ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

চায়ের রাজ্যে জাপানি মন্দির, নারী এবং টয় ট্রেন

সিয়াম সারোয়ার জামিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৪, ২২ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চায়ের রাজ্যে জাপানি মন্দির, নারী এবং টয় ট্রেন

গ্যাংটকে মান্নুদা বলেছিলেন, ‘টুরিস্ট হিসেবে নয় বরং ট্রাভেলার হিসেবে ঘুরবে। তাতে জীবনবোধ বুঝবে। প্রকৃতিকে জানবে। মন-প্রাণ পূর্ণ হবে।’

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘বুঝিনি। বুঝিয়ে বলুন। দুটোর মধ্যে পার্থক্য কী?’

দাদা হেসেছিলেন। বলেছিলেন, ‘যখন যে এলাকায় যাও, অবশ্যই স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মিশবে। কথা বলবে। তাদের গল্প শুনবে। তোমার গল্পও ভাগ করবে তাদের সঙ্গে। তারপর যখন সেখান থেকে ফিরবে, অবশ্যই একগুচ্ছ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরবে।’

সেই মুহূর্তে আমি ভ্রমণ জীবনকে নতুনভাবে অনুভব করলাম। মানুষকে জানা-চেনার ইচ্ছে হলো। আসলেই তো। নতুন মানুষের সঙ্গে নতুন এলাকায় বন্ধুত্ব যদি না-ই হলো, তাহলে ঘুরতে এসে কী লাভ? কী সঞ্চয় করে নিয়ে যাব? মনে দাগ কাটা গল্পই যদি না তৈরি হলো, ভালোবাসার মানুষই যদি না হলো, কেমন ট্যুর হলো? কী অজর্ন হলো?
 


গ্যাংটক থেকে দার্জেলিং আসার পুরোটা পথ এই ব্যাপারটি চিন্তা করেছি বারবার। যখনই যেখানে থেমেছি। কথা বলেছি। চায়ের দোকানির সঙ্গে, রেস্টুরেন্ট মালিকের সঙ্গে, স্থানীয়দের সঙ্গে। ড্রাইভারের সঙ্গে তো করেছিই। গতকাল দার্জেলিং এসেছি। এখন পর্যন্ত সেটাই করছি। মানুষের সঙ্গে মিশছি। টয় ট্রেন ভ্রমণের উত্তেজনাতেও সেটা মাথায় রেখেছি।

দার্জেলিং থেকে ঘুম স্টেশন পর্যন্ত টয় ট্রেনের টিকিট কেটে ফেলেছি। বিকেল চারটায় ছাড়বে সেটা। তার আগ পর্যন্ত আমরা দার্জেলিং শহর ঘুরে দেখছি। মল রোডে গোল্ডেন টিপসের টি বার থেকে বের হয়ে চা-বাগান দেখতে বের হলাম। ট্যাক্সি নেয়ার চেয়ে পায়ে হেটে চা-বাগান ঘোরাটাই শ্রেয় মনে করলাম। যদিও টুটুল ভাই আঁতকে উঠলেন! আশ্বস্ত করলাম, হাঁটুন। আপনার উঁচু পেট কমে যাবে। ভাবি ভীষণ খুশি হবে। আমার জবাব শুনে প্রমথেশদা, রনিদা হাসলেন। টুটুল ভাই ভেংচি কাটলেন।

হাঁটলে আমি এক ধরনের স্বাধীনতা অনুভব করি। যেখানে সেখানে দাঁড়াতে পারি। অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে পরি। এগিয়েও যেতে পারি। দার্জেলিঙের ভেতরের সৌন্দর্য খুব ঈর্ষণীয়। এখানকার মানুষের সরলতা, হাসি, আতিথেয়তা সবই তাদের চোখে দৃশ্যমান।
 


