ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

গানের রাজার দেশে

ফয়সাল আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৯, ২৪ অক্টোবর ২০২২  
গানের রাজার দেশে

রাজাই বটে। বাস্তবেও ছিলেন সামন্তীয় জমিদার। আবার তিনিই হন লোকজ সঙ্গীতেরও রাজা। লালন সাঁইজির পর গানের ভাবতরঙ্গে, বৈচিত্র্যপূর্ণ গানের বিচারে এবং জনপ্রিয়তায় একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী পদকর্তা ও সুরস্রষ্টা। আমি সুনামগঞ্জ এলে চেষ্টা করি হাছন রাজার বাড়িতে স্বেচ্ছায় আতিথ্য নিতে। বাড়িটি এখন জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে।

সুনামগঞ্জে বেড়ানোর আছে অনেক দৃষ্টিনন্দন স্থান। অনেক বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞের স্মৃতিধন্য স্থানও সুনামগঞ্জ জেলা। হাছন রাজা ছাড়াও রাধারমণ দত্ত, বাউল শাহ আব্দুল করিম, দূরবীন শাহ, রাম কানাই দাশসহ বহু কবি ও সঙ্গীত সাধকের প্রতিভা বিকাশের পীঠস্থান সুনামগঞ্জ। দূরবীন শাহের বসতভিটা ছাতক গিয়েছি। বাউল শাহ আব্দুল করিমের বাড়ি গিয়েছি। টাঙ্গুয়ার হাওড়, যাদুকাটা নদ, শিমুল বাগান, স্বচ্ছ নীল নদীর জলে ভাসতে ভাসতে মেঘালয়ের পাহাড় থেকে আসা ভাসমান মেঘের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছি বারবার। অন্যান্য দর্শনীয় স্থান দেখে এসে হাছন রাজার মতো অসাধারণ সৃষ্টিশীল মানুষের সান্নিধ্যে আসাটাও বড়ো একটা প্রাপ্তি বটে। 

এবার সুনামগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে হারিয়ে যেতে নয়, এসেছি শুধুই হাসন রাজার মতো সঙ্গীত প্রতিভার সুর ও বাণীতে হারিয়ে যেতে। আমি প্রথমবার যখন হাছন রাজার বাড়িতে এসেছিলাম তখন তার দৌহিত্র কবি মমিনুল মউজুদ্দিন বেঁচে ছিলেন। সুনামগঞ্জ পৌরসভার রোমান্টিক চেয়ারম্যান হিসাবে তাঁর সুখ্যাতি তখন সারা দেশে। তিনি শুধু কবি ছিলেন না, দারুণ প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ ছিলেন। পূর্ণিমা রাতে পৌরসভার সকল বাতি নিভিয়ে দিয়ে সবাইকে আহ্বান জানাতেন জ্যোৎস্না উপভোগ করতে। হাছন রাজার নাতি বলে কথা! সেই সময়ে কবি মমিনুলের সাথে সাক্ষাৎ হয়, কথা হয়। এই অসম্ভব রোমান্টিক মানুষটি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। মানুষটির কথা মনে পড়লে এখনো আমি বিষণ্ন হই। তখনো হাসন রাজার বাড়ি জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি। প্রথমবার যখন ‘গানের রাজা’র বাড়ির চারিদিক ঘুরে ফিরে দেখছিলাম, তখন বারবার শিহরিত হই উপমহাদেশের লোকজ গানের এক অসাধারণ সঙ্গীত প্রতিভার স্মৃতিধন্য স্থানে আসতে পেরে। 

হাছন রাজার জীবনকালকে মূলত দুই পর্বে ভাগ করা যায়। একটি তাঁর উন্মত্ত যৌবনের লাগামহীন ভোগবিলাসের পর্ব। অপরটি আত্মউপলব্ধির মধ্য দিয়ে একজন সাধকের জীবনপর্ব। হাসন রাজাদের আদিপুরুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং ভারতের অযোধ্যার অধিবাসী ছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর পরিবার যশোরে বসতি স্থাপন করে। যশোর থেকে সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার রামপাশায় বসতি গড়ে তোলেন। অবশ্য হাছন রাজার পূর্বপুরুষ জমিদারি পত্তন করেন সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রী গ্রামে। এখানে হাসন রাজার মায়ের বাড়ি। হাছর রাজার পূর্বপুরুষ হিন্দু থেকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত। ধর্মান্তরিত জমিদারের পূর্বনাম বীরেন্দ্র চৌধুরী সিংহদেব বা বাবু রায় চৌধুরী। উত্তরাধিকারসূত্রে হাছন রাজা বিশাল সম্পত্তির মালিক হন। এই সময়ে চলতে থাকে তাঁর উন্মত্ত ভোগবিলাসের জীবন। তাঁর সবসময় রক্ষিতা থাকতো। কথিত আছে, তাঁর এই উন্মত্ততা থেকে নাইওরিতে যাওয়া বউ বা নারীরাও রক্ষা পেতো না। তিনি নৌকায় হামলা চালিয়ে নারীদের অপহরণ করে নিয়ে যেতেন। মানুষ তখন চরম অতিষ্ঠ। একবার এমনই একটি নৌকায় হামলা চালিয়ে দেখতে পান নাইওরি নৌকায় ছদ্মবেশে তাঁর মা বসে আছেন। এরপর থেকে হাসন রাজা এই ঘৃণিত পথ থেকে সরে আসেন। যদিও তাঁর আমন্ত্রণে বাঈজি নাচ ও গানের আসর নিয়মিত বসতো। হাছন রাজার বিখ্যাত একটি গান হচ্ছে:

