ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সৈকতের নাম নিমতলী

হোমায়েদ ইসহাক মুন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪৮, ২০ জুলাই ২০২২  
সৈকতের নাম নিমতলী

মনপুরার চরে ছড়িয়ে পড়ছে ভোরের আলো

সন্ধ্যা ছয়টা। এম ভি তাসরিফ-২ সদরঘাট থেকে ছেড়ে যাচ্ছে। ঠিক এক মিনিট আগে লঞ্চে গিয়ে উঠলাম। আমার জন্য অপেক্ষায় ছিল বন্ধু মনোয়ার আর সজিব ভাই। হাতিয়ার তমুরুদ্দিন ঘাটে এই লঞ্চ গিয়ে পৌঁছবে ভোর ৬টায়। 

লঞ্চে একটা ডাবল কেবিন আর সিঙ্গেল কেবিন নেওয়া হলো। ভাড়া  ২২০০ এবং ১২০০ টাকা৷ রাতে খেলাম মাছ আর মুরগি, সঙ্গে ডাল চচ্চরি। লঞ্চের খাবার বেশ মজার। ভোরে ঘুম ভেঙে দেখলাম মনপুরার চরে লঞ্চ ভেড়ানো। ভাটা শুরু হয়েছে। অনেক বছর আগে মনপুরাতে এসেছিলাম আমার ভ্রমণের দল বিটীইএফ-এর সঙ্গে। স্মৃতিগুলো সব মাথায় জমা হতে থাকলো। এখানে কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে জানা নেই। যাত্রীরা কেউ কেউ সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য দেখতে চরে নেমে পড়েছে। 

লঞ্চ ঘাটে গিয়ে ভিড়লো বেলা ৮টায়। আমাদের টাইম শিডিউলের বারোটা বেজে গেলো! অল্প সময়ে বেশ কয়েকটা জায়গায় যাবার কথা। রেইনড্রপ এন্টারপ্রাইজ-এর কর্ণধার মানজুরুল ইসলাম আমাদের এমন নির্দেশনা দিয়ে এখানে পাঠিয়েছেন। এ অঞ্চলে টেকসই পর্যটন উন্নয়নে কিভাবে কাজ করা যায় সে ব্যাপারে তার বেশ আগ্রহ রয়েছে। আমরা জায়গাগুলো ঘুরে দেখে তাকে বিশেষজ্ঞ মতামত জানাব। 

তমুরুদ্দিন ঘাট থেকে মনপুরাতে ফেরার কথা ছিল বেলা একটায়। নিমতলী বিচ ঘুরে দেখে ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছে রাত হয়ে যাবে। এবেলা এখানটায় থেকে যেতে হবে। তমুরুদ্দিন ঘাটে সকালের নাস্তা করে সিএনজিতে রওনা হলাম। জন প্রতি ১০০ টাকা করে নামলাম সেন্টার বাজার, সময় লাগলো এক ঘণ্টা। সিএনজি স্কুটারে একজন পৌড় ছিলেন, তিনি আমাদের হাতিয়ার নানা ব্যাপারে গল্প করলেন। এই হাতিয়া এক সময় প্রায় জনশূন্য ছিল। পুরনো হাতিয়া যখন নদী ভাঙনে বিলীন হলো তখন সত্তরের দশক থেকে মানুষ এই নতুন হাতিয়াতে এসে বসবাস করা শুরু করলো। এ অঞ্চলের আয়তন প্রায় ৩৭১ কিলোমিটার। ভবিষ্যতে হাতিয়ায় এয়ারপোর্ট হবে এবং অবকাঠামগত উন্নয়নসহ পর্যটনের নানা সম্ভাবনা আছে বলে আমাদের তিনি জানালেন। 

 ফুটবল খেলার বিশাল আয়োজন 

সবুজে ঘেরা কাঁচাপাকা গ্রামীণ রাস্তা পেরিয়ে গল্প করতে করতে আমরা সেন্টার বাজার পৌঁছলাম। সেখানে সজিব ভাইয়ের বন্ধু জামশেদ তার দোকানে বসালো। স্থানীয় মেম্বার মিরাজ আর সেলিম ভাইয়ের সাথে পরিচয় হলো। তারা আমাদের নিমতলির বিচের দিকে নিয়ে গেলেন মোটরবাইকে। স্থানীয় নাম ‘বিরবিরি’। রাস্তা প্রায় দশ কিলোমিটারের কম হবে না। বাইকে জনপ্রতি ভাড়া লাগে আসা-যাওয়া ২০০ টাকা করে। সেন্টার বাজার থেকে কাঁচা রাস্তা চলে গেছে লোকালয়ের শেষ সীমানা পর্যন্ত। কেওড়া বাগান পার হলে, চোখ জুড়ানো বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ। দূরে গরু-মহিষ চরে বেড়াচ্ছে মনের সুখে। মটরবাইক এই মাঠ ধরে এগিয়ে চলেছে বহুদূর অবধি। একটা খালে বাইক থামালো, ছবি তুললাম। 

