ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মানুষগুলোর সঙ্গে আর কোনো দিন দেখা হবে না

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫৭, ৩০ মার্চ ২০২২   আপডেট: ১৩:০২, ৩০ মার্চ ২০২২
মানুষগুলোর সঙ্গে আর কোনো দিন দেখা হবে না

এমাদাসি কেওয়াদাসি: ২য় পর্ব

ভোরে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় নামতেই সব কিছু ছাড়িয়ে চোখের সামনে ধরা দিলো পাহাড়ের সারি আর তাকে জড়িয়ে অলস পড়ে থাকা সাদা মেঘের দল। পহাড়বেষ্টিত ছোট্ট শহর থিম্ফু। জায়গাটার নাম ক্লক টাওয়ার রোড। মূলত এটাকেই থিম্ফুর প্রাণকেন্দ্র ধরা হয়। যেতে যেতে রাস্তাটা সামান্য উঁচুতে উঠে গেছে। একটা পর্যায়ে পথের ধার থেকে নেমে গেছে গ্যালালির সিঁড়ি। তারপর ছড়ানো চত্বরটার প্রান্তে একটা উন্মুক্ত মঞ্চ। মঞ্চের পিছনে বিশ থেকে পঁচিশ ফুট উঁচু একটা কলাম। কলামের চার দিকে চারটা ঘড়ি সংযুক্ত করা। এর জন্যই এলাকার নাম ‘ক্লক টাওয়ার’ রোড।

ভবনগুলোর উচ্চতা ছয়তলার অধিক নয়। শতভাগ ভবনে স্থানীয় নির্মাণশৈলীর ছোঁয়া। খোঁজ করতে করতে পৌঁছে গেলাম শহরের কেন্দ্রীয় কাঁচা বাজারে। ক্লক টাওয়ার রোডের একটা পর্যায় থেকে নিচের দিকে নেমে গেলে শহরের এক কোণায় বাজারটি অবস্থিত। ভেতরে ঢোকার আগেই এক সারি ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট। তার মধ্যে একটাতে গিয়ে বসে পড়লাম। সাজসজ্জা আর খাবারের পদ প্রকার দেখে ভালোই লাগলো। স্থানীয়রাই এসব রেস্টুরেন্টের খরিদ্দার। মাঝাড়ি আকারের ঘর আর তাতে সাত থেকে আটজন মানুষের বসার ব্যবস্থা। মালিক একজন নারী। খরিদ্দারের টেবিলে খাবার পৌঁছে দেওয়া এবং রান্নার কাজ নিজ হাতে করে থাকেন। 

সহযোগিতার জন্য একজন লোক রাখা আছে। বাংলাদেশ থেকে এসেছি জানার পর সমাদরের কমতি রইল না। শো-কেসের মধ্যে অন্যান্য খাবারের পাশে সাজিয়ে রাখা ডুবো তেলে ভাজা বড় আকারের একেকটা লুচি পরোটা। লুচির সাথে পরিবেশন করলেন এক বাটি সবজি এবং পূর্ণ এক টেবিল চামচ লাল মরিচের ভর্তা। ঝাল আমি যথেষ্ট খেতে পারি কিন্তু পাতে একসাথে এত মরিচ ভর্তা দেখে আঁৎকে উঠলাম। অভয় দিয়ে বললেন, কোনো সমস্যা নেই খেতে পারবেন। সত্যি তাই মরিচে ঝাল খুবই কম। এমন ভর্তা দিয়ে অনায়াসে দুই-তিনটা লুচি খেয়ে ফেলা সম্ভব। খাওয়া আর কথা একসঙ্গে দুটোই চললো। সব শেষে এক মগ চা। চায়ে লিকার কম, চিনি এবং দুধে পূর্ণ। গল্প জমে ওঠায় চায়ের সাথে পরিবেশন করলেন এক মুষ্টি থেতো করা ভুট্টা। বললেন চায়ে ডুবিয়ে চামচ দিয়ে তুলে খেতে ভালো লাগে। 

আমার যে এই সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষায় কোন সমস্যা নেই তা তিনি আগেই ধরতে পেরেছেন। কারণ, তাদের রেস্টুরেন্টে কখনও কোন পর্যটক খেতে আসে না। সেই আনন্দে বিল পরিশোধের সময় চায়ের দাম রাখলেন না। বললেন, আমার রেস্টুরেন্টে আসার জন্য চাটুকু উপহার হিসেবে গণ্য করবেন।

