ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

রুপালি ইলিশের দেশে

ফসয়াল আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩৫, ২৬ জুলাই ২০২২  
রুপালি ইলিশের দেশে

২৫ বছর পূর্বের চাঁদপুর 

বাঙালির রসনা তৃপ্তির জন্য ইলিশের জুড়ি নেই। ইলিশ উপকূলীয় সব জেলাতেই পাওয়া যায়। তবে পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া এই তিন নদীর মোহনায় যে ইলিশ ধরা হয় তার স্বাদ ও গুণ অতুলনীয়। বন্ধু টিটু, আমি ও বাকিউল সেই কবে, আজ থেকে প্রায় দুই যুগের অধিকাল পূর্বে প্রথমবারের মতো ইলিশের শহর চাঁদপুর গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে দিনে দিনে চাঁদপুর ঘুরে আসা যায়। আমরা অবশ্য তিন নদীর মোহনার শহর, ইলিশের শহর চাঁদপুরে রাত্রিযাপনও করেছি। ঢাকা থেকে সকালের লঞ্চে চড়েছি। বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিয়ে ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই তিন নদীর মোহনায় পৌঁছে যাই। তারপর আরো একঘণ্টা উত্তাল নদীতে চলার পর দূরে দেখা যায় নদীবন্দর। 

তিন নদীর মোহনায় পানির রঙের ভিন্নতা খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করি আমরা তারুণ্যের কৌতূহল ও উচ্ছ্বাসে। খুব স্পষ্ট দেখা না গেলেও খানিকটা বোঝা যায়। সংযুক্ত নদীগুলোর মিলিত স্রোতে ঢেউ খুব তীব্র হয়ে ওঠে এখানে। ঝড়ের সময় এই মোহনায় নৌকা বা জাহাজডুবির আশঙ্কা থাকে সবচাইতে বেশি। বিগত বছরগুলোতে বহু লঞ্চ ডুবে মানুষের অকালমৃত্যু হয়েছে এখানে। ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চ নির্মাণ ও অধিক যাত্রী বহনের কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে বেশি। 

২৫ বছর পূর্বে প্রথমবার চাঁদপুর ভ্রমণে আমরা নদীবন্দরের কাছেই হোটেল তাজমহলের অতিথি হয়েছিলাম। এটি ঢাকায় বসবাসরত আমার পরিচিত একজনের মালিকানাধীন ছিল। আমি শুধু হোটেলের নামটাই জানতাম। আর জানতাম, তখনকার চাঁদপুরের সবচাইতে ভালো হোটেলের একটি। হোটেলে চেক-ইন করে ‘ভালো হোটেলে’র নমুনা ভালোভাবেই দেখতে পাই। আসলে অত্যন্ত নিম্নমানের হোটেল বলতে যা বোঝায় এটা তাই ছিলো। নব্বই দশক পর্যন্ত মফস্বল শহরগুলোতে ভালোমানের হোটেলে বিনিয়োগ করার মতো ব্যবসা ছিলো না। বনেদী কিছু হোটেল ব্যবসায়ী হোটেলে বিনিয়োগ করতো। মূলত নদীবন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী, মহাজন ও তাদের সাথের লোকজনের আনাগোনাকে কেন্দ্র করে চলতো হোটেল-রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। একেবারে নদীবন্দরের পাশে তাজমহলও এমনি একটি হোটেল ছিলো। এখন আছে কিনা তাও জানি না। 

