ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

হিমলুং শিখরে রুদ্ধশ্বাস অভিযান: ১১ তম পর্ব

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৭:৪৩, ২৩ ডিসেম্বর ২০২০
হিমলুং শিখরে রুদ্ধশ্বাস অভিযান: ১১ তম পর্ব

ইমাজিন নেপাল এজেন্সির মাধ্যমে আমাদের এবারের হিমলুং অভিযান। এই অভিযানে আমরা মোট পাঁচটি দেশের আটজন পর্বতারোহী নিয়ে আন্তর্জাতিক একটি দল। বাংলাদেশ থেকে মুহিত ভাই ও আমি। সাউথ আফ্রিকা থেকে ফিলিপ রুডল। ক্রোয়েশিয়া থেকে আন্দাবাক। সুইডেন থেকে জোয়াকিম গুস্তাফ এবং স্পেনের স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ বাস্ক কান্ট্রি থেকে গ্রাস ফার্নান্দো, ডেল কেরু মিল্লিয়ান জেসুস ও ডেল কেরু মিল্লিয়ান জোয়ান কার্লোস। জেসুস আর জোয়ান যমজ ভাই। দেখতে একই রকম!

আমাদের আটজনের দলটি তিন ভাগে ভাগ হয়ে অভিযান করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রথম সামিট পুশ করবে ফিলিপ, আন্দাবাক ও জো। তারা আমাদের আগেই বেসক্যাম্পে চলে এসেছে। বেসক্যাম্প থেকেই আন্দাবাক ফিরে গেছেন ক্রোয়েশিয়াতে তার গর্ভবতী স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে। তাই ফিলিপ আর জো এখন ঠুন্ডু শেরপা ও দাওয়া কামি শেরপাকে নিয়ে ক্যাম্প-১-তে আছে অ্যাক্লিমাটাইজেশনের জন্য। দ্বিতীয় সামিট পুশে মুহিত ভাই আর আমি। আমরা বেসক্যাম্পে আরো দুই দিন থেকে ক্যাম্প-১-এ যাবো অ্যাক্লিমাটাইজেশনের জন্য। তৃতীয় সামিট পুশ করবে ফার্নান্দো, জেসুস ও জোয়ান। তারা এখনো বেসক্যাম্পে এসে পৌঁছায়নি।

বাম পাশ থেকে লেখক, জেমিমা, এমএ মুহিত, ওজি ও ইউলি

আমাদের এই অভিযানে আছে অভিজ্ঞ চারজন শেরপা গাইড। যাদের মধ্যে শেরপা দলনেতা দাওয়া তেনজিং শেরপার সাথে ঠুন্ডু শেরপা, ড্যান্ডি শেরপা ও দাওয়া কামি শেরপা। দাওয়া তেনজিং শেরপা নয় বার এভারেস্টে আরোহণ করেছেন। তার ছোট ভাই কিলি পেম্বা শেরপার সঙ্গে ২০১৫ সালে ২০ হাজার ২৯৫ ফুট উচ্চতার মাউন্ট কেয়াজো-রি শিখর আরোহণ করেছিলাম। কিলি পেম্বা শেরপা ৭ বার এভারেস্ট আরোহণ করেছিলেন সে সময় পর্যন্ত। ঠুন্ডু শেরপা গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-ধারী বিখ্যাত পর্বতারোহী। তিনটি রের্কডের অধিকারী সে। যার মধ্যে কম বয়সে বেশিবার এভারেস্ট আরোহণ (১১ বার), ভাইবোনের সঙ্গে এভারেস্ট আরোহণ (৭ ভাইবোন) এবং পরিবারের সবার এভারেস্ট আরোহণ (মা, বাবা ও ৭ ভাইবোন)। সে এভারেস্ট ছাড়াও একাধিক আট হাজার, সাত হাজার ও ছয় হাজার মিটার পর্বতারোহণ করেছেন। ড্যান্ডি শেরপারও সাতবার এভারেস্টসহ একাধিক আট হাজার, সাত হাজার ও ছয় হাজার মিটারের পর্বত আরোহণ করেছেন। এই হিমলুং পর্বত আরোহণেরও অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। দাওয়া কামি শেরপারও এভারেস্টসহ একাধিক পর্বত আরোহণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমাদের খাবার তৈরির জন্য আছে বাবুর্চি গুরুঙ ও সুক চেরিং শেরপা এবং তাদের সহযোগী হিসেবে আছে সাঙগাম।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের আর্মি দলের সবুজ রঙের তাবুগুলো আমাদের তাবুর সামনেই করা হয়েছে। অনেকগুলো তাবু করেছে তারা। তাদের নামাজের জন্য আলাদা একটা বড় তাবুও করা হয়েছে। সেখানে তারা জামাতের সঙ্গে নামাজ পড়ে। এছাড়াও আরো কয়েকটি দলের তাবু রয়েছে। বিকেলে জেমিমা, ওজি ও ইউলি আমাদের তাবুতে এসেছে। আমরা কিছু সময় গল্প করলাম। তারপর বেসক্যাম্প থেকে তিন-চারশ ফুট উপরে উঠে এলাম পাংগ্রি গ্লেসিয়ারের পাড়ে। উপর থেকে গ্লেসিয়ারের ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য দেখে আবার ফিরে এলাম ক্যাম্পে।

