ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

ট্র্যাপটাওয়ার স্টেশনে স্বাগত জানালো বৃষ্টি

সঞ্জয় দে  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:০৪, ১৭ আগস্ট ২০২১   আপডেট: ১৭:০৮, ১৭ আগস্ট ২০২১
ট্র্যাপটাওয়ার স্টেশনে স্বাগত জানালো বৃষ্টি

সারায়েভো টু বার্লিন: শেষ পর্ব  

সুড়ঙ্গ নিয়ে গল্প তো অনেক হলো, এবার না হয় সেখান থেকে প্রস্থান করে আজকের দিনটিতে ফিরে আসি। রেস্তোরাঁ তথা আমার হোটেলের খুব কাছেই ইউ-বান অর্থাৎ পাতাল রেলস্টেশন। ভেতরটা তত আলোকিত নয়। কিছুটা গুমোট। বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়ার পরশ এখানে নেই। সিঁড়ি বেয়ে নামতেই দেখি তীব্র বায়ুঘূর্ণি তৈরি করে ট্রেনটা ফুস করে বেরিয়ে গেল। পরেরটি আসবে ছয় মিনিট পর। ট্রেন চলে যেতেই স্টেশনে নেমে এল পিনপতন নিস্তব্ধতা। সেই সাথে আলগোছে ভেসে এল রেলের পাতে লেগে থাকা লুব অয়েলের যান্ত্রিক গন্ধ।

এটা পাড়ার স্টেশন। তাই লোকের হুলুস্থুল নেই। কেবল আমার অদূরে দুজন মধ্যবয়েসি ভদ্রলোক বেঞ্চে বসে খুব নিচু স্বরে নিজেদের মাঝে কথা বলছেন। পরনে মলিন জ্যাকেট। পায়ের কাছটায় রাখা ময়লাটে প্লাস্টিকের ব্যাগ। বোঝা যায়, এরাও নবাগত শরণার্থী। এদের উল্টোদিকেই  রেললাইন, আর তার পাশের দেয়ালে বিজ্ঞাপনের আলোকিত বোর্ড। এই মুহূর্তে সেখানে দেখানো হচ্ছে একটি হাতে আঁকা চিত্র। ম্যাজিক মাউনটেইন নামক রতিক্রিয়ার দৃশ্য। যে যুগল আঁকা হয়েছে, তাদের দুজনের মুখেই অনাবিল তৃপ্তির বহিঃপ্রকাশ। এই দৃশ্যের সাথে লেখা– এমন সুন্দরতম মুহূর্তেও দয়া করে কনডম সঙ্গে রাখতে ভুলবেন না। ইউরোপের খুব কম শহরেই এমন খোলামেলা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। 

কথা বলার মুহূর্তে সেই বোর্ডের দিকে চোখ পড়ায় ভদ্রলোক দুজন কয়েক মুহূর্ত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন, তারপর চোখ নামিয়ে নিজেদের মাঝে আবারও আলাপচারিতায় মগ্ন হন। নতুন দেশ, নতুন শহর, নতুন সংস্কৃতির এমন অনেক কিছুই হয়তো তাদের প্রাথমিকভাবে বিকর্ষণ করবে। কেউ কেউ সেই বিকর্ষণকে আর কখনোই কাটিয়ে উঠতে পারে না। নিজের ফেলে আসা দেশের সংস্কৃতিকে উৎকৃষ্টতম ভেবে নিয়ে তারা কেবল সেই আশ্রয়দানকারী দেশের জল-হাওয়া খেয়ে বেঁচে থাকেন, কিন্তু নিজের শেকড়কে সেই ভিন দেশের মাটিতে প্রোথিত হতে দেন না। এর ফলে তারা যেমন ক্রমাগত নিজেদেরকে গুটিয়ে ফেলেন, তেমনি তাদের উত্তর পুরুষের অনেকেও মূলধারা থেকে ছিটকে পড়ে। 

