শেখ ভানুর জন্মভিটায়
সুমনকুমার দাশ || রাইজিংবিডি.কম
পাশাপাশি দু-দুটো দিকনির্দেশক চিহ্ন-সংবলিত সাইনবোর্ডে শেখ ভানুর মাজার শরিফের রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া আছে। হবিগঞ্জ থেকে লাখাই উপজেলামুখী সড়কের বামৈ বাজারের ডানপাশে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া ছোট একটা রাস্তা ধরেই মাজারে যেতে হয়। সে রাস্তা ধরেই যাচ্ছিল আমাদের দুটো মোটরসাইকেল। একটি মোটরবাইকে হবিগঞ্জের পরিবেশকর্মী আবিদুর রহমান রাকিব আর আমি, অন্যটিতে স্থানীয় গাইড হিসেবে আমাদের সঙ্গে থাকা নাট্যকর্মী বাপ্পী শ্রমিক। মিনিট আটেক অথবা দশেক পর আমরা ভাদিকারা গ্রামের মাজার-প্রাঙ্গণে উপস্থিত হই। দেখি, একটি সাউন্ডবক্স থেকে উচ্চস্বরে বাজছে মুর্শিদি গান। ঘিরে বসে আছেন কয়েকজন তরুণ-কিশোর। অন্যদিকে কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তি মাজারের সামনে বাঁশ পুঁতছেন। পরে জানলাম- আশুরা আয়োজনের অংশ হিসেবে এখানে প্যান্ডেল বাঁধা হচ্ছে। সে-দিন ছিল ২০২০ সালের ২৫ আগস্ট।
আমাদের দেখেই এগিয়ে আসেন গাঁ-উদলা লুঙ্গি পরিহিত এক ব্যক্তি। মাথায় টাক, মুখে লম্বা শ্বেতশুভ্র দাড়ি। তাঁর কোমরে বাঁধা লাল গামছা। এতক্ষণ মাজারের পাশের সড়কে খড় শুকানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কাজে সাময়িক বিরতি দিয়ে দ্রুততার সঙ্গেই তিনি এলেন। বললেন- ‘মাজার দেখতে আইছেন?’ আমরা হ্যাঁ-সূচক জবাব দিই। ততক্ষণে কোমরের গামছার বাঁধন খুলে সেটি তিনি উদলা শরীরে জড়িয়ে নেন। এরপর তিনিই আমাদের পুরো মাজার ঘুরিয়ে দেখান। সেইসঙ্গে মরমিসাধক শেখ ভানু সম্পর্কেও তাঁর জানা ও জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে যাবতীয় তথ্য আমাদের জানাতে শুরু করলেন।
শেখ ভানুর মাজারের পাশেই একটি পাক-পাঞ্জাতন রয়েছে। শেখ ভানুর কবরস্থান আর মাজারের আশপাশ দেখানোর পর সেই ব্যক্তি আমাদের নিয়ে যান বৃক্ষ-লতাপাতা আচ্ছাদিত একটি স্থানে। সেখানে দাঁড়িয়ে কথায় কথায় জানতে পারি, তাঁর নাম সমছু মিয়া। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। তিনি শেখ ভানুর চতুর্থ সিঁড়ির দিককার আত্মীয়। নিজে গান করেন না। তবে তাঁর ছেলে ওয়াসিম মিয়া শেখ ভানুর গান গেয়ে থাকেন বলে জানালেন। প্রতি বৃহস্পতিবার আশেকান-ভক্তদের অংশগ্রহণে আসর বসে। সেখানে শেখ ভানুর কালাম গাওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতি বছরের পৌষ মাসের চোদ্দো তারিখ উরস হয়। একশ বছর ধরে এ উরস হয়ে আসছে।
সমছু মিয়া শেখ ভানু সম্পর্কে খুব যে বেশি জানেন, তা কিন্তু নয়। তবে প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য ঠিকই তিনি জানিয়ে দেন। এই যেমন- শেখ ভানুর বায়েত হওয়ার গল্প মানে মুর্শিদ ধরার কাহিনি কিংবা শেখ ভানুর ব্যবহৃত ডেগ তাঁর পূর্বপুরুষদের বিক্রি করে দেওয়ার পর আবার কীভাবে সেটা ভাদিকারা গ্রামে নিয়ে আসা হয়, এসব। পূর্বপুরুষ আর গ্রামের বাসিন্দাদের মুখে মুখে শেখ ভানুর যেসব গল্প বর্তমানে প্রচলিত আছে, সেসবও তিনি শোনান। হয়তো মাজার দেখতে আসা লোকদের বলতে বলতে ধারাবাহিক চর্চায় এসব কাহিনি এখন তাঁর একেবারেই ঠোঁটস্থ।
