ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

আপনার অপেক্ষায় আছে ভাষা জাদুঘর

খালেদ সাইফুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আপনার অপেক্ষায় আছে ভাষা জাদুঘর

ঢাকার সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। মূল ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে উঁচু সিঁড়ি। সিঁড়ি উঠে গেছে ভাষা জাদুঘরে। কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায় সারি সারি বোর্ড। সেখানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রভাষা, প্রচলিত বিভিন্ন ভাষা, সেসব ভাষার নমুনা প্রভৃতি নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ডানদিকে তাকালে চোখে পড়ে কতগুলো প্রাচীন লিপির নিদর্শন। এর মধ্যে সর্বপ্রাচীন লিপিতে দেখা যায় একটি বাইসনের চিত্র। এটি প্রায় ১২ হাজার বছর পূর্বে আলতামিরায় প্রাপ্ত একটি গুহাচিত্র। মনে করা হয়, লেখা উৎপত্তির শুরুর দিকে মানুষ চিত্র এঁকেই তথ্য আদান-প্রদান করত। পাশাপাশি শোভা পাচ্ছে, ৩ হাজার বছর পূর্বের মিশরীয় হায়ারোগ্লিফ বা গুহাচিত্র, খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীর ব্রাহ্মীলিপি এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীর অশোকের খরোষ্টি লিপি। এ দুটিকেই ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম লিপি মনে করা হয়।

আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতেই বোঝা গেল ভেতরে কেউ নেই। সুনসান নীরবতা এ মুহূর্তে একমাত্র সঙ্গী। বাইরে চলছে মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে নানা সংস্কারকাজ। সবাই ব্যস্ত। নেই কোনো দর্শনার্থী। কিছুটা নিঃসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঠাঁই পাওয়া বিভিন্ন ভাষার নিদর্শন।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সাতটি দেশের ভাষার বিবরণ এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে। এসব ভাষার বিবর্তন, ক্রমবিকাশ, নমুনা এবং ভাষাভাষী জনগণের সংখ্যা প্রভৃতির সঙ্গে ওইসব দেশের সংস্কৃতিরও খণ্ডচিত্র বোর্ডে শোভা পাচ্ছে। বাংলা লিপির উৎপত্তি ও বিবর্তন, বাংলা স্বরচিহ্নের বিবর্তন প্রভৃতি স্থান পেয়েছে আলাদা বোর্ডে। এশিয়া, মধ্য এশিয়া ও মধ্য প্রাচ্যের ভাষার তালিকা প্রদর্শিত হয়েছে আলাদাভাবে। এখানে প্রদর্শিত বিভিন্ন ছবি ও তথ্যচিত্রে চোখ বুলালেই বাংলা ভাষা ও পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যায়।

জাদুঘরে রয়েছে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সুবিধাসম্পন্ন দুটি কম্পিউটার। মাথায় হেড মাউন্টেড ডিসপ্লে ও হাতে ডেটা গ্লোভ পরিধান করে এ প্রযুক্তির মাধ্যমে কম্পিউটারের সামনে বসেই বাস্তবের ন্যায় সম্পূর্ণ জাদুঘরটি ঘুরে দেখা যায়। এছাড়াও জাদুঘরে রয়েছে ১০টি কিঅক্স বক্স। এ বক্সের মাধ্যমে স্ক্রিনে টাচ করেই বিভিন্ন দেশের ভাষা সম্পর্কে আদ্যোপান্ত জানা যাবে। তবে এ বক্সগুলোর একটিও এখনো চালু হয়নি বলে জানান জাদুঘরের সহকারী কিউরেটর সুমনা রায়। তিনি বলেন, ‘কয়েকমাস আগে এগুলো আনা হয়েছে। এখনো সফটওয়্যার ইনস্টল করে এগুলো ব্যবহার উপযোগী করা হয়নি। কিছুদিনের মধ্যে এগুলো ব্যবহারের জন্য প্রস্তত করা হবে।’

জাদুঘরের প্রদর্শনী বোর্ডে স্থান পেয়েছে ভাষা শহীদদের ছবি ও পরিচয়। এছাড়াও সেখানে দেখা যায় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত ভাষা আন্দোলনের খবর। বিভিন্ন সময়ে মাতৃভাষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সভা-সেমিনার, প্রতিযোগিতার ডকুমেন্টও সেখানে জায়গা পেয়েছে।

তবে জাদুঘরের দর্শনার্থীর সংখ্যা খুবই কম। সেখানকার রেজিস্ট্রার বইতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে ধীরে ধীরে দর্শনার্থী সংখ্যা বাড়লেও অগ্রগতি খুব বেশি নেই। কোনোদিন একজন আবার কোনোদিন দুই-তিনজন দর্শনার্থীর দেখা মেলে। আবার একাধারে কয়েকদিন কোনো দর্শনার্থী আসেনি এমনটিও দেখা যায় রেজিস্ট্রার বইতে। আগত দর্শনার্থীর মধ্যে শিক্ষার্থী, গবেষকের সংখ্যাই বেশি বলে জানান সহকারী কিউরেটর।

২০১৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জাদুঘরে আসা দর্শনার্থী মো. একরামুল হক মন্তব্যে লিখেছেন, ‘অত্যন্ত চমৎকার। প্রচারণা কম হওয়ায় শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ জানতে পারছে না। একটি গবেষণা সেল থাকা দরকার। প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নসহ এর প্রচার, প্রসার কামনা করছি।’ ২০১৯ সালে জাদুঘরে আসেন মনিরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তিনি লিখেছেন, ‘সুন্দর ও সংগঠিত সংগ্রহশালা। আরো বড় ও বেশি সংগ্রহ থাকতে পারত। বিশেষ করে এ দেশের ক্ষুদ্রভাষা গোষ্ঠীর ভাষা সম্পর্কে থাকা উচিত ছিল।’

জাদুঘর ছাড়াও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে রয়েছে একটি লিখন-বিধি আর্কাইভ। ষষ্ঠ তলায় আর্কাইভে প্রদর্শিত হয়েছে পৃথিবীর প্রায় ১৪০টি লিপি। এসব লিপি থেকে বাংলা ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষার লিখন পদ্ধতির নানা পরিবর্তন এবং এগুলো থেকে ভিন্ন ভিন্ন লিখন পদ্ধতি সৃষ্টি হওয়ার বাস্তব চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। এখানে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার হস্তলিখন চিত্র।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক জিনাত ইমতিয়াজ আলী বলেন, ‘জাদুঘরটি ধীরে ধীরে আরো উন্নত করার চেষ্টা চলছে। মাঠ পর্যায়ের গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল ভাষার নিদর্শন সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার দুষ্প্রাপ্য নিদর্শনগুলো এখানে আছে। স্কুল কলেজগুলোতে চিঠি দেওয়া হয়েছে, যেন তারা শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে এখানে ঘুরতে আসেন।’

জাদুঘরটি শুক্র ও শনিবার এবং সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত সপ্তাহে ৫দিন দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কোনো প্রকার প্রবেশ টিকিট ছাড়াই দর্শনার্থীরা প্রবেশ করতে পারবেন।


ঢাকা/শান্ত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়