বার্লিনে একেবারে জালের মতো ছড়িয়ে আছে বাস-ট্রেন। মাটির উপরের ট্রেন হলো এস-বান আর মাটির নিচেরটি ইউ বান। ভাড়াও তুলানামূলকভাবে সস্তা। পুরো দিনের টিকেট কাটলে সেই টিকেট দিয়েই ঝামেলাহীনভাবে সারাটা দিন এ-ট্রেন থেকে ও-ট্রেনে কিংবা ট্রেন থেকে নেমে টুক করে বাসে চড়ে বসা যায়। প্রায় প্রতিটি এলাকা, প্রতিটি পাড়াই কোনো-না-কোনো পরিবহনের জালের আওতাধীন। তাই ট্র্যাপটাওয়ার পার্ক এলাকায় যাবার জন্যে আমাকে রীতিমত ধাঁধায় পড়তে হয়। ট্রেন কিংবা বাস দুটো পথই আছে। কোনটা নেব তবে? ট্রেনের পথটিকেই মনে হলো বেশি সাবলীল। যে পার্কে যেতে চাই, তার থেকে হয়তো দশ মিনিটের হাঁটা পথ দূরেই এর স্টেশন। 

ট্র্যাপটাওয়ার স্টেশনে হলুদ-লালে রাঙানো এস-বান ট্রেন থেকে নামার পরই টিপটিপ বৃষ্টি আমাকে স্বাগত জানায়। স্টেশনে আমার সঙ্গে আরও দুজন নামলেন। তারা চলে গেলেন পেছনের সাইকেল স্ট্যান্ডে। ওখানে বোধকরি নিজেদের সাইকেল তালাবন্দী করে রেখে গিয়েছিলেন। স্টেশনের পেছনই লিনডেন গাছের ঘন সারি। সেই সাথে বুনো ঝোঁপের অরণ্য। তাদের বাড়ন্ত সবুজ পাতাগুলো যেন এগিয়ে এসে গিলে খেতে চাইছে রেললাইনটিকে। আমি স্টেশনের পেছন দিকে গাছের ডালের নিচ দিয়ে বৃষ্টি থেকে গা বাঁচিয়ে পথ হাঁটি। 

এখানে বাঁ পাশে বিশাল সবুজ পার্ক। মসৃণভাবে কাটা ঘাস। পার্কের শেষ প্রান্তে অজস্র ওকবীথি প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে।  তেমন একটি ওক গাছের নিচে ধবধবে সাদা আলখাল্লা পরে দুলে দুলে গান গাইছে একদল আফ্রিকান। খুব সম্ভবত প্রার্থনা গীত। নিজেদের সমাজের গির্জা না থাকায় হয়তো এই বিকল্প ব্যবস্থা। আমার ডান পাশটায় পিচধালা পথ। সেই পথটিকেও দুদিক থেকে ঘিরে আছে ম্যাপল গাছের পঞ্চকোণ পত্রালীর প্রাচুর্য। সে পথ ধরে হাঁটার সময়ে ক্ষণে ক্ষণেই টুং টুং করে বেল বাজিয়ে পথ চায় পেছন থেকে আসা সাইকেল। বেশ কয়েকবার এমন বেলের শব্দ শোনার পর বুঝতে পারি, ভুলটা আসলে আমারই। ওদের নয়। বেশ প্রশস্ত এই পদচারী পথে মাঝ বরাবর সাদা দাগ টেনে দু ভাগ করে দেয়া হয়েছে। ডান ধারে চলবে সাইকেল, আর বাঁ ধারে হাঁটবে পথিক। সেই অলিখিত নির্দেশ অমান্য করে ডানদিক ধরে হাঁটতে থাকায় সাইকেল আরোহীরা স্পষ্টতই বিরক্ত হয়ে আমার কাছে পথ ছেড়ে দেয়ার দাবি পেশ করছিলেন। 

ট্র্যাপটাওয়ার-এ আসবার মূল কারণ এখানকার বিশাল স্মৃতিসৌধটি দেখা। কয়েক হাজার একরের উপর নির্মিত এই সৌধ। ১৯৪৫-এর শেষ কটা দিনের তুমুল যুদ্ধে বার্লিনেই প্রাণ হারায় প্রায় আশি হাজার সোভিয়েত সৈন্য। স্তালিনের একগুঁয়েমিতে দ্রুত বার্লিন জয়ের খেসারত– এই পাহাড়প্রমাণ শবের আধার। এতো সৈন্যকে তো আর নিজ দেশে নিয়ে গিয়ে সমাহিত করা সম্ভব নয়! তাই তাঁদের শেষ ঠিকানা হয়েছিল এই ভিন দেশের মাটিতে। তিনটি ভিন্ন স্থানে গণকবর খুঁড়ে অধিকাংশকে সমাহিত করা হয়েছিল। পরে ওই তিনটি স্থানেই সৌধ নির্মাণ করা হয়। সেই তিনটির মাঝে বৃহত্তমটি হলো এই পার্ক। 