যাহোক, হোটেলে ঢুকেই ফ্রেশ হয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি শহর দেখবো বলে। লঞ্চঘাটের কাছেই চাঁদপুর রেলওয়ে স্টেশন দেখে পুরো বিকাল শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াই। পরিকল্পিত ছিলো না সেই সময়ের এই ভ্রমণ। মূলত আমরা লঞ্চভ্রমণ এবং এক রাত ঢাকার বাইরে আড্ডা দেব এই লক্ষেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। এভাবে আমরা বন্ধুরা মিলে নব্বই দশক থেকে বাংলাদেশের বহু স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছি। এখন যারা চাঁদপুর বেড়াতে আসেন তাদের অনেকেই মোলহেড বা তিন নদীর মোহনা, অঙ্গীকার স্মৃতিসৌধ, রক্তধারা স্মৃতিসৌধ, ইলিশ চত্বর, ডিসির বাংলো, পর্তুগীজ দুর্গ, রূপসা জমিদার বাড়ি, মঠখোলার মঠ, বোয়ালিয়া জমিদার বাড়ি সম্পর্কে জানেন এবং চাইলে সহজে যেতেও পারেন। আবার শুধু ইলিশের স্বাদ গ্রহণের জন্যও চাঁদপুর ভ্রমণ ও নৌবিহার এখন বেশ জনপ্রিয় একটি স্থানে পরিণত হয়েছে। 

সেই তরুণ বয়সের চাঁদপুর ভ্রমণে আমরা চাঁদপুর রেলস্টেশন ঘুরে শহরের মূলকেন্দ্রে রিকশা নিয়ে ঘুরেফিরে সন্ধ্যায় এসে নদীর পাড়ে বসে থাকি। সারারাত ধরে চলে তিন বন্ধুর অম্ল-মধুর আড্ডা। পরের দিন সকালেই আমরা ঢাকা ফিরবো। তাই রাতভোর আড্ডা দিয়ে যেনো সময়ের ষোলআনা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা। আড্ডার বিষয়বস্তু যথারীতি প্রেম, রাজনীতি হয়ে সমাজ বিপ্লবে বিস্তৃত হয়। এরপর আলোচনার পরিধি বাড়তে বাড়তে একসময় মহাশূণ্যে হারিয়ে যায়! তারুণ্যের সব আড্ডাই কী এভাবে হারিয়ে যায়। লক্ষ্যহীন হলে যায় হয়তো। আবার সময় কাটানো, সুস্থতার জন্য শুধুই আড্ডারও কী প্রয়োজন নেই? 

পরদিন সকালের নাস্তা শেষে আমরা লঞ্চ ঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। দুপুর বারোটার লঞ্চ ধরে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। সমাপ্ত হয় আমাদের ২৫ বছর পূর্বের সংক্ষিপ্ত ভ্রমণকাহিনীর সংক্ষিপ্ত গল্প। 

২৫ বছর পরে

২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে আমরা দ্বিতীয়বারের মতো চাঁদপুর ভ্রমণ করি। ইতোমধ্যে নৌভ্রমণের সঙ্গে ইলিশের স্বাদ নিতে ভ্রমণকারীদের শুধু জনপ্রিয় নয়, অতি জনপ্রিয় স্থানে পরিণত হয়েছে চাঁদপুর। বিদেশীরাও আসছেন। বিশেষত কলকাতার দাদারা আসছেন সরাসরি ইলিশের স্বাদ নিতে। বহু বছর পর আমরাও এবার ৪ বন্ধু ইলিশের স্বাদ নিতে রওয়ানা হয়ে যাই চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে। সকাল ৭:২০ মিনিটেই ছেড়ে দেয় চাঁদপুরগামী লঞ্চ ‘সোনারতরী’। আমাদের এবারকার ভ্রমণে যুক্ত হওয়ার কথা ছিলো অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বন্ধু শাহজাহানসহ আরো কয়েকজনের। অসুস্থতার কারণে সে যুক্ত হতে পারেনি। নানা কারণে অন্য বন্ধুরাও আসতে পারেনি। সময়ের স্রোতে ভেসে যাওয়া নাগরিক জীবনের নানা জটিলতা ও ব্যস্ততার কারণে বন্ধুদের নিয়ে একসাথে ভ্রমণ করা এখন খুব একটা সহজসাধ্য কাজ নয়। তাপরও ৪ বন্ধু একসাথে চাঁদপুর যাচ্ছি এই মুহূর্তে এটাও আমাদের কাছে কম আনন্দের নয়। ২৫ বছর পরের এই ভ্রমণে আমরা পুরনো তিন বন্ধু টিটু, বাকিউল ও আমি রয়েছি। আমাদের তিনজনের সাথে যুক্ত হয়েছে আরেক ভ্রমণপাগল বন্ধু সুজন। 

