ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

যাত্রাপথে ঘুমিয়ে পড়ার বিড়ম্বনা

সঞ্জয় দে  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫৬, ২৭ জুলাই ২০২১   আপডেট: ১৮:০২, ২৭ জুলাই ২০২১
যাত্রাপথে ঘুমিয়ে পড়ার বিড়ম্বনা

সারায়েভো টু বার্লিন: দ্বিতীয় পর্ব

আমি এখন চলেছি সারায়েভো থেকে জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে। আসলে আমার যাবার কথা বার্লিনে। কিন্তু বার্লিনে যাবার সরাসরি টিকেট পাইনি। বাধ্য হয়ে স্টুটগার্ট পর্যন্ত বিমানে গিয়ে সেখান থেকে হয়তো ট্রেনে যেতে হবে বার্লিন। ফলে সারা রাত হয়তো ট্রেনেই কাটবে।

স্টুটগার্ট-এর বিমানবন্দর থেকে মেট্রোরেলে করে মূল রেল স্টেশনে এসে যখন পৌঁছাই, তখন রাত দশটা। স্টেশনের দোকানগুলো একে-একে বন্ধ হচ্ছে। এক ভিয়েতনামিজ মেয়ে তার দোকানের লোহার গেট বন্ধ করে ভেতরে সাফসুতরো করছে। তার দোকান ছাড়া বাকি কোথাও-ই রাতে খাবার মতো কিছু নেই। আমি তাই সেই লোহার গেটের কাছে মুখ নিয়ে বলি, ‘একটু এদিকে শুনবেন?’  মেয়েটি ব্রুমস্টিক ফেলে আমার দিকে এগিয়ে আসে।

কিছুক্ষণ আগে বার্লিন যাবার ট্রেনের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি। কপাল আজ নিতান্তই মন্দ। বার্লিন যাবার কোনো সরাসরি ট্রেন নেই এ বেলা। এখান থেকে প্রথম যেতে হবে ফ্রাঙ্কফুর্ট। সেখান থেকে ট্রেন বদলে হ্যানোভার। তারপর হ্যানোভার থেকে ট্রেন বদলে বার্লিন। এদিকে আমি বড্ড ঘুমকাতুরে মানুষ। রিকশা, বাস, ট্রেন– এমন নানা বাহনে ঘুমিয়ে পড়ি। একবার ঢাকা আসার পথে এভাবেই আমার পকেট থেকে ট্রেনের টিকিট চুরি হয়। চোর বাবাজী হয়তো ছিলেন বিনা টিকেটের যাত্রী। ঘুমন্ত অবস্থায় আমার পকেটে ট্রেনের টিকেট দেখে তিনি বুঝে ফেলেছিলেন, তার মুশকিল আসানের সমূহ সম্ভাবনা। ওদিকে কমলাপুর স্টেশনে নেমে টিকেটচেকার যখন আমাকে পাকড়াও করলো, তখন হাড়ে হাড়ে টের পেলাম যাত্রাপথে ঘুমিয়ে পড়ার বিড়ম্বনা। কিন্তু এখানে তো আর চোরের উপদ্রব নেই। ভয় যেটা আছে, সেটা হলো, পরের ট্রেন মিস করবার। হয়তো দেখা গেলো রাতের গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম, ট্রেন আমাকে নিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট পার হয়ে চলে গেল জার্মানির ভিন্ন কোনো কোণে। তেমন হলে তো সাড়ে সর্বনাশ!

তবে উপায় হয়তো একটা আছে। মোবাইলের ঘড়িতে একটা এলার্ম সেট করে রাখলে কেমন হয়? যে স্টেশনে যে সময়ে আমার নামবার কথা, এলার্ম সেট করে রাখবো ঠিক সেই সময়ে। ঘুমিয়ে পড়লেও হয়তো সে ক্ষেত্রে ক্ষতি নেই। ঘড়িই আমাকে জাগিয়ে দেবে।