আমাদের কথা বলতে দেখে গ্রামের নানা বয়েসি আরও কয়েকজন মানুষ মুহূর্তেই জড়ো হন। আলাপে তাঁরাও যুক্ত হন। একেকজন একেক তথ্য যোগ করেন। পুরো কাহিনির সারসংক্ষেপ করলে এমন দাঁড়ায়- ১৮৪৯ অথবা ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে শেখ ভানু জন্ম নেন। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন। বাবার নাম মুনশি নাসিরউদ্দিন। শেখ ভানুর বাবা হবিগঞ্জ সদর উপজেলার উচাইল গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। পরে লাখাইয়ের ভাদিকারা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। গ্রামের মক্তব ও মসজিদে তিনি মুনশিয়ানা করতেন। নাসিরউদ্দিন তাঁর বাড়িতে পাক-পাঞ্জাতন মানে হোসেনি ঘর স্থাপন করেন। অভাবের সংসার হওয়ায় দশ বছর বয়সে শেখ ভানু ব্যবসায় নামেন। সিলেট ও ছাতক থেকে পাইকারি দরে কমলা কিনে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতেন। ফলের ব্যবসার সুবাদেই ভৈরববাজারের কিছু ব্যবসায়ীর সঙ্গে একসময়ে শেখ ভানুর পরিচয় ঘটে। যুবক বয়সে তাঁদের পরামর্শে তিনি বিভিন্ন গ্রামের গৃহস্থদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে ভৈরববাজারে বড়ো বড়ো মহাজনকে ধান সরবরাহ করে কমিশন পেতেন। এ কারণেই ধীরে ধীরে ‘ভানু ব্যাপারী’ নামে তিনি পরিচিতি পান।
সারভানু ও জুলেখা বিবি নামে তাঁর দুজন স্ত্রী ছিলেন। তবে তাঁরা নিঃসন্তান ছিলেন। একবার ধান সংগ্রহ করে ভৈরববাজারে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নদীপথে রওয়ানা হয়েছিলেন শেখ ভানু। কান্লারবাগ নামের একটি স্থানে তিনি লক্ষ্য করেন- নদী দিয়ে ভেসে চলা একজন মানুষের মৃতদেহ ঠুকরে খাচ্ছে কয়েকটি কাক। পাশেই ঘেউ ঘেউ করছিল কয়েকটি কুকুর। এ দৃশ্য দেখার পর তাঁর মনের মধ্যে মৃত্যুচিন্তা প্রকটভাবে ভর করে। শেখ ভানু ভাবেন- ‘মুরদা মানুষ এক ভাসে দরিয়ায়/উপরে বসিয়া কাকে চক্ষু তার খায়/[...] /মাছ-মাছালি টাইনে খায় জলের উপরে/[...] /সোনার তনু জলে ভাসে কোথায় গেল দম।’
এরপর তাৎক্ষণিক নৌকার অন্যদের সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ি ফেরেন শেখ ভানু। অনেকটা ঘোরের মধ্যেই কিছুদিন কাটে তাঁর। এমনই এক সময়ে তিনি মুর্শিদ মান্য করেন সৈয়দ মিরান শাহ তাতারীকে। ধীরে ধীরে শেখ ভানু ঝুঁকে পড়েন মরমিগানের জগতে। একের পর এক গজল, মুর্শিদি, দেহতত্ত্ব, মনশিক্ষা, নিগূঢ়তত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, বাউলগান, বিচ্ছেদ, কাওয়ালি, বৈষ্ণব পদাবলি ও বারোমাসি পর্যায়ভুক্ত গান রচনা করতে থাকেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে আছরারোল এস্ক, চেহেল অজুদ ও ছহি সেক ভানুর পুথী। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।
গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা শেষ হলে সমছু মিয়ার সঙ্গে শেখ ভানুর বসতভিটায় যাই। বসতভিটার পাশেই একটি টিনশেডের ঘরে রাখা আছে শেখ ভানুর ব্যবহৃত জিনিসপত্র। সমছু মিয়ার ডাকাডাকিতে ছুটে আসেন শেখ ভানুর মাজারের খাদিম ছায়েদুল মিয়া। তাঁর পরনে সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় সাদা টুপি। তিনি এসে তালাবদ্ধ দরজা খুলে দেন। ছায়েদুলের নিজের ভাষায় তাঁর বয়স ‘চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হবে’। শেখ ভানু সম্পর্কে তাঁর দাদা। ছায়েদুল মিয়া জানান, প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে শেখ ভানুর কালামের আসর বসে। বাদ্যযন্ত্রহীন গজল, তত্ত্বমূলক ও মুর্শিদিসহ শেখ ভানুর রচিত অন্যান্য কালাম গাওয়া হয়। প্রতি সপ্তাহেই অন্তত পঞ্চাশ থেকে শ-খানেক ভক্ত আসে। তাঁদের সংগ্রহে শেখ ভানুর কালামের কোনও পাণ্ডুলিপি কিংবা প্রকাশিত বই নেই। তবে প্রকাশিত পুরোনো কালামের সংকলন এবং এর বাইরে লোকমুখে প্রচলিত কালামগুলো তাঁরা সংগ্রহের চেষ্টা করছেন বলেও তিনি কথা প্রসঙ্গে জানিয়েছেন।
খাদেম ছায়েদুল মিয়া শেখ ভানুর ব্যবহৃত জিনিসপত্র আমাদের দেখান। শেখ ভানুর শয্যার খাট, লাঠি, আসন, সিন্দুক ও রান্নাবান্নার বিরাট আকারের ডেগ- সবকিছুই দেখান। শেখ ভানুর খাটের চারপাশে রঙিন ঝালর ঝুলছে, উপরে সাঁটানো হয়েছে শামিয়ানা। লালসালু দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে ডেগ। এমন সময়ে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যান ছায়েদুল মিয়া। ফিরে আসেন ঠান্ডা পানীয় আর বিস্কিট নিয়ে। আপ্যায়ন শেষে আমরা বিদায় নিয়ে ফিরতি পথে হবিগঞ্জের দিকে রওয়ানা হই।
মোটরবাইক ছুটে চলছে। শেষ বিকেলের শোঁ শোঁ বাতাস শরীরে লাগছে। একটু পরই সন্ধ্যার আঁধার ঘিরে ধরবে চারপাশ। চালকের পেছনে নিশ্চিন্ত মনে বসে আমি চোখ মুজি। আমার চোখে ভাসছে নব্বই বছর বয়েসি নারী সফর চানের মুখ। কিছুক্ষণ আগে অন্যান্য গ্রামবাসীর সঙ্গে যখন কথা হয়েছিল, তখন শেখ ভানুর মাজারের ঠিক সামনেই তাঁর সঙ্গেও দেখা হয়েছিল। বয়সের ভারে অনেকটা বেঁকে গিয়েছেন, চামড়ায় শতশত ভাঁজ পড়েছে। অথচ লাঠি কিংবা অন্য কোনও ধরনের সাহায্য ছাড়াই গুটিগুটি নগ্ন পায়ে অপূর্ব ভঙিতে তিনি হেঁটে এসেছিলেন। সে সময়েই তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘শেখ ভানু সম্পর্কের দিক দিয়া আমার বড়োবাপ।’
আমি সফর চানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- ‘শেখ ভানুর কোনও কালাম আপনি জানেন?’
‘দুই-তিনটা, চাইরটা জানি!’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন।
‘তাই! কোন কালামটা সবচেয়ে ভালো লাগে আপনার?’
প্রশ্ন শুনে লজ্জায় মুখ লুকান সফর চান। তিনি আর কথা বলতে ইচ্ছুক নন। তবে বারকয়েক আমার চাপাচাপিতে একসময়ে বলেন, ‘নিশীথে যাইও ফুলবনে-এ কালামডা ভালা লাগে আমার।’
‘গাইবেন একবার কালামটা?’ অনুরোধ করি আমি।
একরাশ লজ্জা নিয়ে জবাব দেন সফর চান ‘আমি গাইতে ফারি (পারি) না।’
ঢাকা/তারা
আরো পড়ুন