ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

টেকনাফ টু সেন্টমার্টিন: যে জার্নি থ্রিলারকেও হার মানায়

জিকরুল আহসান শাওন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৩, ২৭ অক্টোবর ২০২১   আপডেট: ১৩:৪৯, ২ নভেম্বর ২০২১
টেকনাফ টু সেন্টমার্টিন: যে জার্নি থ্রিলারকেও হার মানায়

আমি যতই আরামদায়ক ট্যুর করতে চাই না কেন, তা কেন যেন কোনো না কোনোভাবে একসময় অ্যাডভেঞ্চারে পরিণত হয়। এটা একটা আজব বিষয়।

আমরা যখন ট্যুর করা শুরু করি ৯০ এর দশকে, তখন খুব বেশি মানুষ ট্যুর করতো না। আমরা সচরাচর নিজেরা নিজেরাই ট্যুর করতে পছন্দ করি। এখন প্রচুর মানুষ ঘুরতে বের হয়। তাই গত কয়েক বছর ধরে আমরা বর্ষাকে আমাদের মূল ট্যুরের সিজন হিসেবে বেছে নিয়েছি।

গত বছরের মতো এবারো ইচ্ছা ছিল সেন্ট মার্টিনস্ আইল্যান্ডে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবো। গত বছরে সেন্ট মার্টিন ট্যুরের কিছু অসাধারণ অনুভূতি আছে।

গিয়েছি বৃষ্টিতে ভিজতে। অথচ প্রথম দুদিন বৃষ্টির দেখাই নেই। চলে আসার দিন সকালে শুরু হল বৃষ্টি। দৌড়ে চলে আসলাম বিচে। সামনে বিশাল দিগন্ত। যত দূর চোখ যায়, বৃষ্টি আর বৃষ্টি। শুধুই বৃষ্টি। সে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা মেপে মেপে পড়ছে। কোনোটি বেশি না, আবার কমও না। কী যে অসাধারণ সে বৃষ্টি।

আমরা দৌড়ে নামলাম সাগরে। সেখানে আমাদের জন্যে আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। সাগরের মাঝে বুক পানিতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির স্বাদ নিচ্ছি। সামনে বিশাল সমুদ্র। যতদূর চোখ যায়, চারিদিকে মুক্তার দানার মতো বৃষ্টি। শ'য়ে শ'য়ে মুক্তা, হাজারে হাজারে, লাখে লাখে মুক্তার দানা। একে ছোঁয়া যায়, অনুভব করা যায়, কিন্তু ধরা যায় না। ধরতে গেলেই তারা কোথায় যেন হারিয়ে যায়।

এবার নিয়ে আমি ২১ বার সেন্টমার্টিনে ঘুরতে গেলাম। প্রতিবারই নতুন নতুন কিছু পেয়েছি। কোনোবারই আগের কোনো কিছুর পুনরাবৃত্তি হয়নি। এবারও হলো না। হাজার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হলো না। ঢাকা থেকে রওনা দিলাম ১৯ আগস্ট সন্ধ্যার বাসে। এবার আমরা ১২ জন যাচ্ছি। বাস ছাড়বে ৮:৩০ মিনিটে। যথারীতি কিছু সফরসঙ্গী দেরি করে আসলো। বাস ছাড়লো রাত ৮টা ৫৭মিনিটে। শুরু হলো আড্ডা, হৈচৈ, গান। পরদিন সকাল সাড়ে ৯টায় নামলাম টেকনাফ বাসস্ট্যান্ডে। টেকনাফজুড়ে সকালের নাস্তা পাওয়া গেলো না। তাই সিঙ্গারা-সমুচা দিয়েই কিছুটা পেট পূজা করতে হলো।

সাগরে ৩নং সতর্কতা সংকেত চলছে। তাই জাহাজ চলবে না। এর আগে ৫নং বিপদ সংকেত চলা অবস্থায় সাগর পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে আমার এবং আমাদের। তাই ৩ নম্বর সিগন্যালকে পাত্তাই দিলাম না।

২১ আগস্ট পূর্ণিমা। রাতে সাগর ফুসে ঊঠবে। তাতেও সমস্যা কি! আমরা রওনা হচ্ছি দুপুর ১২টায়। মাত্র আড়াই ঘণ্টার জার্নি। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা বলা আছে। ভালোই তো হবে! সেন্ট মার্টিনে যাচ্ছি বৃষ্টিতে ভিজতে। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির সাথে খেলতে খেলতে সাগর পাড়ি দেওয়া যাবে।