‘নেশা লাগিল রে বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিল রে
হাসন রাজা পিয়ারির প্রেমে মজিলোরে।’

ভারতের লক্ষ্মৌ থেকে আগত এই পিয়ারী ছিলো একজন বিখ্যাত বাঈজি এবং হাছন রাজা এই পিয়ারীর প্রেমে দারুণভাবে মজেছিলেন। 

হাছন রাজার এর পরের পর্ব ছিলো বৈরাগ্যপর্ব। কথিত আছে, স্বপ্ন দর্শনের মধ্য দিয়ে তার বৈষয়িক ভোগ-বিলাসের প্রতি তাঁর বৈরাগ্যভাব জন্মে। তিনি ভোগের জীবন পরিত্যাগ করতে মনস্থ করেন। ধীরে ধীরে আধ্যাত্ম সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। যে বৈরাগ্য ও  আধ্যাত্মিকতার প্রকাশ তাঁর গানের বাণী ও সুরে নতুনরূপে প্রকাশ পায়। শেষ বয়সে তিনি তাঁর বিষয়-সম্পত্তি স্কুল ও হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দান করে দেন। যুবক হাসন রাজা ও বয়স্ক হাছন রাজার একেবারে বিপরীত পথে যাত্রা! এই সময়ে তিনি লিখেন:
‘লোকে বলে বলে রে,
ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার
কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার
ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার।’ 

আমি প্রথমবার হাছন রাজার বাড়ি গিয়ে একটি ‘রাজবাড়ি’ বা নিদেপক্ষে ছোটোখাটো জমিদারবাড়ি খুঁজতে গিয়ে হতাশ হয়েছিলাম। একেবারে সাদামাটা টিনশেডের একটি বাড়ি। আমার ভ্রমণসঙ্গী বন্ধু স্মরণ করে দিলো একটি গানের মাধ্যমে:
‘পরের জায়গা পরের জমিন
 ঘর বানাইয়া আমি রই
 আমি তো এই ঘরের মালিক নই॥’ 
ঈশ্বর বা আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হাছন রাজা এরপর একে লিখে যান গভীর আধ্যাত্মিক সাধনার গান:
‘আমি যাইমুরে যাইমু, আল্লার সঙ্গে
হাছন রাজায় আল্লা বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে।’

মরমী সাধনার মূল সুর বেজে উঠে হাছন রাজার বিভিন্ন গানে। তাই তাঁর জীবনের দ্বিতীয় পর্ব বা বৈরাগ্যসাধন পর্বে প্রায় সকল গানই মরমী সাধনার উচ্চমার্গে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা। তাইতো তিনি লিখেন:
‘আমার হৃদয়েতে শ্রীহরি,
আমি কি তোর যমকে ভয় করি।
শত যমকে তে দিব, সহায় শিবশঙ্করী।।
হাছনের হৃদয় কান্নায় আপ্লুত হয়,
কি হইব মোর হাসরের দিন রে ভাই মমিন’

আমি হাছন রাজার বাড়ি ও তাঁর গানের জগতে ডুবে থাকি দীর্ঘক্ষণ। হাছন রাজার মধ্যে দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা নিজেকে হারিয়ে ফেলি। এবার ফিরতে হবে। ফিরতি গন্তব্য সিলেট। হাছন রাজার বাড়ি থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে সুরমা নদীর ঘাটে এসে বসি। ভাবনাজুড়ে শুধুই হাছন রাজা ও তাঁর গান। হাছন রাজা তাঁর গানে প্রচুর উপমা, বাগধারা এবং প্রচলিত লোককথা ব্যবহার করেছেন। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত মানুষ। তাঁর গান সৃষ্টি ও সুরারোপ তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে করে যেতেন। গানের বাণী অন্য কেউ লিখে রাখতেন। এভাবে সৃষ্টি হতে থাকে প্রায় ৩ শতাধিক গান। সংখ্যা বিচারে অন্যান্য আরো অনেক পদকর্তাদের থেকে তাঁর গানের সংখ্যা কম হলেও গভীরতা এবং জনপ্রিয়তা বিচারে বিশাল এই সম্পদ। 

শীতকাল তখনো শুরু হয়নি। দূরে মেঘালয় পাহাড় থেকে শীতল বাতাসের পরশ আমাকে দীর্ঘক্ষণ নদীর ঘাটে বসে থাকার বাড়তি আনন্দ যুক্ত করে। আমি বারবার হারিয়ে যাই হাসন রাজার জনপ্রিয় কয়েকটি গানে: ‘লোকে বলে, বলেরে, ঘরবাড়ি ভালা নাই আমার’, ‘মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়ারে’, ‘আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপরে’, ‘সোনা বন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইল’, ‘কানাই তুমি খেইড় খেলাও কেনে’, ‘একদিন তোর হইব রে মরণ রে হাছন রাজা’সহ অসংখ্য গান।
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়