এখানে বাইসাইকেল বা মোটরসাইকেলে চলতে বেশ থ্রিল পাওয়া যাবে। সেলিম ভাইয়ের বাইকে চড়ে এর মধ্যে তেমনটাই থ্রিল নিয়ে নিলাম। তিনি নিমতলি বিচ কমিটির দায়িত্বে আছেন। তার কাছ থেকে জানলাম, এই বিচে ছুটির দিনে স্থানীয় হাতিয়ার পর্যটক আসেন প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার। বিচটা বেশ শান্ত আর নিরিবিলি। একটা শান্তি শান্তি ভাব আছে। ঢেউ আর হিমেল হাওয়ায় দেহ মনে শিহরণ জাগে। এক ঝাক পাখি মাথার উপর দিয়ে দূর সীমানায় উড়ে গেলো। এইসব অঞ্চলে শীত মৌসুমে নানা প্রজাতির অতিথি পাখিদের বিচরণ হয়। পাখিপ্রেমীরা এদিকটায় এলে বেশ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা পাবেন। 

বিস্তৃত মাঠ পার হয়ে বিচে চলে যাওয়ার জন্য ইটের রাস্তা করে দেওয়া হয়েছে স্থানীয় প্রশাসন থেকে। বসার জন্য ছাতা আর আরাম চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনজন তিন মটরসাইকেলে করে বিচে এসে দাঁড়ালাম। বেলা বেড়ে গেছে তাই তাপও ভয়ানক। তারপরও সৈকতের হাওয়ায় তখন আর তাপের তারতম্য বুঝতে পারছি না। পা ভেজাতে খানিক সামনে এগিয়ে গেলাম। রোদের তীব্র আলোতে বালু চিকচিক করছে। লাল কাকড়ার আনাগোনা দেখা গেলো। বাইকের শব্দে তারা লুকিয়েছে। সামনে এগিয়ে গেলাম যদি কাছ থেকে দেখতে পাই। এত সুন্দর আঁকিবুঁকি করে রেখেছে বালিয়াড়িতে, শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় যেন ক্যনভাস ভরে উঠেছে। একটু অপেক্ষার পরেই লাল কাঁকড়া মাথা তুলে উঁকি দিলো। কী অদ্ভুত সুন্দর তাদের গায়ের রঙ! বিধাতা যেন লাল সিঁদুর ঢেলে দিয়েছে গায়ে। খুব কম জায়গায় এমন দল বেঁধে লাল কাঁকড়ার দেখা মেলে। ঢালচরে এমন লাল কাঁকড়া দেখে বেশ মুগ্ধ হয়েছিলাম! মিছিলের মতো হাজার হাজার কাঁকড়া বের হয়ে ছুটতে শুরু করেছিল। এমন সুন্দর দেখার জন্য দূর দূর যেতেও ক্লান্তি লাগে না। বিচ ধরে হেঁটে হেঁটে অনেক দূর পর্যন্ত যাওয়া যায়। দুপুরের তপ্ত রোদে বেশি না হেঁটে বিকেলের জন্য তুলে রাখলাম। 

বিচের কাছেই বড় জায়গা নিয়ে ফুটবল খেলার জন্য স্টেডিয়াম বানানো হয়েছে। হাতিয়ার খেলোয়াড়দের নিয়ে টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছে গতকাল থেকে। এই জায়গাটা বেশ জমজমাট। সঙ্গে পিকনিক পার্টি তো আছেই। জোরে শব্দ করে তারা গান বাজাচ্ছে। কিছু অস্থায়ী দোকানপাট হয়েছে। দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা বিচের দিকে গেলাম। নিমতলী সৈকত পার হয়ে একটা খাল আছে, ওপাড়ে গেলেই নিঝুম দ্বীপ। এখানে পর্যটনের আরো উন্নতি হলে ভবিষ্যতে নৌকার ব্যবস্থাও থাকবে। মানুষের আনাগোনা যেভাবে বাড়তে শুরু করেছে, অদূর ভবিষ্যতে এই জায়গায় অনেক অবকাঠামো গড়ে উঠবে। নিমতলী বিচের পাশেই দমার চরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জায়গা নির্বাচন করা হয়েছে। বিচের কাছেই কোস্ট গার্ডের জায়গা নির্ধারিত আছে। নিরাপত্তার জন্য টুরিস্ট পুলিশের ফাড়ি করার প্রস্তাবনা আছে। সুতরাং এখানে নিরাপত্তা নিয়ে অতিথিদের বেশি একটা মাথা ঘামাতে হবে না।