তারপরও পুরো বিষয়টা ট্যুরের সঙ্গীদের সাথে শেয়ার করলাম। ওদের বললাম, কেউ থেকে যেতে চাইলে থাকতে পারে। আমি কিন্তু ঠিকই যাবো। যাওয়ার ব্যাপারে কেউ কোনো আপত্তি করলো না। বরং কিশোর, আদনান, স্মৃতিসহ কয়েকজনের বেশ আগ্রহ দেখা গেলো। ওরা ছাড়াও সানোয়ার, রিমা, মাহি, আশরাফ, বাবু, শুভ, পলাশ, রাইসুল কেউই আপত্তি করলো না।

সাংবাদিক রাইসুল যথারীতি তার কিছু লিঙ্ক খুঁজে বের করলো। ট্রলার ঠিক হলো। মালিক শুক্কুর আলী। তিনি জানালেন, ট্রলারের সাথে সেন্টমার্টিনে ৮০ বস্তা সার যাবে। আমরা আনন্দে রাজি হয়ে গেলাম। কারণ, এ ৮০ বস্তা সারের ৮০০ কেজি ওজনই সাগরে আমাদের ট্রলারকে অতিরিক্ত দুলুনি থেকে বাঁচাবে।

টেকনাফে আমার সাথে পরিচয় হলো সেন্টমার্টিনের সরকারি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক সাগরের সাথে। তিনি ১১টার যাত্রীবাহী ট্রলারটি মিস করেছেন। পরের দিন (২১ তারিখে) তার স্কুলের দ্বিতীয় সাময়িকী পরীক্ষা। তিনি টেকনাফে এসেছেন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে নেওয়ার জন্য। সময়মতো ফিরতে না পারলে পরের দিন সেই স্কুলে পরীক্ষা হবে না। তার কথা শুনে আমি নিজে থেকেই তাকে আমাদের সঙ্গি হতে বললাম। বেচারা কিছুক্ষণ লজ্জায় আমতা আমতা করে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলো।

শিক্ষক সাগরের মতো আরও ৪/৫ জন যাত্রী আছেন, যারা যাত্রীবাহী ট্রলার মিস করেছেন। তারা নিজ উদ্যোগে উঠে পড়লেন আমাদের ট্রলারে। আমরাও কেউ না করলাম না। সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে আজ আর কোনো ট্রলার ছাড়বে না। কয়েকজন মানুষের যদি কিছু উপকার হয় তাতে ক্ষতি কি।!

১২টার ট্রলার ছাড়লো ১২টা ৫০ মিনিটে। বিসমিল্লাহ্ বলে রওনা হলাম। সবার চোখে স্বপ্ন। সেন্টমার্টিনের স্বপ্ন। বৃষ্টিকে ছোঁয়ার স্বপ্ন।

কিছু দূর যাওয়ার পরে বিজিবির সদস্যরা ট্রলার আটকালেন। ট্রলারের মাঝি ইউএনওর স্বাক্ষর সম্বলিত হাতে লেখা একটি কাগজ বিজিবির সদস্যদের দেখালো। কিছুদিন আগ পর্যন্ত এ কাগজ দেখালেই হয়ে যেত। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ সে কাগজ নকল করতে শিখে গেছে। তাই এখন নতুন নিয়ম চালু হয়েছে, ইউএনওর কাগজ ছাড়াও বিজিবির ক্যাম্পে মৌখিক আদেশ আসতে হবে। যেহেতু বিজিবির ক্যাম্পে এমন কোনো আদেশ আসে নাই তাই এ ট্রলার ছাড়া হবে না।

মাঝি যথারীতি তার মালিক শুক্কুর আলীর সাথে যোগাযোগ করলেন। এরপর শুক্কুর আলী যোগাযোগ করবে সারের মালিকের সাথে। সারের মালিক যোগাযোগ করবে রাজনৈতিক নেতাদের সাথে। রাজনৈতিক নেতারা যোগাযোগ করবে ইউএনওর সাথে। ইউএনও যোগাযোগ করবে বিজিবি সদস্যদের সাথে। মাঝি আমাদের আস্বস্ত করলেন ১০ মিনিটের মধ্যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