হিমলুং পর্বত শিখর

আজ ১৪ অক্টোবর। রাতটি ছিল পূর্ণ জ্যোৎস্না। আমাদের ঢাকার জ্যোৎস্না আর হিমালয়ের জ্যোৎস্নার মধ্যে অনেক ফারাক। হিমালয়ের জ্যোৎস্নার মধ্যে এক মাদকতা আছে। যা কেবল তারাই বুঝতে পারে যারা এই জ্যোৎস্নায় ভিজতে পেরেছে। রাতে বেশ কয়েকবার তাবু থেকে বেরিয়েছি জ্যোৎস্না দেখার লোভে। কিন্তু কনকনে ঠান্ডার কারণে বেশি সময় বাইরে থাকা সম্ভব হয়নি। গতকাল হার্ষরাও চলে এসেছে। তাদের তাবু আমাদের ডাইনিং তাবুর পাশেই করেছে। তাই তার সাথেও খুব সহজেই দেখা ও কথা হচ্ছে। গতকাল আমাদের বিশ্রাম ছিলো, আজও আমাদের বিশ্রাম। তবে আজ আমাদের দলের শেরপাদের পূজা হবে। পূজার সকল আনুষ্ঠানিকতা সকাল থেকেই প্রস্তুত করা হচ্ছে। আমাদের দলের ফিলিপ ও জো ক্যাম্প-২ এ রাত কাটিয়ে বেলা ১১টার দিকে বেসক্যাম্পে ফিরে এসেছে। তারা ফিরে আসার পরেই পূজা শুরু হলো। পর্বতে মূল অভিযান শুরুর আগে শেরপারা তাদের ধর্মীয় রীতিতে পূজা করে। যেন উপরের আবহাওয়া ভালো থাকে এবং ভালোভাবে সফলতার সাথে অভিযান শেষ হয়। পূজা করার জন্য ফু গ্রামের গুম্ফা থেকে লামা এসেছে। যারা পূজা করে তাদের লামা বলা হয়। ধর্মীয় শ্লোক পাঠ করে পূজা করলেন তিনি। পূজা শেষে আমরা সবাই একত্রে মিষ্টিমুখ করলাম।

রাতে ডাইনিং তাবুতে বসে ফিলিপ ও জো’র সাথে গল্প হলো। যেহেতু তারা আমাদের আগে এসেছে এবং ক্যাম্প-১ ও ২-এ রাত কাটিয়ে এসেছে সেহেতু তাদের সাথে আগে গল্প করার সুযোগ হয়নি। ফিলিপ মিশুক মানুষ। তার সাথে কথা বলে মনেই হচ্ছে না আজকেই প্রথম পরিচয়। অন্যদিকে জো একটু চুপচাপ স্বভাবের মানুষ তবে মিশুক। সে আমাদের দলের সব থেকে সিনিয়র। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। ১৫ অক্টোবর সকালে আমরা ক্যাম্প-১-এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরলাম। আমরা উপরে যাচ্ছি অ্যাক্লিমাটাইজেশনের জন্য। আমাদের উদ্দেশ্যে আজ ক্যাম্প-১-এ থাকবো। কাল উঠে যাবো ক্যাম্প-২-এ। সেখানে এক রাত থেকে আবার সোজা নেমে আসবো বেসক্যাম্পে। তারপরে কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে ভালো আবহাওয়া দেখে চূড়ান্ত আরোহণের উদ্দেশ্যে বের হবো। ফিলিপাইনের জেমিমা ও ওজি ফু গ্রামে আজ নেমে গেলো। তাদের শরীর খারাপ করেছে। তাই ফু গ্রামে দুই দিন থেকে আবার ফিরে আসবে। ফিলিপ ও জো বেসক্যাম্পে বিশ্রাম নিয়ে চূড়ান্ত অভিযান করবে। হার্ষরা আজ ক্যাম্প-১ এ গিয়ে ফিরে আসবে।