থিম্ফুর প্রথম সকালটা সুন্দর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শুরু হলো। অর্জিত অভিজ্ঞতা রোমন্থন করতে করতে ফিরে এলাম হোটেলে। দেখি একজন পরিচ্ছন্নকর্মী সামনের ঘর সাফ সুতরো করছে। উঁকি দিয়ে দেখি ভিতরে কেউ নেই। জানতে চাইলে বলা হলো, তারা অন্যত্র চলে গিয়েছে। সংবাদটা শোনার পর বাচ্চাদের জন্য কেনা বিস্কুটের প্যাকেট দুটো যেন মুহূর্তের মধ্যে পাথরের মতো ভারি হয়ে গেল। ঘড়িতে লক্ষ্য করি সকাল দশটা পেরিয়ে গিয়েছে। আসার পথে দুটো হোটেলও দেখে এলাম। ভাবলাম বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে হোটেল খোঁজাখুঁজি বড় ঝামেলার বিষয়। চাইলে আমার সাথে তারাও উঠে পড়তে পারবে। সকাল সকাল অহেতুক ডাকাডাকি করিনি, ঠিক করে রেখেছিলাম ফিরেই দেখা করবো। চেঙড়াবান্ধা থেকে জয়গাঁ, সেখান থেকে থিম্ফু। এতটা পথ একসাথে এলাম। অথচ, ফোন নম্বরটা পর্যন্ত নেয়া হয়নি। থিম্ফুর পথেই যদি কাকতালীয়ভাবে দ্বিতীয়বার দেখা না হয় তাহলে মানুষগুলোর সঙ্গে আর কোনো দিনই দেখা হবে না! পনেরো মিনিট পর ভারাক্রান্ত মনে ব্যাগ বোচকা সমেত নিজেও বেরিয়ে পড়লাম। 

আমার নতুন থাকার জায়গার নাম জেদেন লজ। ঘরটা পছন্দ করার একমাত্র কারণ তা থেকে দেখা মনোরম দৃশ্য। চারতলা ভবনের সবশেষ তলার ছোট্ট ঘরটা আমার। এটাচ্ড বাথরুম টয়লেট কোনোটাই নেই তবুও ঘরটা আমার পছন্দ। সম্মুখের সম্পূর্ণটাজুড়ে কাঁচের দেয়াল। কাঁচ সরিয়ে দিলে পাহাড়ের দীর্ঘ সারি যেন আমার ঘরের মধ্যে। পাহাড়ের গায়ে হাতে গোনা কয়েকটা বাড়ি। নিচ দিয়ে দুই থেকে তিন স্তরের রাস্তা। ঠিক তার নিচ দিয়ে বয়ে গিয়েছে খরস্রোতা নদী। নদীর এপাড়ে পাশাপাশি জাতীয় স্টেডিয়াম ও আর্চারী গ্রাউন্ড। মাঝে শুধু একটা সড়ক। সড়কের উপরেই আমার ঘর।

সম্পূর্ণ আর্চারী গ্রাউন্ড আমার ঘরের সামনে। লজের সামনের সড়ক থেকে বুদ্ধের মূর্তিটা স্পষ্ট দেখা যায়। সবুজের মাঝ থেকে সোনালি রঙে বেরিয়ে আছে ধ্যানমগ্ন গৌতম বুদ্ধ। স্থানীয়রা জায়গাটাকে ‘বুদ্ধা পয়েন্ট’ বলে থাকে, পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত হওয়ার সুবাদে শহরের অধিকাংশ জায়গা থেকেই দৃষ্টি গোচর হয়। বেলা দুইটায় হাঁটা শুরু করলাম বুদ্ধা পয়েন্টের উদ্দেশ্যে। লোকেরা সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলো কিভাবে যেতে হবে। তবে সকলের মতামত গাড়ি নিয়ে যাওয়াটা সুবিধাজনক। আমি পাহাড় পর্বত ঘুরে বেড়ানো মানুষ। তাছাড়া, হাতে সময়ও অজস্র। ব্যস্ত সড়ক ছেড়ে নিরিবিলিতে প্রবেশের পর দেখা হলো একজন ক্রীড়াবিদের সঙ্গে। অনুর্ধ্ব আঠারো কি উনিশ জাতীয় বাস্কেট দলের খেলোয়াড়। প্রতিদিন ভোরে তিনি এ পথেই জগিং করেন। হেঁটেই যাচ্ছি দেখে সাধুবাদ জানালেন। পরামর্শ দিলেন, দিনের বাকি সময়ের মধ্যে সেখানে গিয়ে আবার ফিরে আসা সম্ভব নয়। সুতরাং, পরের দিন ভোরে শুরু করা উত্তম হবে। তাতে পর্যাপ্ত সময় যেমন থাকবে তেমনি রোদও কম থাকবে। অধিকন্তু, তার সাথে দেখাও হয়ে যেতে পারে।