আমরা নাফ নদীর এক ধারে অপেক্ষা করতে লাগলাম। অপেক্ষা করতে করতে ১ ঘণ্টা কেটে গেলো। মাঝি তখনো বলে যাচ্ছেন ১০ মিনিটের মধ্যেই সমাধান হয়ে যাবে। মাঝির এই ১০ মিনিট অপেক্ষা করতে করতে আরো ১ ঘণ্টা কেটে গেলো। ধৈর্যের বাধ ভাঙা শুরু করেছে। মাঝি তখনো বলে যাচ্ছেন ১০ মিনিটের মধ্যেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আরও ১ ঘণ্টা অপেক্ষা করে একপর্যায়ে রাইসুল আর বাবু রওনা হয়ে গেলো মূল ভুখণ্ডে। তারা রওনা হওয়ার ৩০ মিনিটের মধ্যেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো।

এর মাঝে শুরু হলো বৃষ্টি। ট্রলারে কোনো ছৈ নেই। তাই আমরা রেইনকোট পরে আনন্দেই বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলাম। বিশাল নাফ নদীতে বৃষ্টি সত্যিই অসাধারণ লাগছিল। রাইসুল আর বাবু বিকেল সাড়ে ৪টায় ফিরে আসলো ৪ প্যাকেট বিস্কুট আর খাবার পানি নিয়ে। সকালে নাস্তা খাওয়া হয়নি, দুপুরের খাবার হিসেবে ১২ জনের জন্যে ৪ প্যাকেট বিস্কুট একটু কমই হয়ে যায়। তারপরও সবাই মিলে ভাগযোগ করে খেলাম। এদিকে বৃষ্টি ক্রমাগত পড়েই যাচ্ছে। বিকাল ৪টা ৩৮ মিনিটে আমরা আবার রওনা হলাম সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে। ‘নোঙর তোলো তোলো, সময় যে হল হল...’ গান শুরু হলো।

নদী কিছুটা উত্তাল। দেড় ঘণ্টা পর ট্রলার পড়লো সাগরে। সাগরে পড়তে না পড়তেই বিশাল এক ঢেউয়ের সাথে ধাক্কা খেলো। কয়েকজন আনন্দে চিৎকার করে উঠলো। আরও জোরে 'নোঙর তোলো তোলো' গান শুরু হলো। আমি আমার আগের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলাম, আজ খবর আছে। আমার দুঃশ্চিন্তা বাকিদের আতঙ্কিত করতে পারে বলে চুপচাপ থাকলাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। মিনিট দশেকের মধ্যেই সবার গান বন্ধ হয়ে গেলো। আজ সাগর সত্যিই অনেক বেশি উত্তাল।

ধীরে ধীরে চারিদেকে অন্ধকার হতে শুরু করেছে। বৃষ্টি আসা-যাওয়ার মধ্যেই আছে। যতদূর চোখ যায়, সাগরে কোনো নৌকা বা ট্রলার নেই। হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা মাঝ সমুদ্রে গিয়ে যদি ট্রলারের প্রপেলার নষ্ট হয়ে যায়, তখন কী হবে! নিজের এ বাজে চিন্তাটাকে সঙ্গে সঙ্গেই হাওয়ায় মিশিয়ে দিলাম। আতঙ্ক ধীরে ধীরে সবাইকে গ্রাস করছে। এত উত্তাল সাগর আমি কোনোদিন দেখিনি। দেখেনি আমাদের সঙ্গী সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারাও। এমনকি দেখেনি আমাদের মাঝিও। এমন উত্তাল সাগরে মাঝি কোনোরকমে ট্রলারটাকে সোজা রাখতেই হিমসিম খাচ্ছেন।

সেন্টমার্টিনের কসমেটিকস দোকানের মালিক রশিদ ভাই আমাদের সাথে যাত্রী হিসেবে এসেছেন। তিনি ১০ বছর আগে ট্রলার চালাতেন, এখন ব্যবসা নিয়েই বেশি ব্যস্ত। ট্রলারের মাঝির এ করুণ অবস্থা দেখে শেষ পর্যন্ত তিনি এসে হাল ধরলেন। তিনি হাল ধরাতে ট্রলার কিছুটা ধাতস্ত হলো।