ওদিকে আরেক সমস্যা হলো, ফ্রাঙ্কফুর্টে যাবার পরের ট্রেনটি ছাড়বে দুই ঘণ্টা বাদে। যেহেতু সেই সকালের আগে বার্লিনে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না, তাই এ মুহূর্তে কিছু না খেলেই নয়। যদিও জানি দোকান বন্ধ হয়ে গেছে, তবুও যদি শীতল বাষ্পে ঢেকে থাকা ফ্রিজ থেকে এক কাপ দৈ আর এক গ্লাস ফল পাওয়া যেত, তবে বড্ড ভালো হতো। মেয়েটি ওর বাকি কাজ ফেলে রেজিস্টার মেশিন আবারও চালু করে এই খাবারগুলো বিক্রি করে আমাকে বাঁচিয়ে দেয়।

খাবারগুলো নিয়ে স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসি। রুমটির তিনধারে কাচের দেয়াল। ফলে আশপাশ দিয়ে যারা হেঁটে যাচ্ছে, তাদের স্পষ্ট দেখা যায়। আমার বাঁ দিকের কোণে বসেছে একটি আরব মেয়ে। মাথায় হিজাব। খুব সম্ভবত সিরিয়ান শরণার্থী। মেয়েটিকে দেখে স্টেশনের অন্য দিক দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক যুবক সহাস্যমুখে এগিয়ে আসে। তারপর দুজনের মাঝে কিছু কথাবার্তা হয়। মেয়েটি বসা অবস্থায় আর ছেলেটি ওর মুখোমুখি দাঁড়ানো অবস্থায় দুজনের মাঝে গল্প চলতে থাকে। ফলে কোন ফাঁকে যে পেছনে দুই পুলিশ এসে দাঁড়িয়েছে, সেটি সেই যুবক বুঝতেই পারেনি। এই দুজনের মাঝে যিনি মহিলা পুলিশ, তিনি যুবককে অবজ্ঞা করে সরাসরি সেই মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে, ‘এই লোকটি কি তোমাকে বিরক্ত করছে? নির্ভয়ে বলো।’ মেয়েটি খুব অবাক হয়। তারপর কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘না, মোটেই না। এ আমার পূর্ব পরিচিত।’

আসলে জার্মানিতে ওই সময়ে বেশ কিছু নারী উত্যক্ত করার ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশই ঘটেছে ইরাকি, আফগান, সিরিয়ান শরণার্থী গ্রুপের যুবকদের দ্বারা। এরা ইউরোপে এলেও নতুন মহাদেশের সংস্কৃতি আর কানুনের সঙ্গে তখনও হয়তো নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেনি। তারপর পুলিশ বিভাগ বেশ সমালোচনার মুখে পড়ে। অনুমান করি, তারপর থেকেই হয়তো এখানকার পুলিশ বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করে।

সেই ছেলেটি এরপর আর কথা বাড়ায় না। সে বিদায় নেয়। মেয়েটি কিছুটা বিরস বদনে একা বসে থাকে। সেই মুহূর্তে আমার চেয়ারের উল্টোদিকে একটি পরিবার এসে জায়গা নেয়। স্বামী, স্ত্রী আর তাদের তেরো-চৌদ্দ বছর বয়সের কন্যা। স্বামী-স্ত্রীর পোশাক একেবারেই জীর্ণ। স্ত্রীর গায়ে মলিন শার্ট, কলারের কাছটায় কালশিটে দাগ। মেয়েটি অবশ্য কিছুটা পরিপাটি পোশাক পরেছে। চুল বেণী বাঁধা। স্বামীটির হাতে চটের থলের মতো একটি ব্যাগ। সেই ব্যাগ থেকে সগৌরবে মাথা তুলে উপস্থিতি জানান দিচ্ছে কয়েকটির সজনের ডাঁটা। বোঝা যায়, এদের আর্থিক সঙ্গতি ভালো নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এরা কোন দেশের নাগরিক?