মূল অভিযানের পূর্বে শেরপাদের পূজা

বেসক্যাম্প থেকে পাংগ্রি গ্লেসিয়ারে নেমে এলাম। ছোট, বড় পাথরের বোল্ডার আর তার ফাঁকে বরফের ফাটল। সতর্কতার সাথে এগিয়ে চলছি। রাস্তা চেনার উপায় নেই, কিছু দূর পরপর ছোট খুটির মাথায় রঙিন কাপড় বেঁধে রাখা হয়েছে। যেন রাস্তা চেনা যায়। আমাদের সঙ্গে দাওয়া শেরপা আর ড্যান্ডি শেরপা। প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লেগে গেলো আমাদের এই গ্লেসিয়ার পার হতে। গ্লেসিয়ার শেষে খাড়া এক বিপজ্জনক ঢালে উঠতে হলো। আমরা বিকেল সাড়ে তিনটের দিকে ক্যাম্প-১-এ এসে পৌঁছালাম। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আর্মি টিম আজ রাতে সামিট পুশ করেছে। তারা ক্যাম্প-২ থেকেই সামিট পুশ করেছে। তাদের আঠারো জন থেকে দুইজন আর্মি ও চার জন শেরপা হিমলুং সামিট করতে পেরেছে। তারাও উপর থেকে ক্যাম্প-১-এ নেমে এসেছে সন্ধ্যার মধ্যে।

আজ আরো দুইজন ইতালির পর্বতারোহী সামিট করেছে। তারা অ্যাল্পাইন স্টাইলে অভিযান করেছে। গতকাল বেসক্যাম্প থেকে রওনা হয়ে সোজা ক্যাম্প-২-এ চলে এসেছে। কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে রাতেই সামিট পুশ করেছে। ভোরে হিমলুং সামিট করে আজ সোজা বেসক্যাম্পে নেমে এসেছে। আর্মি টিমের এক কর্নেল অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে সাপ্লিমেন্ট অক্সিজেন দিয়ে ক্যাম্প-১-এ নামিয়ে আনা হয়েছে। পাথর আর বরফের ছোট একটি সমতল জায়গা সেখানেই আমাদের ক্যাম্প করা হয়েছে। আমাদের দুইটি তাবু করা হয়েছে। একটিতে আমি আর মুহিত ভাই আর অন্যটিতে দুই শেরপা। সন্ধ্যার পরপরই চার পাশ মেঘে ঢেকে গেলো এবং তুষারপাত শুরু হলো। সারা রাত চললো তুষারপাত। রাতে পাশের নামজুং পর্বত থেকে বেশ কয়েকবার অ্যাভালান্সের শব্দ চারপাশ কাঁপিয়ে তুললো।

ডাইনিং তাবুতে জমে উঠেছে আড্ডা

আজ আমরা ক্যাম্প-২-এ যাবো। তাই ভোরেই ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম। অক্সি-মিটারে আমাদের শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। আবহাওয়ার সঙ্গে আমাদের শরীর ভালো মানিয়ে উঠেছে। এখান থেকে ক্যাম্প-২ এর পথ খুবই চ্যালেঞ্জিং। আলগা পাথরের চড়াই আর গভীর খাদের কিনার দিয়ে পিচ্ছিল বরফের পথ। বিপজ্জনক পাথুরের চড়াইয়ে ফিক্সড রোপ লাগানো আছে। সেই রোপের সাহায্যে উপরে উঠে এলাম। ক্যাম্প-২-এ ঘণ্টাখানেক পথ আগে মুহিত ভাই সিদ্ধান্ত নিলেন বেসক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার। এর কারণ হলো, যেহেতু আমাদের অ্যাক্লিমাটাইজেশন হয়েছে ভালো এবং আমাদের শরীরও সুস্থ তাই উপরে না গিয়ে বেসক্যাম্পে ফিরে ভালোভাবে বিশ্রাম করা ও খাবার খাওয়া। যেন আমাদের শরীরের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাই আমরা সোজা বেসক্যাম্পে নেমে এলাম।

১৭ অক্টোবর। আজ ফিলিপ ও জো চূড়ান্ত অভিযানের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। সাথে দাওয়া শেরপা ও দাওয়া কামি শেরপা। বিশাল আর্মি টিম আজ বেসক্যাম্প থেকে চলে গেছে। আরো কয়েকটি দল এসে ক্যাম্প করেছে। কাঠমান্ডুতে স্যাটালাইট ফোনে মিংমার কাছ থেকে জানা গেলো ২২ অক্টোবর পর্যন্ত আবহাওয়া খারাপ থাকবে। তাই সেই অনুযায়ী মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছি। ১৯ অক্টোবর আমাদের চূড়ান্ত অভিযানের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকায় আর যাওয়া হলো না। (চলবে)

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়