এদিকে, চারিদিক অন্ধকার। আজ পূর্ণিমার আগের দিন, মানে ভরা কটাল (Spring tide)। উত্তাল সাগর, ৩নং বিপদ সংকেত, বৃষ্টি- ঝড়- বজ্রপাত হিম-শীতল বাতাস। তার মাঝ দিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। আমার একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল ট্রলারটি ঠিক পথে চলছে না। মাঝিকে বললাম, সেন্টমার্টন তো সোজা, আমরা ডান দিকে যাচ্ছি কেন? মাঝি কিছু বললো না, অন্য কেউই কোনো উত্তর দিলো না। পরে বুঝেছি প্রথমে ঢেউকে সামলাতে হচ্ছে, তারপর ঢেউ যে দিকে নেয় সেদিকেই যেতে হচ্ছে, তারপর কিছুটা সামনের দিকে এগোতে হচ্ছে। তাই না চাইলেও সাগরের দিকেই এগোচ্ছি আমরা।

সবার সাথে লাইফজ্যাকেটও নেই। এর মাঝে মাহী, কচি, পলাশ, রাইসুল কিছুটা সাঁতার জানলেও এ সাগরের সাথে পেরে উঠবে কিনা সন্দেহ আছে। বাবু সাঁতারই জানে না। বাবুকে নিয়ে টেনশন শুরু হলো। সন্ধ্যা ছয়টা/সাড়ে-ছয়টার মধ্যে আমাদের সেন্টমর্টিনে পৌঁছানোর কথা। সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। সেন্ট মার্টিনের দেখা নাই। সাগর উত্তাল থেকে আরও উত্তাল হতে লাগলো। এ সাগরকে আমি চিনি না। এ সাগরকে আমাদের মাঝিও চেনেন না। হলিউডের ছবির পরিচালকরাও এ সাগর দেখেনি।

একসময় অনেক দূরে নেভির জাহাজের আলো দেখতে পেলাম। মনে আশার আলো জেগে উঠলো। আমরা আলো লক্ষ্য করে এগিয়ে যাচ্ছি। সাগর তার মতোই রেগে আছে। ধীরে ধীরে আলোর দিকে এগিয়ে চলছি। আর সম্ভবত ২০/২৫ মিনিটের মধ্যেই আমরা দ্বীপে পৌঁছাতে পারবো। ঠিক এ সময়ই ট্রলারের প্রপেলার নষ্ট হয়ে গেলো। ১০ মিনিটের মধ্যেই আমরা ঢেউয়ে ঢেউয়ে আমাদের ট্রলার আরও ৪/৫ কিলোমিটার সাগরের দিকে চলে গেলো। নেভির জাহাজের আলো ধীরে ধীরে মৃদু থেকে মৃদুতর হতে লাগলো।

বিপদ মানুষকে কতটা সাহসী করে তোলে তা বিপদের সময়ই বোঝা যায়। মাঝির এক সহকারী কোমরে দড়ি বেঁধে সাগরে নেমে পড়লো। দ্বীপে আমাদের ফিরতেই হবে। প্রপেলার তাকে ঠিক করতেই হবে। মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম, কতক্ষণ লাগতে পারে। মাঝি তার পুরনো রেডি করা উত্তর দিল, ১০ মিনিটের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। উত্তর শুনে হাসবো না কাঁদবো ভেবে পেলাম না।

রাইসুল, কিশোর, স্মৃতি, আমি আমাদের নিজস্ব যোগাযোগে মাধ্যমেগুলোতে যোগাযোগের চেষ্টা করতে লাগলাম। আমি প্রথমে ফোন দিলাম জুয়েলকে। কারণ জুয়েল সেন্টমার্টিনে ট্যুরিজম ব্যবসা করে। ওর লোকাল লিংক ভালো। তারপর যোগাযোগ করলাম সবুজ ভাই আর নেভিতে কর্মরত হিমেলের সাথে। কিশোর-স্মৃতি প্রথমে যোগাযোগ করলো সাজ্জাদের সাথে, তারপর নেভিতে কর্মরত স্বর্ণার সাথে। রাইসুল যোগাযোগ করলো টেকনাফের লোকাল ব্যবসায়ী, ইউএনও, বিজিবি সদস্যদের সাথে। খুবই অবাক হলাম ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে ঢাকার বিশাল বন্ধু সার্কেল আমাদের এ করুণ অবস্থা জানেতে পেরে ফোন দিতে লাগলো। সবাইকে বললাম আমাদের এ বিপদের কথা।