 নিমতলি বিচ ধরে নিভৃত পথে হেঁটে চলা

স্থানীয়দের থেকে জানলাম,  এখানে জলদস্যুর এখন আর প্রকোপ নেই। হাতিয়া অঞ্চলের মানুষের প্রধান পেশা মৎস্যজীবী, এরপর প্রবাসী। তাই অর্থনৈতিকভাবে এই অঞ্চলের মানুষ কিছুটা সচ্ছল বলা চলে। খাবারের মধ্যে এখানে প্রসিদ্ধ বিভিন্ন ধরনের পাকন পিঠা, খেজুরের গুড়, মধু, শীতল পাটি এবং শুঁটকি। কমিউনিটি টুরিজমের ক্ষেত্রে স্থানীয় খাবার এবং সংস্কৃতি বেশ গুরুত্ব বহন করে। আগামী দুই বছরের মধ্যে নিমতলী বিচের কাছে বিদ্যুৎ-এর লাইন চলে আসবে। তখন অবকাঠামো থেকে শুরু করে রাস্তারও বেশ উন্নতি হবে বলে আশা করছেন স্থানীয় জনগণ এবং প্রশাসন। পরিচিত হলাম নিমতলীর চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মো. মাসুম বিল্লাহর সঙ্গে। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বললেন। খেলা দেখতে আমন্ত্রণ জানালেন।

আমরা দুপুরে খাবারের পর টুর্নামেন্ট দেখতে গেলাম। গ্রামের ফুটবল খেলায় বেশ উৎফুল্ল আর উত্তেজনা থাকে। বিশ টাকা করে টিকেট কেটে সবাই গ্যলারিতে খেলা দেখতে বসেছে। খেলা দেখতে দলের সমর্থকদের মধ্যে নানা ধরনের গুঞ্জন চলতে থাকে। গোধূলী লগ্নে আবার বিচের দিকে হেঁটে যাই। মাথার উপর বাাঁশ-বাগানের চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। হিমেল বাতাসে জলের আছড়ে পড়ার শব্দ আমাদের মোহিত করলো। হেঁটে হেঁটে  অনেক দূরে চলে যাওয়া যায় ক্লান্তিহীন। ফিরে এলাম জাহাজমারা বাজারে। জাহাজমারাকে এক সময় বলা হতো জাহাজ্যার চর। যা এখন জাহাজমারা নামেই পরিচিত। এই বাজারেই আজকের রাতটা কাটিয়ে দিলাম। থাকার মতো  তেমন ভালো হোটেল পেলাম না, শেষে চিত-কাইত বোডিং-এ মানে কোনোমতে রাত কাটানো যায় এমন একটা জায়গায় থাকতে হলো। 

ভোরের আলো ফুটলে আমরা ঘাটের দিকে রওনা হলাম। বেলা বারোটার মধ্যে লঞ্চ ছেড়ে দেবে, তবে লঞ্চ ঘাটে ভেড়াতে পারছে না পানি কম থাকার কারণে। সাম্পান নৌকায় অপেক্ষমাণ যাত্রীদের চড়ে বসতে হলো। ঘণ্টা পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু লঞ্চের দেখা মিলছে না। বেশ দূরে গিয়ে লঞ্চের দেখা পেলাম। মাঝ দরিয়াতে ততক্ষণে ঢেউ আর হাওয়া দিতে শুরু করেছে। সবার চেহারা কিছুটা উদ্বিগ্ন। যাত্রী বোঝাই সাম্পান নৌকা আর লঞ্চ একসঙ্গে চলছে। লাফ দিয়ে লঞ্চে উঠতে হবে। এমনভাবে কখনো উঠি নাই। মনোয়ার বেশ ভয় পেয়ে গেলো। একে একে মহিলা শিশু সবাই উঠে গেলো আর এ যাত্রায় হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।  

ছবি: লেখক

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়