আমি এর আগে টিয়ারগারটেনের সমাধিটি দেখেছি। ওটা বার্লিনের প্রবেশদ্বার ব্র্যান্ডেনবুর্গ গেটের ঠিক পেছনেই। টিয়ারগারটেন সমাধিটি-ই ছিল বার্লিনের প্রথম সোভিয়েত সমাধি। হিটলারের দপ্তর ধ্বংস করে সেখানকার মার্বেল পাথর দিয়ে যুদ্ধের ঠিক পরপর তাড়াহুড়ো করে এটি গড়া হয়। তখনও দুই বার্লিনের সীমারেখা সুচারুরূপে চিহ্নিত হয়নি। সেটি হবার পর দেখা গেল– সমাধিটি পড়েছে পশ্চিম বার্লিনে। অগত্যা সমঝোতা হলো– পূর্ব বার্লিন থেকে প্রতিদিন কিছু সোভিয়েত সেনা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওপারে গিয়ে এই সমাধির দেখভাল করে দিনশেষে পূবে ফিরে আসবে। এভাবেই চলছিল বার্লিন দেয়ালের পতন অবধি। ’৯৪ সালে পাততাড়ি গুটিয়ে পাকাপাকিভাবে চলে যাবার আগে রাশিয়া জার্মানিকে শর্ত দেয়, তারা চলে গেলেও এই সমাধিক্ষেত্রগুলোর কোনো অসম্মান হতে দেয়া যাবে না। এমনকি সংস্কারের যাবতীয় ব্যয়ভারও জার্মান সরকারকে বহন করতে হবে। জার্মানি তখন ভালোয় ভালোয় সব রুশ সেনাকে নিজ দেশ থেকে বিদায় করতে পারলে বাঁচে। তথাস্তু বলে তাঁরা সেই রুশ দাবি মেনে নেয়।
লোকে আজকাল বিখ্যাত ব্র্যান্ডেনবুর্গ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে শত শত ছবি তুললেও খানিক দূরের এই টিয়ারগারটেন সৌধকে খুব একটা আমলে নেয় না। আর নেবেই-বা কেন? সেই কবে, প্রায় আশি বছর আগে যুদ্ধে প্রাণ দেয়া সৈনিকরা শুয়ে আছে সেখানে। আজকের মানুষের সাথে তাঁদের আত্মিক সম্পর্কের বাঁধন যে নিতান্তই ঠুনকো!
যাকগে, টিয়ারগারটেনের সমাধিটি দেখার পর থেকেই মনে ইচ্ছে ছিল ট্র্যাপটাওয়ার দেখার। সেজন্যেই এবারে এখানে আসা। 

ঢোকার মুখে শ্যাওলায় ঢেকে যাওয়া তোরণ। উপরে রুশ ভাষার মোটিফে লেখা– ‘সেইসব শহীদের স্মৃতির প্রতি, যারা সমাজতান্ত্রিক মাতৃভূমির স্বাধীনতা আর মুক্তির জন্যে প্রাণ দিয়েছে।’ এর কিছুটা নিচে শ্যাওলায় মুখ ঢেকে এখনো জানান দিচ্ছে স্তালিনের কয়েক ছত্র দম্ভোক্তি- "এখন হয়তো সবাই বুঝবে, সোভিয়েত জনগণের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের কারণেই ফ্যাসিস্ট শক্তির হাত থেকে ইউরোপের মুক্তি ঘটেছে– জোসেফ স্তালিন।' 