আমরা ধীরে ধীরে আরো সাগরের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছি। এখন নেভির জাহাজের আলো মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে, আবার মাঝে মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। যে গতিতে আমরা সাগরের দিকে যাচ্ছি, তাতে নেভির উদ্ধারকারী জাহাজ আসলেও আমাদের খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।

জুয়েল সেন্টমার্টিনের ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতির সাথে যোগাযোগ করে তার ফোন নম্বর দিলো। আমি উনার সাথে কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, চিন্তা কইরেন না, আমরা ব্যবস্থা করতেছি। ঠিক এ সময়ই প্রপেলার ঠিক হয়ে গেলো। আবার নতুন উদ্যোমে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। জুয়েল, সবুজ ভাই, সাজ্জাদ সবাইকে দুঃশ্চিন্তা মুক্ত করলাম, ট্রলার ঠিক হয়ে গেছে, আমরা আর ২০ মিনিটের মধ্যেই (যদিও এটা কমপক্ষে ১ ঘণ্টার পথ) সেন্ট মার্টিনে পৌঁছাবো। পৌঁছেই আমি সবাইকে আবার জানাবো। আমাদের দুঃশ্চিন্তা আমরা ঢাকা পর্যন্ত সংক্রমণ না করি।

চলতে চলতে ১৫ মিনিট পরে এবার গেলো ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে! রাইসুল যোগাযোগ করলো ট্রলারের মালিক শুক্কুর আলীর সাথে। সে আমাদের নিশ্চিত করলো, নতুন ইঞ্জিন দেওয়া হয়েছে, এ ইঞ্জিন নষ্ট হওয়ার কোনো সম্ভবনাই নাই। কিন্তু বেয়াদব ইঞ্জিন শুক্কুর আলীর কোনো যুক্তিই শুনলো না। সে নষ্ট হয়েই রইলো। পরে অবশ্য শুনেছি নতুন ইঞ্জিনে বেশি প্রেসার দিতে নেই, তাহলে এ অবস্থা হয়। কিন্তু এ উত্তাল সাগরে ট্রলারকে টিকিয়ে রাখতে ইঞ্জিনকে বেশি প্রেসার দিতেই হবে। আমরা জাস্ট পরিস্থিতির শিকার।

মাঝি আর তার সহকারী দু'জন লেগে গেলো ইঞ্জিন ঠিক করতে। এরমধ্যে একজন সহযোগী কোমরে দড়ি বেঁধে আবার সাগরে নেমে পড়লো, প্রপেলারের কোনো সমস্যা যদি থেকে থাকে, সেটাই তার গবেষণার বিষয়। আবারও ফোন গেল জুয়েল, সাজ্জাদ, হিমেল, স্বর্ণা আর ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতির কাছে। সবাই আবার আমাদের নিশ্চিত করলো সাহায্য আসছে। ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি আমাকে বললেন, তাদের ট্রলার ইতোমধ্যেই আমাদের খুঁজতে রওনা হয়েছে। হিমেল আমাকে নিশ্চিত করলো নেভি তাদের নিজস্ব জাহাজ ও একটি লোকাল ট্রলার পাঠিয়েছে।

সবাইকে আমি আবার নিশ্চিন্ত করলাম, আরেকটু ধৈর্য ধরতে। নেভি ও লোকার ট্রলার আসছে। যে কোনো সময় আমাদের ওরা পেয়ে যাবে। মিনিট পনেরর মধ্যে আবার ইঞ্জিন ঠিক হলো। তবে এবার প্রপেলার আর ইঞ্জিন আগের মতো কাজ করতে পারছে না। ঠকর ঠকর করে একটা আওয়াজ হয়েই চলছে। এবার সর্বোচ্চ ৫ মিনিট ট্রলার চলতে পারলো। তারপর প্রপেলার ও ইঞ্জিন দুটোই নষ্ট। সাগরের সব চাইতে ভয়ঙ্কর রূপটি তখনই দেখলাম।

