ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

হিমলুং শিখরে রুদ্ধশ্বাস অভিযান: ৮ম পর্ব

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫৭, ১৩ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১২:৪৪, ২৬ অক্টোবর ২০২০
হিমলুং শিখরে রুদ্ধশ্বাস অভিযান: ৮ম পর্ব

আমরা সেই ঝরনার ভেতর দিয়ে হেঁটে এলাম। ঝরনার শীতলতা গায়ে মেখে সামনে এগিয়ে চলছি। এদিকে আকাশে কালো মেঘে ছেঁয়ে গেছে। বৃষ্টি নামতেও সময় নিলো না। ভিজে ভিজেই চলে এলাম ধর্মশালা। এখানে মাত্র একটি বাড়ি আছে। বাড়ির উঠানে কালো সাইনবোর্ডে লেখা পড়ে জানতে পারলাম এর উচ্চতা ৩ হাজার ২১০ মিটার, আর এখান থেকে মেটার দূরত্ব ২ ঘণ্টার পথ। ভেজা শরীর শীতে কাঁপছে। তাই এখানে চা বিরতি দিয়ে আমরা চুলার কাছে বসে আগুনে শরীর গরম করে নিলাম। গরম আদা-চা শরীর সতেজ করে দিলো।

প্রায় ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করেও বৃষ্টি থামার নমুনা দেখতে পেলাম না। এদিকে সন্ধ্যা দ্রুত এগিয়ে আসছে। তাই আর অপেক্ষা না করে, ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। পাহাড়ের গভীরতায় অন্ধকার সন্ধ্যা হওয়ার আগেই নেমে আসে। আমরা খাড়া এক চড়াইয়ের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ত্রিশ মিনিট লেগে গেল চড়াইটিতে উঠে আসতে। চড়াইয়ের উপরে পাহাড়ের ঢালে কিছুটা সমতল জায়গায় মেটা গ্রাম। গ্রামে ঢোকার আগে এই গ্রামের তথ্যসহ একাধিক সাইনবোর্ড লাগানো আছে। গ্রামের উচ্চতা ৩ হাজার ৫৭০ মিটার। এখানে একটি ছোট পুলিশ ফাঁড়িও আছে। সাইনবোর্ড থেকে আরো জানতে পারলাম এই মেটা থেকে ঝুনুম গ্রামের দূরত্ব ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের পথ, আর নার গ্রামের দূরত্ব ৩ ঘণ্টার পথ। আমরা সন্ধ্যা ছ’টার দিকে মেটা গ্রামে এসে পৌঁছলাম। গ্রামে ঢুকে প্রথমেই যে লজটি চোখের সামনে পড়ল তার নাম ‘মেটা গেস্ট হাউজ অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’। এখানেই আমাদের আজকের রাত্রিযাপন। লজে ঢুকে সোজা চলে এলাম রান্নাঘরে। এখানে বসেই গরম গরম আদা-চা খেয়ে শরীর গরম করে রুমে চলে এলাম।

কঠিন পাথুরে পাহাড় কেটে ঝরনার ভেতর দিয়ে রাস্তা

আজ হিমলুং অভিযানের প্রথম দিন ভালোভাবেই শেষ হলো। তবে আজকের পথটা লম্বা, চড়াই-উৎরাই এবং বৃষ্টি ছিল বলে কষ্ট হয়েছে বেশ। সারা শরীর ব্যথায় টনটন করছে। মনটা খুব করে চাচ্ছিল নরম বিছানায় শরীর ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ি। কিন্তু সেটা করা যাবে না, করলে শরীর খারাপ করবে। তাই চলে এলাম ডাইনিং রুমে। রুম হিটারের পাশে বসে এক লিটার পরিমাণের একটি ভরা ফ্লাক্স আদা-চা শেষ করলাম দু’জনে। চা শেষ হতে হতে ডিনার চলে এলো। ডিনার শেষ করে আমরা চলে এলাম রুমে। যেহেতু ভোরে উঠতে হবে, বেশি রাত না জেগে ঘুমিয়ে পড়লাম। 

ভেবেছিলাম প্রথম দিন শরীরের উপরে বেশ ধকল গেছে, তাই রাতে ঘুমটাও ভালো হবে। কিন্তু রাতে ঘুমাতে পারলাম না। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেই রাতটি পার করতে হলো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাইরে এসে দেখি পাশের উঁচু পাহাড়টি বরফে সাদা হয়ে আছে। বুঝতে পারলাম রাতে তুষারপাত হয়েছে। সন্ধ্যায় যখন আমরা এসেছি তখন বরফ দেখতে পাইনি। এখান থেকে অন্নপূর্ণা রেঞ্জের বেশ কয়েকটি পর্বতচূড়া দেখা যাচ্ছে। সকালের প্রথম সূর্যের আলো সেই পর্বতচূড়াগুলোর উপরেই পড়েছে। এই গ্রামে এখন নতুন চার-পাঁচটা লজ হয়েছে। আমরা যে লজে ছিলাম সেটা দেখতে বেশ গোছানো। লজের উঠানের পাশেই সবজি ক্ষেত। ক্ষেতর সতেজ সবজি দিয়েই অতিথিদের খাবার রান্না হয়। সকালের খাবার শেষ করেই আমরা আজকের মতো ট্রেকিং শুরু করলাম। আজকের গন্তব্য কেয়াং। যত উপরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি ততই যেন এই পথের সৌন্দর্য বেড়ে চলেছে। তবে সবুজ গাছপালা কমে যাচ্ছে। যেসব গাছপালা চোখে পড়ছে সেগুলো আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসছে। চারপাশে শুধু ধুসর রঙের পাথুরে পাহাড় আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার নারখোলা পাড় ধরে এগিয়ে চলছি।