সমাধির মূল বেদি বহু দূরে, ঝাপসাপ্রায়। দুই ধারে উইলো গাছের ডাল শ্মশ্রুমণ্ডিত বৃদ্ধের মুখের মতো শাখাভারে ভূমি অভিমুখে আনত।  এই গাছগুলোর বেষ্টনীর পর মূল বেদি অবধি দুই ধারে মোট ষোলটি শ্বেত পাথরের ফ্রেম। প্রতি দিকে আটটি করে। সেই ফ্রেমে মোটিফের মাধ্যমে মূর্ত করা হয়েছে সোভিয়েত সেনাদের বীরত্ব, যুদ্ধাহত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার আকুতি কিংবা শিশুদের আর্তনাদ। আর এই যে ষোলটি ফ্রেম, এগুলো সোভিয়েত দেশের ষোলটি রিপাবলিকের মানুষের আত্মত্যাগের প্রতীক। তবে প্রশ্ন হলো, ষোলটি কেন? আমরা তো জানি, সোভিয়েত ইউনিয়নে রিপাবলিক ছিল পনেরটি। আসলে এই উদ্বৃত্ত রিপাবলিকটি হলো ফিনল্যান্ড থেকে যে অংশটুকু সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধের একেবারে শুরুতেই অন্যায্য আব্দারের মাধ্যমে ছিনিয়ে নিয়েছিল, সেটি। ১৯৪০ সালে গঠিত সেই রিপাবলিকটিকে পরে ১৯৫৬ সালের দিকে অবলুপ্ত করে সুবিশাল রাশিয়ান রিপাবলিকের সাথে জুড়ে দেয়া হয়। যেহেতু এই সমাধিটি গড়া শেষ হয় ১৯৪৯ সালে, তাই তখনকার ইতিহাসের অংশ হিসেবে রয়ে গেছে সেই ফিনিশ রিপাবলিকটি-ও। 

মূল সমাধি বেদিটি একটি অনুচ্চ পাহাড়ের মতো। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। সেখানে প্রকাণ্ড এক ভাস্কর্য। যুদ্ধজয়ী বীর সৈনিক, ডান হাতে তলোয়ার, আর বাঁ হাতে বাস্তুহারা জার্মান শিশু। ওখানে গিয়ে দাঁড়ালে চতুর্ধারের পুরো পার্কটি প্রশান্তি ভরে দেখা যায়। এখন বৃষ্টি হচ্ছে বলে দুদিকের সবুজ গাছগুলোকে আরও উজ্জ্বল মনে হচ্ছে। কেমন যেন লুব্ধকরা এক দৃশ্য। মনে হয় সারাদিনই তাকিয়ে থাকি। সময় বয়ে যাক, দিন বয়ে যাক। 

সেভাবেই হয়তো সময়কে বইয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু বাস্তব সমস্যা হলো আমার কাছে ছাতা নেই। তাই তেড়ে বৃষ্টি নামলে কাকভেজা হয়ে সর্দিগর্মি বাঁধানো ছাড়া উপায় নেই। এই মেঘলা বৃষ্টিভেজা দিনের বাকি ভাগটা তাই হয়তো হোটেলে কাটানোই উত্তম হবে। যে-পথ ধরে এসেছিলাম, সে-পথ ধরেই ফিরে আসি স্টেশনে। মনে মনে হিসেব কষি– এস-বান, তারপর সেটি থেকে নেমে ইউ-বান ধরে পাঁচটি স্টেশন পরই আমার হোটেল।

‘হালো, হালো। লাস্ট স্টেশন। লাস্ট স্টেশন।’– কার যেন এমন উচ্চস্বর শুনে চমকে উঠি। যতদূর মনে পড়ে সঠিক ইউ বানেই চেপে বসেছিলাম। নেমে আসে হালকা ঝিমুনি। তারপর? এখন আমি কোথায়? চোখ মেলে দেখি পুরো কামরায় আমি একা। ট্রেনটি থেমে আছে। প্ল্যাটফর্মও নিঃশব্দ। বাইরে থেকে চিৎকার করছে ট্রেনের চালক। শেষ স্টেশনে ট্রেন থামার পর বিরতির সময়ে একটু কফি পানে যাবার সময়ে ভদ্রলোকের চোখ পড়ে আমার উপর। ঘুমের তোড়ে অজানা স্টেশনে ভেসে যাবার যে ভয় আমাকে তাড়া করছিল গত রাতে, সেই আশঙ্কাই যেন সত্যি হলো এ-বেলায়। তবু রক্ষে যে, এই শেষ স্টেশনটি আমার হোটেল থেকে খুব বেশি দূরে নয়। বিপরীত দিকের ট্রেনটি নাকি ছেড়ে যাবে মিনিট পাঁচেক পরেই। ট্রেন চালককে বেশ কয়েকবার ‘ডানকে শয়েন’ অর্থাৎ ধন্যবাদ জানিয়ে আমি সেই ট্রেনের প্ল্যাটফর্মের দিকে এবারে এগিয়ে যাই।  (শেষ) 

পড়ুন চতুর্থ পর্ব: গুপ্তচরের চোখ ফাঁকি দিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে দেশত্যাগ

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়