সাতসকালে ঢাকার সদরঘাটের লালকুঠি ঘাট থেকে ‘সোনারতরী’ লঞ্চ ধরে সকাল ১১টায় পৌঁছে যাই চাঁদপুরে। এবার সংক্ষিপ্ত সময়ে আমরা চাঁদপুর শহরের সবচাইতে আকষর্ণীয় স্পট তিন নদীর মোহনা বা শহর রক্ষা বাঁধ কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ‘বড়ো স্টেশনে’ই সময় কাটাই বেশি। দারুণ লাগছে এখানে এসে। নদীর তীরের উন্মুক্ত বাতাস নিতে আমরা আমাদের মাস্কগুলো থুতনির নিচে খানিকটা নামিয়েছিলাম। একজন পুলিশ কনস্টেবলের হাঁক শুনে সবাই ফিরে তাকাই তার দিকে। হঠাৎ মোবাইল কোর্ট বসানো দোকানপাট উচ্ছেদে ব্যস্ত ম্যাজিস্ট্রেট মশাই ও তার দলবল আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। তারা আমাদের জেরার মুখে ফেললেন- কোথা থেকে এসেছি, কেনো এসেছি ইত্যাদি প্রশ্ন চলল। আমাদের সঙ্গীতশিল্পী-ব্যবসায়ী বন্ধু সাইয়িদ সুজনের চুল কবি নজরুলের মতো না হলেও কাছাকাছি পর্যায়ে খানিকটা বাবরি দোলানো থাকায় তাকেই টার্গেট করে কথা বলেন অতিমাত্রায় তৎপর ম্যাজিস্ট্রেট মহাশয়। আমরা যেনো সাক্ষাৎ পেয়ে যাই ‘ঔপনিবেশিক ভূত’-এর। 

বড়ো স্টেশনের ইলিশের বাজার দেখা ছাড়াও শহরের ভেতর টমটম নিয়ে খানিকটা ঘোরাঘুরি শেষে কালীবাড়ির মোড়ের ‘ওয়ান মিনিট আইসক্রিম’ও স্বাদের তালিকা থেকে বাদ যায়নি আমাদের এই ভ্রমণে। ইলিশের স্বাদ পেতে বড়ো স্টেশনের ‘হিলশা কিচেন’ এই শীতকালেও আমাদের হতাশ করেনি।  শহর দেখে মনো হলো এতো বছরেও ট্রেডিং ব্যবসার প্রসার ছাড়া চাঁদপুর শহরের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। চাঁদপুরের মিনি কক্সবাজার যাওয়ার জন্য ট্রলারওয়ালারা নানাভাবে প্রলুব্ধ করলেও আমরা সময়াভাবে সেখানে গেলাম না। বর্তমানে চাঁদপুর শহর থেকে কাছেই মতলব উপজেলার নদীর পাড় ধরে গড়ে ওঠা মোহনপুর পর্যটন কেন্দ্রের খোঁজখবর নিয়েই সন্তুষ্ট থাকি আমরা। 

ফেরার পথে অবশ্য লঞ্চ থেকে দেখা হয়ে যায় মোহনপুর পর্যটন কেন্দ্র। বেশ ‘কক্সবাজার’ ‘কক্সবাজার’ আবহ তৈরি করা হয়েছে এখানে। বিকাল ৩:৪০ মিনিটে ফিরতি যাত্রা শুরু করে সোনারতরী। একই কেবিনে শুয়ে বসে চার বন্ধু তুমুল আড্ডা দিতে দিতে সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ লালকুঠি ঘাটে পৌঁছে যাই। 
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়