গরম বাতাস শুরু হলো। এবার প্রথমবারের মতো আমি সত্যিই ভয় পেলাম। গরম বাতাস মানে ঘূর্ণিঝড় আরম্ভ হতে যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় মানে উদ্ধারকারী ট্রলার কোনোভাবেই এদিকে আসবে না। ঘূর্ণিঝড় শেষ হলেই কেবল হয়তো তারা আবার আমাদের খুঁজতে বের হবে। কিন্তু তখন আমাদের খুঁজে কোনো লাভ নাই।

এবারের ঢেউগুলো অনেক বেশি বড়। এক একটি বিশাল ঢেউ (১৫-২০ ফিট উঁচু হবে) আসছে, আমাদের ট্রলার ধীরে ধীরে ডান দিকে কাত হওয়া শুরু করেছে। ডান দিকে কাত হতে হতে ছলাৎ করে একগাদা পানি নৌকার মধ্যে ঢুকে পড়লো। তারপর ট্রলার ধীরে ধীরে সোজা হলো। তারপর আরেকটি বিশাল ঢেউ আসছে, আমাদের ট্রলার আবার ধীরে ধীরে ডান দিকে কাত হওয়া শুরু করেছে। ডান দিকে কাত হতে হতে আবার ছলাৎ করে একগাদা পানি নৌকার মধ্যে ঢুকে গেলো। তারপর আবার ট্রলার ধীরে ধীরে সোজা হলো। নৌকার ডান দিকে বসে আছে রিমা, আদনান, সানোয়ার আর শুভ। ওদের মানসিক অবস্থা যে কি, আল্লাই জানে। মাঝির সহযোগীরা ক্রমাগত পানি সেচে যাচ্ছেন।

অসহায় মাঝি মালিক শুক্কুর আলীকে ফোন দিয়ে বললেন, ‘ভাই এটা আপনি আমারে কই পাঠাইলেন!' এরপর আমাদের বললেন, ‘ভাই আপনেরা একটু নেভির সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’ আবার ফোন গেলো হিমেল আর স্বর্ণার কাছে। ওদের বললাম, ‘ভাই, আমরা সত্যিই ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছি। একটু সাহায্য করো।’ হিমেল-স্বর্ণা আবারো সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া দিলো। নেভির হেড অফিস থেকে সেন্টমার্টিনের কোস্টাল গার্ডে ফোন গেলো। তাছাড়া দু'জনেই তাদের লোকাল কন্টাক্ট রনির ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করলো। রনি ভাই যোগাযোগ করলেন কিশোরের মোবাইলে। রনি ভাই বারবারই জিজ্ঞেস করছিলেন, আমরা আনুমানিক কোন জায়গাটায় আছি? ওনারা আমাদের খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আমিও এর উত্তরে বারবারই বলতে লাগলাম, ‘আমরা মূল সাগরের দিকে চলে যাচ্ছি।’

হঠাৎ করে মনে হলো, আরে আমার কাছে তো অনেক শক্তিশালী একটি টর্চ আছে, আমি সেটা কেন বের করছি না। আমার বসার জায়গা থেকে উঠে হামাগুড়ি দিয়ে ব্যাগের দিকে এগোতে লাগলাম। এ সময়ই আচমকা ঢেউ আছড়ে পড়লো। হঠাৎ আমি নিজেকে শূন্যের মধ্যে দেখলাম। মাহি, কঁচি মাথার দিক থেকে আর বাবু পায়ের দিক থেকে শূন্যে থাকা আমাকে ধরার চেষ্টা করলো। সবাইকে ফাঁকি দিয়ে আমার উড়ন্ত শরীর আরেকটু সরে গেলো।

একটা সময় ক্রিকেট খেলতাম। তখন নিজের রিফ্লেক্স প্রাকটিস করতাম। সেটা এবার কাজে দিলো। হাত আর পা দিয়ে ট্রলার ছোঁয়ার চেষ্টা করলাম, বিষয়টা কাজে দিলো। হাতটা ট্রলারের ডেকে হালকা স্পর্শ করাতে উড়ে গিয়ে পড়লাম ইঞ্জিন রুমে। কয়েক মিলি সেকেন্ডের মধ্যে নিজেকে ব্যালেন্স করে ফেললাম। তারপর সেখান থেকে উঠে ব্যাগ থেকে আমার টর্চটি বের করলাম। হলিউডের দেখা সিনেমার মতো টর্চ জ্বালাতে আর নেভাতে লাগলাম। নেভির দুইটি উদ্ধারকারি দলের একটিও যদি আমাদের দেখে তাতেও রক্ষা।