কিছুক্ষণ হেঁটে সবাই হ্যাপি ভ্যালে টি এস্টেটে পৌঁছে গেলাম। ৬ হাজার ৮০০ ফুট উচ্চতায় পুরোটা ৪৩৭ একর। এটা দার্জেলিঙের দ্বিতীয় বৃহত্তম চা বাগান। বিশ্বের অন্যতম বড় চা কারখানা। রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো কারখানাটা। এক ঘণ্টার বেশি সময় সেখানে থাকলাম। জ্ঞান বাড়ালাম, কীভাবে চা পাতা থেকে চা হয়। কীভাবে সম্পন্ন হয় সব কিছু। কারখানার স্টাফরা জানালেন। মনকাড়া সবুজ চায়ের রাজ্য দেখতেই মনে পড়লো দার্জেলিং ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় কিছু জাপানিজ মন্দির ভ্রমণের পরিকল্পনাও করেছিলাম। আমি ভাবলাম, ট্যাক্সি হায়ার করে নিই ঘোরাঘুরির জন্য। এতে হয়তো আরাম হবে। কিন্তু স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম। জানলাম, জাপানিজ মন্দির খুবই সুনসান আর শব্দহীন এলাকা। হেঁটে সেখানে যাওয়াটা আরও দারুণ।

বলা যেতে পারে, হেঁটে যাওয়া পথটা এটা আমার জীবনের সুন্দরতম সময়। ফলিয়েজ রোড ধরে এগিয়ে গেলাম আমরা। এই রাস্তা এতো দারুণ, পুরো এলাকার সবুজ আর সৌন্দর্য এক মিনিটেই দেখা ফেলা যায়। এখানে গাড়ির কোনো হর্ন, নেই, ভিক্ষুকের হাহাকার নেই, কোনো অশান্তি নেই, শুধু শান্তি আর নীরবতা। নীরবতার শব্দ শুনতে শুনতে আমরা পৌঁছে গেলাম মন্দিরে।

শান্তভাবে আমরা মন্দিরে ঢুকে পড়লাম। এক নারীর শব্দ শোনা গেলো। কণ্ঠ এতো দারুণ যে ক্রমশই তার কাছে ডাকলো যেন। আমরা হলে প্রবেশ করলাম। যার এক কোণে বসে আছেন সেই নারী। সেখানে মৃদু শব্দে ড্রাম পেটাচ্ছেন তিনি। প্রমথেশ আর রনি- প্রার্থনা করতে বসে পড়লেন। মন্ত্র জপলেন। আমি আর টুটুলদাও পেছনে বসে পড়লাম। চোখ বন্ধ করলাম। এক ধরনের অদ্ভুত প্রশান্তি এলো মনে। নিজেকে স্নিগ্ধ, ঈশ্বরের ভালোবাসায় সিক্ত আর নিষ্পাপ মনে হলো। বের হয়ে এলাম দ্রুত। স্টেশনের দিকে দৌড় দিলাম। দেরি হয়ে গেছে। বিকেল চারটায় ট্রেন।
 


দার্জেলিং হিমালয় রেলওয়ের টয় ট্রেনে ভ্রমণ আমার কাছে অনেকটাই বাকেট লিস্টের মতো। দারুণ আর মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা বলা যায়। ভীষণ স্মরণীয় এই ট্রেনটি ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের মর্যাদাও পেয়েছে। ঝিক্‌ঝিক্‌ শব্দ করে টয় ট্রেনটা চলতে শুরু করলো। হেলে ঢুলে চলছে। কেমন একটা স্বস্তি লাগছে। ট্রেনটা পাহাড় ফুঁড়ে উঠে যাচ্ছে উপরে! আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। পাইন গাছের সারি। ঠান্ডা একটা বাতাস গায়ে লাগলো। উপরে উঠছি। আরও ঠান্ডা বাড়তে লাগলো। ইঞ্জিনের শব্দ, শিশুদের উল্লাস, জানালার পাশের সিট, বাঁকানো পথ, সম্মোহিত হবার মতো দৃশ্য আমার মনকে শুদ্ধ করে দিলো যেন। ট্রেনটি ভারতের উচ্চতম রেলওয়ে স্টেশন ‘ঘুম’- এ নিয়ে এলো। সেখানে দারুণ কিছু সময় পার করলাম। ঘুম মনেস্ট্রিতে থাকলাম কিছুক্ষণ। তারপর আবার দার্জেলিং ফেরত।

