়ঝাপ করছে। আমি বের হবার দরজা খুঁজছিলাম। অবশেষে পেলাম। দেখি, স্থানীয় দুই সাংবাদিক বড় ভাই। টুটুল ভাই আর রনি শীলদা গেটেই দাঁড়িয়ে আছেন। বুকে জড়িয়ে ধরলেন। রনিদা বললেন, একটুও দেরি করব না, চলুন যাই। গাড়ি বাইরেই দাঁড়ানো ছিল। ব্যাগেজ নিয়ে উঠে পড়লাম সবাই। টুটুল ভাইয়ের বাসা থেকে আনা খাবার গাড়িতেই খেয়ে ফেললাম। জিজ্ঞেস করলাম, ভাবি আপনাকে একা ছেড়ে দিল? রান্নাও করে দিল? টুটুল ভাই স্মিত হেসে বললেন, তা কী আর ছাড়ে?

তাহলে মুক্তি পেলেন কীভাবে? ফোড়ন কাটলাম আমি। যখন বললাম, এই টুরে মেয়ে যাচ্ছে না। সবাই ব্যাচেলর। এই টুরে যেতে দাও। দেখেশুনে আসি। পরেরবার তোমাকে নিয়ে যাব। তখন ছেড়ে দিয়েছে। কসম কেটে এসেছি। পরেরবার ওকে নিতেই হবে।

গাড়ির মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। শহর থেকে যত বের হয়ে যাচ্ছি, তত সৌন্দর্য দেখতে পাচ্ছি। আমি শুধু বাইরের দৃশ্য দেখছিলাম। ক্রমশ সীমান্ত এগিয়ে আসছিল। অল্পক্ষণেই বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশনে পৌঁছে গেলাম। ইমিগ্রেশনে ঢুকতেই পুলিশ কর্মকর্তা এগিয়ে এসে বসতে দিলেন। হাত মেলালেন। টুটুল ভাই সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। দ্রুত ইমিগ্রেশনও শেষ হয়ে গেল। অল্পক্ষণেই পৌঁছে গেলাম ভারতীয় অংশে- ফুলবাড়ি সীমান্তে। ওপারে সীমান্তের চেক ঝক্কিঝামেলা ছাড়াই শেষ হলো। দ্রুত মানি এক্সচেঞ্জে নোট বদলে নিলাম।

আগে থেকেই জেনে গিয়েছিলাম, সিকিম যেতে শিলিগুড়ি থেকে অনুমতি নিতে হবে। সিকিম ট্রান্সপোর্ট অথরিটির অফিস পানির ট্যাংকিতেই। সেখানেই পার্কিং করা সিকিম সরকারের ট্যুরিস্ট বাস। অভ্যর্থনা কক্ষও সেখানে। বলতেই দ্রুত ফরম দিলেন সিকিম সরকারের এক নারী কর্মকর্তা। ফরম ফিলাপ করে সবার পাসপোর্ট একসঙ্গেই এগিয়ে দিলাম। তারা একটি বিশেষ অনুমতিপত্রে পাসপোর্ট নম্বর ও নাম লিখে সই, শীল দিয়ে ফেরত দিলেন। বুঝিয়ে দিলেন, এই অনুমতিপত্র কোথায় দেখাতে হবে। কীভাবে যেতে হবে। 

এদিকে বেজে গেছে প্রায় তিনটা। চারটা পর্যন্ত বাস থাকে। আমরা বাসে না গিয়ে নিজেদের সুবিধার জন্য জিপ নিলাম। পরিচয় হলো ড্রাইভার আকাশ থাপার সঙ্গে। সুদর্শন বডি বিল্ডার ছেলেটার বাড়ি গ্যাংটকে। এই রুটে নিয়মিত জিপ চালায়।

ভাড়া চুকিয়ে উঠে পড়লাম। তার আগে খেয়ে নিলাম স্থানীয় রেস্টুরেন্টে। ব্যাগ-ব্যাগেজ গুছিয়ে ছুটলাম গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে। ড্রাইভারের কাছে জেনে নিলাম, মাঝে রাংপো চেকপোস্টে নামতে হবে। চেক শেষে সন্ধ্যা নাগাদ পৌছে যাব গ্যাংটক। স্বর্গীয় গ্যাংটক।