সাগরের অতিরিক্ত রোলিংয়ে অনেকেই ইতোমধ্যে বমি করেছে। বমি করলে মাথা হালকা হবে, তাই যাদের বেশি খারাপ লাগছিল তাদের বমি করে ফেলতে বললাম। আমারও মাথা ঘোরান শুরু করেছে। একটা মানুষ আর কতক্ষণ পারে! একবার ভাবলাম বমি করেই দেই। হঠাৎ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, না, আমি বমি করবো না। নিজের কনসেনট্রেশন অন্য দিকে সরিয়ে দিলাম। বিষয়টা কাজে দিলো।

দুপুর ১২টার সময় ট্রলারে উঠেছি, এখন ৯টার মতো বাজে। ট্রলারে টয়লেটের কোনো ব্যবস্থা নাই। একেকজনের ব্লাড়ার ফেটে যাচ্ছে। রোলিং এত বেশি যে, কিছুই করার নাই। ইতোমধ্যে হিমেল, স্বর্ণা আর রনি ভাইয়ের সাথে ক্রমাগত কথা হচ্ছে। হিমেল আর স্বর্ণা আমাদের বারবারই আস্থা দিয়ে যাচ্ছে। রনি ভাই আমাদের অবস্থান তখনো খুঁজে পাচ্ছেন না। রনি ভাই জানালেন, তারা আমাদের খুঁজে পাচ্ছেন না। আমরা যদি আমাদের অবস্থানটা একটু পরিষ্কার করি... কিন্তু সেটা কীভাবে করবো। অন্ধকারে বুঝতে পারছি না আমাদেরে অবস্থান।

তারপরও রনি ভাইকে বললাম, রনি ভাই, আমরা সাগরের দিকে আছি। সেন্ট মার্টিন আমাদের বাম দিকে। আমার বাম দিক বললে আপনি কি বুঝবেন! আমার সেন্ট মার্টিনের নেভির জাহাজের আলো দেখতে পাচ্ছি। হয়তো ৩০-৪০ মিনিটের পথ। আচ্ছা আপনাদের সাথে এমন কিছু নাই, যাতে আমরা আপনাদের অবস্থান বুঝতে পারি। আমাদের সাথে টর্চ আছে। আমরা টর্চ জ্বালাচ্ছি-নেভাচ্ছি। আমরা যদিও অনেক দূরে, তারপরও দেখেন, আমাদের আলো দেখতে পারেন কিনা। ভাই আমি আপনাদের দেখতে পাচ্ছি না। কোনো আলোও দেখেতে পাচ্ছি না। আচ্ছা দাঁড়ান দাঁড়ান, সম্ভবত আপনাদের দেখেছি। হ্যাঁ, আপনাদের দেখেছি। চিন্তা করবেন না, আপনাদের ওখানে আমাদের ট্রলার যাচ্ছে।

এরপর বেশ কিছুক্ষণ আমি বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকলাম। কি অদ্ভুত রকমের একটা অনুভূতি কাজ করতে লাগলো। অবশেষে কোস্টাল গার্ড সাগরে আমাদের অবস্থান নিশ্চিত করতে পেরেছে। আমরা তাহলে আমাদের গন্তব্যে ফিরতে পারছি। আহ্ বেঁচে থাকা কী আনন্দের! সবাই জিজ্ঞেস করলো, কি বলবো, আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। এত বড় একটা সুখবর অথচ আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছি। আমি ক্রমাগত টর্চ জ্বালিয়ে- নিভিয়ে সিগন্যাল দিয়েই যাচ্ছি। মিনিট পাঁচেক পরে আস্তে করে সবাইকে সুখবরটা দিলাম।

কতক্ষণ পর জানি না, তবে বেশ কিছুক্ষণ পর উদ্ধারকারী ট্রলার আসলো। আমাদের ট্রলারের সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা হলো সেই ট্রলারটি। আমরা রওনা হলাম দ্বীপের উদ্দেশ্যে। অনেক পরিশ্রমের পর শরীরজুড়ে যেমন একটা অবসাদ কাজ করে, আমার শরীরজুড়েও সে রকম অবসাদ ভাব হতে লাগলো। অনেক মানসিক চাপ নিয়েছি। আমাদের একেকজনের নার্ভ কতটা প্রেসার নিতে পারে আজ তা প্রমাণ হয়ে গেছে। মানুষের সহ্যের সীমা যে এতটা তা আগে কখনো জানা ছিল না।