রাতে খেয়ে এসে রুমে ঢুকে সবার মন খারাপ মনে হলো। দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম। কাল ভোরে চলে যেতে হবে শিলিগুড়ির পথে। অস্বস্তিকর ভাঙা ভাঙা ঘুম হলো কয়েকবার। খুব সকালে, ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে সন্দিহান হয়ে পড়লাম, উঠবো নাকি উঠবো না। দেখলাম, সবাই ঘুমুচ্ছে। নিজেকে ঠেলেঠুলে ঘর থেকে বের হলাম। ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। বেশ ঠাণ্ডা। কিছুদূর হেঁটে ফের রুমে এলাম। বুঝলাম, মনটা আসলেই খারাপ। ফেরার পথেই হোম স্টের কাছে পাহাড়ের ওপর থেকে দারুণ মনে হলো শহরটাকে।

ঘড়ির দিকে তাকালাম। দার্জেলিংকে বিদায় বলার সময় হয়ে গেছে, একইসঙ্গে এই সফরকেও। দার্জেলিং আমার কাছে খুবই স্পেশাল। আমি এতক্ষণে মান্নুদার কথা বুঝলাম। আমার মন এখনও দার্জেলিং ছাড়ার জন্য প্রস্তুত না। কিন্তু আমার কর্মক্ষেত্র, আমার দেশ, আমার পরিবার আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ফিরতেই হবে।

এই সময়টা আমার কাছে খুব অদ্ভুত লাগছিল। এমন একটা জায়গায় নিয়ে এসেছিল যেন, আমি এক গোলকধাঁধার মধ্যে। এখান থেকে শুধু অভিজ্ঞতাটাই নিতে পারবো। এই সৌন্দর্য, এখানকার মানুষ, এখানকার শান্তি, এখানকার স্বস্তি সব থেকে যাবে। যেমনটা রেখে এসেছি সিকিমেও, একইভাবে। সকালের নাস্তাতে কেউ ঠিকমতো কিছু খেতে পারলাম না।
 


আমরা শিলিগুড়ির ট্যাক্সি নিলাম। উঠে পড়লাম সবাই। যেভাবেই এসেছিলাম, একইভাবেই ফিরছি। কিন্তু অনুভুতিটা এক নয়। আমরা এখন অনেক বেশি শান্ত, নীরব, যেমনটা এখানে আসার আগে প্রথমে ছিলাম না। আমরা সেখানেই ফিরে যাচ্ছি যেখান থেকে শুরু করেছিলাম যাত্রা। চার ঘণ্টা জার্নি করে শিলিগুড়ি পৌঁছালাম। বেশ তাড়াতাড়ি মনে হলো। দুপুরের মধ্যেই। দুপুরে শিলিগুড়ি প্যানির ট্যাংকির পাশে হোটেলে খেয়ে দেয়ে বর্ডারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এখন ঢাকার উদ্দেশ্যের যাত্রাটা আমার কাছে অনেক বিরক্তকর আর সাধারণ মনে হচ্ছিল। আমি সবার সঙ্গেই ভ্রমণ করছিলাম, কিন্তু আমার অনেক একা মনে হচ্ছিল। আমি সবসময় ভাবতাম, আমার কাছে গোপন মানসিক শক্তির খনি আছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটা নেই। সেই সিকিমের কিশোর থাপা, সেই মান্নু দা, লাচুঙের কৌশিকদা, দার্জেলিঙের রবিন- তাদের কীভাবে ভুলবো আমি? মন্দিরের সে পাদ্রী, যিনি আমাকে ঈশ্বরের বাণী দিয়েছিলেন, যে মানুষগুলো আমাকে গাইড করেছে, পরামর্শ দিয়েছে, যাদের সঙ্গে গল্প করেছি, তাদের কীভাবে আমি ভুলি? জাপানিজ মন্দিরের সেই নারী, নাথুলা পাসের সেই বৃদ্ধা, লাচুঙের জোৎস্না ভরা রাত, কৌশিকদার রান্না করা আলুর দম আমি কী ভুলতে পারবো?

আমি কখনও হয়তো আবার দার্জেলিং বা সিকিম আসা হবে না। কিন্তু এই দুইজায়গার মানুষ আমাকে আপন করে নিয়েছে। যে ভালোবাসা, যে বোধ আমার কাছে স্বপ্ন ছিল, সেটাই হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থায়ী আবাস গেড়েছে।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়