দুই ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে গেলাম রাংপো। রাংপোতে ঢোকার আগেই ঠান্ডার ঝাপটা লাগল চোখে মুখে। বদলে গেল আবহাওয়া। এটা ছিল সাড়ে চার ঘণ্টার জার্নি। পাহাড়ি দৃশ্য একইরকম ছিল। শুরুতে পাহাড়। তারপর বন। তারপর তিস্তার সৌন্দর্য দেখতে পেলাম। সিকিমের এই তিস্তা নদী পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। যখন আমি অনেক ছোট ছিলাম। আমার শিক্ষকরা বলতেন, এমন একটা নদীর ছবি আঁকো, যার পানি নীল। বাস্তবে এরকম নদী আমি দেখিনি, যেমনটা আমি এঁকেছিলাম। তিস্তা দেখার পর বুঝলাম, আমার শিক্ষক ভুল ছিলেন না। 

সিকিম রাজ্যে ঢুকছিলাম। রাতে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছিল। যেন সৃষ্টিকর্তা পাহাড়ঘেরা এলাকাটি অনেক সুন্দর আলো দিয়ে ভরে দিয়েছেন। যখন পৌঁছলাম তখন আঁধার নেমে এসেছে অনেকটা। সিকিমিজ ড্রাইভার আকাশ থাপা পথ দেখিয়ে দিলেন। আমি লোকাল টুরিস্ট সেন্টার কার্যালয়ে পৌঁছে গেলাম।

তখন প্রায় সাতটা। ট্যাক্সি ড্রাইভার প্রদীপ আমাকে নামিয়ে দিলেন এক কোনে। বললেন এগিয়ে যেতে। সোজা গেলেই অফিস। রনিদা আর টুটুল ভাই সেখানে গিয়ে পাসপোর্ট আর অনুমতিপত্র নিয়ে গেলেন ভেতরে। হাস্যোজ্জ্বল সিকিমিজ কর্মকর্তা দ্রুত সবকিছু দেখে পাসপোর্টে সিল মেরে ছেড়ে দিলেন। বেরিয়ে এলাম দ্রুত। নেমেই রাংপোর সৌন্দর্য চোখে পড়ল। রাতের এই সময়টাতে রাংপোকে অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছিল। আশপাশটা বেশ পরিচ্ছন্ন। খাবার ও মদের দোকানগুলো খোলা। রেস্টুরেন্টেও চলছে বেচাকেনা। রাস্তাঘাটে বেঞ্চ পেতে রাখা, যাতে টুরিস্টরা বসতে পারে। ঠিকঠাকভাবে গাড়িগুলো পার্ক করা। রাস্তা পুরোটাই পরিচ্ছন্ন। অনিয়ম নেই এতটুকু।

রাতের আঁধারে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে ফের ছুটল আমাদের জিপ। হঠাৎ এতো দুর্দান্ত ভ্রমণের পরও কিছু একটা করতে মন চাইছিল। হিন্দি আর নেপালি গানের তালে তালে মনে হলো আরও কিছু দরকার। তখন আমি আমার সঙ্গীদের সঙ্গে আড্ডায় মত্ত হতে চাইলাম। যাত্রাপথে নেমে তিনবার খেয়েছি। রাস্তায় ভাত পাওয়া না গেলেও ফল, কফি, চা পাওয়া যায়। জুস পাওয়া যায়। সেসবই খেলাম আমরা। নিলাম কিছু চিপস। রাস্তায় কোথাও প্যাকেট ফেলিনি। রেখে দিয়েছিলাম। ড্রাইভার আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন। গ্যাংটকে ময়লা নির্দিষ্ট জায়গাতেই ফেলতে হয়। নইলে গুনতে হয় জরিমানা। দুই ঘণ্টা পর পৌঁছে গেলাম যখন। তখন গ্যাংটকের আকাশজুড়ে বৃষ্টি। যে হোটেলে ছিলাম, তার মালিক সিকিম সরকারের মন্ত্রী।

আকাশ থাপা হোটেলের এক কোনে আমাদের নামিয়ে দিলেন। আমি পায়ে হেঁটেই এগিয়ে গেলাম। এর মধ্যেই বুঝে গেছি গ্যাংটকের কনকনে ঠান্ডা সম্পর্কে। শীতের শেল গায়ে বিধছিল যেন। একপাশে সুসজ্জিত গেটে রিসেপশনে মান্নুদা আমাদের অভ্যার্থনা জানালেন।

গাড়ি থেকে নামার সময় ড্রাইভার আকাশ শুধু বললেন, দাদা, গ্যাংটকের বাতাসটা খুব সুন্দর। কান পাতলে আপনি দারুণ সব কণ্ঠ শুনবেন। শুধু আপনার হৃদয়টা খোলা রাখবেন। আমি স্মিত হাসি দিলাম। সত্যিই কি তাই? আপন মনেই হেসে উঠলাম আবার।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়