বৃষ্টি ক্রমাগত পড়েই চলছে। মিনিট ১৫ পরে আমাদের উদ্ধারকারী ট্রলারের তেল ফুরিয়ে গেলো। এখন আমরা কেউই তেমন কিছু বললাম না। কারণ, আমরা এর চাইতে অনেক বেশি মানসিক চাপ নিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। দড়ি টেনে দুটি নৌকাকে পাশাপাশি দাঁড়া করিয়ে আমাদের ট্রলার থেকে উদ্ধারকারী ট্রলারে তেল দেওয়া হলো। আবার রওনা হলাম আমরা। ৫ মিনিট পরে এবার ছিড়লো দুই নৌকার মাঝে সেতু বন্ধন দড়িটি। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সব সমস্যা ঠিক করে আমরা আবার রওনা হলাম।

অবশেষে রাত ১০টা ১৮ মিনিটে পৌঁছালাম সেন্টমার্টিনে। উদ্ধারকারী ট্রলারটি দড়ি খুলে তার নিজের গন্তব্যের দিকে চলে গেলো। উত্তাল সাগর, বৃষ্টি চলছে, ইঞ্জিন নষ্ট, ট্রলার জেটিতে না ভিড়িয়ে পাড়ে ভেড়াতে হলো। কিশোর আর রাইসুল রাগে ফেটে পড়লো, ট্রলার জেটিতেই ভেড়াতে হবে। ওদের উত্তজনা কিছুটা কমার পরে আমি বললাম, এখানে হয়তো আমাদের কোমর পানিতে নামতে হবে। আমরা এখানেই নামি। কারণ আল্লাহ না করুক, দেখা গেলো ট্রলার জেটিতে ভেড়তে গিয়ে আবার যদি আমরা সাগরে হারিয়ে যাই, তখন কি হবে!

সবাই পরিস্থিতি বুঝতে পারলো। শুভকে প্রথমে নামতে বলে বাকিদের সাহায্য করতে বললাম। সবাই নামার পর শেষবারের মতো মালপত্র চেক করলাম আমি আর আদনান। তারপর ঝুপ করে যখন পাড়ে নামলাম, তখন সেখানে কোমর সমান পানি। চোখের নিমিষে এক ঢেউ এসে বুক পর্যন্ত পানিতে ভিজিয়ে দিলো। হঠাৎ মনে হলো, হায় আল্লাহ্ পকেটে মোবাইল আর মানিব্যাগ! কোনো রকমে দৌড়ে পাড়ে আসার চেষ্টা করলাম। ততক্ষণে কর্ম সারা। মোবাইল বন্ধ হয়ে গেলো।

পাড়ে এসে অদ্ভুত একটা জিনিস দেখলাম। এ ঝুম বৃষ্টিতে ৩০/৪০ জন মানুষ আমাদের অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। এর মধ্যে থেকে একজনে জানতে চাইলেন, আপনি শাওন ভাই। হ্যাঁ। আমি লেফটেনেন্ট হাবিব (হাত বাড়িয়ে)। আপনারা নিরাপদ আছেন তো? জি, আমরা নিরাপদ আছি। আপনাদের কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ। আমরা সত্যিই ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছিলাম। আপনারা যে ভাবেই থাকেন না কেন, আমরা অবশ্যই আপনাদের উদ্ধার করতাম। ধন্যবাদ।

লেফটেনেন্ট হাবিবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা রওনা হলাম হোটেলের দিকে। ট্যুরের বাকি অংশ ছিল আরও বেশি অসাধারণ। আমাদের জীবনের অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ ট্যুর হয়েছে এটি। প্রতিটি মুহূর্তেই আমরা আনন্দ করেছি, বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করেছি, মাটি-কাদার সাথে গড়াগড়ি করেছি, চুটিয়ে আড্ডা মেরেছি, গভীর রাতে ভূতের গল্প শুরু করেছি, ঢাকায় যে একটি জীবন আছে একবারের জন্যেও মনে পড়েনি।

সেসব গল্প না হয় আরেকদিন হবে...।

মেসবাহ/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়