পাহাড়ের গায়ে মেটা লজ

মেটা থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ পেড়িয়ে আমরা ঝুনুম নামক একটি জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। ঝুনুমের উচ্চতা ৩ হাজার ৬৪০ মিটার। এখানে আগে ছোট একটি গ্রাম ছিলো। পরিত্যক্ত ঘরগুলো তারই সাক্ষী দিচ্ছে। এখন আর এখানে কেউ থাকে না। তাই এখানে বেশি সময় না থেকে আবার হাঁটা শুরু করলাম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ছাখু নামক গ্রামে চলে এলাম। এই গ্রামটিও পুরনো। এখানে পরিত্যক্ত ঘরগুলো এখনো রয়ে গেছে। সেখানে জ্বালানির জন্য গাছের শুকনা ডালপালা রাখা। গ্রামে এখন শুধু তিন-চারটে লজ আছে। তবে এগুলো নতুন হয়েছে ট্রেকারদের জন্য। আমরা ছাখু গেস্ট হাউজ অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে যাত্রা বিরতি করলাম।

পাথরের মোড়েন গ্লেসিয়ার পার হচ্ছি

দুপুর একটার দিকে আমরা কেয়াং গ্রামে চলে এলাম। যেহেতু এই গ্রামের উচ্চতা বেশি তাই এখানে মোরগ পাওয়া যায় না। তাই ছাখু থেকে আসার সময় একটি বড় মোরগ কিনে নিয়ে এসেছি। আমরা যে লজে উঠেছি তার নাম ফুকারসল্যান্ড হোটেল।  চারপাশে আকাশছোঁয়া পাথুরে পাহাড় আর মাঝখানে বিশাল সমতল ভূমি। এমনই অসম্ভব সুন্দর জায়গায় এই গ্রাম। লজটি ঠিক এই সমতল মাঠের মাঝখানে। ধূসর মাঠে সবুজ রঙের টিনের চালার লজ, দূর থেকে চোখে পরে সবার। লজটির তিনপাশে ঘর আর একপাশে দুই-তিন ফুট উঁচু দেয়াল। লজের রান্নাঘরে দুপুরের খাবার রান্না হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের ট্রেকাররা খাবারের অপেক্ষায় মাঠে শুয়ে বসে রোদে শরীর গরম করছে। আমিও একটি ইয়াকের চামড়ায় শুয়ে আছি রোদে। কিছু সময় রোদে থেকে রান্না ঘরে এসে দেখি মুহিত ভাই রান্না করছে। নেপালীদের মুরগির মাংস রান্না আর আমাদের রান্নার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। মশলার কারণে স্বাদের কিছুটা পার্থক্য হয়। তাই মুহিত ভাই নিজেই রান্না করছে। মজার বিষয় হলো পেঁয়াজ, রসুন, আদা, কাঁচামরিচ ছাড়া মাংস রান্না হচ্ছে। বলা চলে শুধু হলুদ আর মরিচের গুঁড়া দিয়ে রান্না। আমরা যখন অভিযানে থাকি তখন মাঝেমধ্যে মুহিত ভাই রান্না করে। 

পাহাড়ে ঘেরা কেয়াং গ্রাম

আজকে দুপুরের খাবারে আছে ভাতের সঙ্গে মোরগের মাংস, ডাল, আলু সেদ্ধ, রাইশাক, শুকনা মরিচ ভাজি আর আমড়ার আচার। অভিযানে থাকার সময় এই উচ্চতায় মুখে খাবারের স্বাদ থাকে না। অনেক মুখরোচক খাবারও তখন খেতে ইচ্ছে করে না। তখন খাবারের সঙ্গে আচার থাকলে খেতে স্বাদ হয়। তাই আমরা অভিযানে যাওয়ার সময় সঙ্গে দেশে থেকে আচার নিয়ে যাই। এবারও আসার সময় আমার এক বোন ছোট এক বয়াম আচার দিয়ে দিয়েছিল। যাইহোক মশলা ছাড়া মাংস খেতে খারাপ লাগছে না। শেরপারাও মুহিত ভাইয়ের রান্না করা মাংস খেয়ে বাহবা দিলো।

দুপুরের খাবার

রাতের খাবারের সময় পরিচয় হলো ফিলিপাইনের পর্বতারোহী টিমের সঙ্গে। ফিলিপাইন থেকে তারা এসেছে তিনজন। নারী পর্বতারোহী জেমিমা, বয়স ২০ বছর। জেমিমার ছোট ভাই ওজি, বয়স ১৮ বছর। তারা দু’জন একসঙ্গে পর্বতারোহণ করছে। তারা ২০২০ সালে ফিলিপাইন থেকে ভাইবোন একসঙ্গে এভারেস্ট অভিযান করবে। যদি তারা সফল হতে পারে তাহলে ফিলিপাইনের পর্বতারোহণে দুটি রেকর্ড হবে একসঙ্গে। তাদের দেশের সর্বকনিষ্ঠ, এবং দুই ভাইবোনের একসঙ্গে এভারেস্ট আরোহণ। এর আগে তারা নেপালের আইল্যান্ড পিক (৬ হাজার ১৮৯ মিটার) আরোহণ করেছে সফলভাবে। এভারেস্টের আগে এই হিমলুং অভিযানে এসেছে প্রস্তুতি হিসেবে। তাদের সঙ্গে একজন ক্যামেরা ম্যান এসেছে, তার নাম জেড রসেল। তাদের এই পুরো অভিযান নিয়ে ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য। তাদের টিমে আরো একজন নারী পর্বতারোহী আছে। তিনি এসেছেন জার্মানি থেকে। তার নাম ইউলি। (চলবে)

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়