চেহারার আদলে আর সঙ্গে থাকা ওই সজনে ডাঁটা দেখে এদের দক্ষিণ ভারতীয় বলে মনে হয়। কিন্তু দক্ষিণ ভারতীয়রা সাধারণত এভাবে পরিবারসুদ্ধ ইউরোপের দেশে অভিবাসী হয়ে যায় না। তাহলে? তখন হঠাৎ দেখা একটি সিনেমার কথা মনে হয়। সিনেমাটির নাম ‘দিপান’। নির্মিত হয়েছে তামিল গৃহযুদ্ধে বাস্তুচ্যুত এক তামিল পরিবারের কাহিনী নিয়ে। বস্তুত সেই পরিবারের কেউই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

যুদ্ধে এক যুবক ক্যাম্পে সন্ধান পায় আরেক তামিল তরুণীর। তরুণীকে সে প্রস্তাব দেয়, একটি অনাথ বালিকা খুঁজে বার করার জন্যে। সেক্ষেত্রে এই তিনজন মিলে একটি পরিবার সেজে জাতিসংঘের মাধ্যমে শরণার্থী হিসেবে নাম লেখাতে পারবে, সে সূত্রে হয়তো পরে ইউরোপের কোনো দেশে পাড়ি জমাতেও পারবে। সেই যুবকের নাম দিপান। দিপানের পরিকল্পনা সফল হয়। একটি অনাথ মেয়েকে নিজের মেয়ে সাজিয়ে শরণার্থী হিসেবে ওরা এসে পৌঁছায় ফ্রান্সে। সেখানকার একটি ছোট শহরের আলজেরিয়ান মাফিয়া-প্রধান পাড়ায় ওদের প্রাথমিক ঠিকুজি তৈরি হয়। সিনেমার কাহিনিতে নানা চড়াই-উৎরাই তৈরি হয় সেই পরিবারটির ফ্রান্সের সেই অপরাধপ্রবণ এলাকায় নিজেদের টিকে থাকার সংগ্রামকে কেন্দ্র করে। দিপান সিনেমার কথা স্মরণ হতেই চট করে মাথায় খেলে যায়, এরাও তামিল শরণার্থী পরিবার নয়তো?

তবে আমি আর এ নিয়ে বেশি কিছু ভাবার সময় পাই না। কারণ দূরের ইলেক্ট্রনিক বোর্ড ততক্ষণে আমাকে জানিয়ে দেয়, ফ্রাঙ্কফুর্টগামী ট্রেন প্ল্যাটফর্মে এসে ঢুকছে। বাইরে তখন নিশুতি রাত। কিছুটা কুয়াশাচ্ছন্ন। আমি একটা পাতলা জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে প্ল্যাটফর্মে এসে ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকি।

ডয়েসে বানের সাদা ট্রেনটি সাগরে ভাসতে থাকা ডলফিনের মতো  নিঃশব্দে প্ল্যাটফর্মে এসে থামবার পর খুব বেশি কাউকে নেমে যেতে দেখি না। আমার মতো দু’একজন যারা এই নিশুতি রাতে ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলেন, তারাই কেবল টিকেটে থাকা কামরার নম্বর মিলিয়ে টুপটাপ ট্রেনে উঠে পড়েন। সেইসঙ্গে বন্ধ হয় ট্রেনের স্বয়ংক্রিয় দরজা। আমার কামরায় উঠে দেখি– আশেপাশের মানুষ ঘুমিয়ে কাঁদা। পাশের আসনের মানুষটি চেয়ারটি প্লেনের সিটের মতো করেই এলিয়ে দিয়ে ভোঁস ভোঁস করে নাক ডাকছে। একবার ভাবলাম, এলার্ম ঘড়ির আর বোধহয় প্রয়োজন হবে না। এমন বিপুল নাসিকা গর্জনের মাঝে কি আর ঘুমানো সম্ভব? কিন্তু ট্রেন ছুট লাগাবার পরেই বুঝি, একটানা দুলুনি আর লাইন বদলের ধাতব কর্কশ শব্দ ঘুমের জন্যে উপাদেয়। এমনকি সেই নাসিকা গর্জনের শব্দকেও পরাস্ত করে ফেলতে সে প্রস্তুত। তাই ঝুঁকি না নিয়ে আমি দ্রুত এলার্ম সেট করে ফেলি। (চলবে) 

পড়ুন প্রথম পর্ব: ট্যাক্সি ড্রাইভারদের ‘হাইকোর্ট দেখানোর’ প্রবণতা

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়