আমার দুই তিনদিন পরের গন্তব্য পুনাখা। সীমাবদ্ধ এলাকা হওয়ায় বিদেশি পর্যটকদের ক্ষেত্রে অভিবাসন বিভাগ থেকে অনুমতি নিতে হয়। সময় যেহেতু পেয়ে গেলাম তাই অনুমতিপত্র নিয়ে নেয়া যেতে পারে। ক্লক টাওয়ার রোডের শেষ প্রান্তের দিকে অভিবাসন কার্যালয়। সাদামাটা দুই ঘরের ছোট্ট কার্যালয়। দিনের কার্যক্রম শেষে কার্যালয় প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তাই পরের দিন যেতে বলা হলো। সোজা গিয়ে প্রবেশ করলাম কাঁচা বাজারে। বেশ বড় স্থাপনার দুইতলা বাজার। লোক সমাগম খুবই কম। যারাও আছে তারা হয় ক্রেতা নয়তো বিক্রেতা। সারা বাজারে বোধহয় আমিই একমাত্র উটকো লোক। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কথা বলাবাহুল্য। নিচের একটা অংশে কাঁচা তরিতরকারি এবং শাকসবজির দোকান, অপর অংশে শুধু ফলমূল। সমস্ত ফল স্থানীয়। ঝুড়ি ভর্তি ফলের পসরা দেখে চোখ জুরিয়ে গেল। প্রতিটি ফল একেবারে তাজা, যেন অল্পক্ষণ আগেই গাছ থেকে পেড়ে আনা। একই ফলের একাধিক প্রকার। 

বিক্রেতার পরামর্শে সবচেয়ে সুস্বাদু হবে এমন এক কেজি আপেল ও এক কেজি প্লাম কিনলাম এবং তখন থেকেই খাওয়া শুরু করে দিলাম। প্রতিটা দোকানের বিক্রেতা নারী। তাদের মধ্যে কেউ কেউ শিশু সন্তান পিঠে বেঁধে নিয়ে বেচাকেনায় ব্যস্ত। আবার ক্রেতা বিক্রেতার সন্তানেরা দুই-তিনজন জড়ো হয়ে নিজেদের মত দৌড় ঝাপ আর খেলায় ব্যস্ত। নিচতলা ঘোরা শেষে উঠে গেলাম উপর তলায়। উপর তলার সম্পূর্ণটা শুধু হরেক প্রকার মশলা আর শুকনা জিনিসপত্রের পসরা। এর মধ্যে শুকনা মরিচকে সব থেকে মূল্যবান পণ্য মনে হলো। বহু প্রকার মরিচ, শুকিয়ে লাল হয়ে আছে। সামান্য নাড়াচাড়াতেই ঝনঝন করে বেজে ওঠে। ভুটানের মরিচ আকারে পাঁচ-ছয় ইঞ্চি লম্বা। ঝাল নেই বললেই চলে। প্রতি কেজি তিন-চারশো থেকে শুরু করে দেড় হাজার গুলট্রাম পর্যন্ত। গুড়া মরিচ এবং ফ্লেক্স করা মরিচের প্রদর্শনী দেখে সহজেই অনুমান করা যায় তার চাহিদা কতটা। 

ঘুরতে ঘুরতে রাতের খাবারের সময় হয়ে গেল। নিচতলায় নেমে পরিচিত রেস্টুরেন্টটাতেই ঢুকে পড়লাম। বৈচিত্রময় খাবারের প্রতি কৌতূহলের ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমাকে বসিয়ে রেখে সামনেই রান্না করা হলো ভুটানের সবচেয়ে প্রচলিত ও জনপ্রিয় তরকারী এমাদাসি। রান্নার প্রধান উপকারণ বড় বড় মরিচ এবং পনির। সর্বসাকুল্যে বিশ থেকে পঁচিশ মিনিটে রান্না হয়ে গেল। সাদা এবং ঘন ঝোলের মধ্যে সবুজ রঙের  মরিচে সুস্বাদু এমাদাসি। ঘটনাটা অতি সাধারণ তবে আমার কাছে অনেক বড় একটা অভিজ্ঞতার মতো।  তার চেয়ে বড় বিষয় তাদের আন্তরিকতা। খাওয়া শেষ না হতেই বাজার এলাকায় নেমে এল নিস্তব্ধতা। সারা দিনে অর্জন করা টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা আর অনুভূতিগুলো সঙ্গে নিয়ে লজের দিকে পা বাড়ালাম। (চলবে)  

পড়ুন প্রথম পর্ব: ৮ বছরের পরিকল্পনায় আমার ভুটান-ভ্রমণ

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়