ঢাকা     রোববার   ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২২ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

শেষ পর্ব

নয়াদিল্লি: কিছুটা কাছের হলো

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪৫, ২৪ আগস্ট ২০২৪   আপডেট: ১৩:৪৭, ২৪ আগস্ট ২০২৪
নয়াদিল্লি: কিছুটা কাছের হলো

পরদিন ৫ ডিসেম্বর, নাস্তা সেরে গাড়িতে উঠতে পারলাম না আমি আর সৌম্য। বাস ছাড়ার নির্দিষ্ট সময়ের কয়েক মিনিট আগেই সবাই আমাদের রেখে চলে গেছে। কারণ উৎসবে যেতে আগের দুইদিন নাকি অতিথিদের যেতে দেরি হয়েছে! সেজন্য ১৫ মিনিট আগেই গাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। একটু কষ্ট পেয়েছি আমাদের বাংলাদেশি লেখকরাও আমাদের একটু ফোন দিয়ে জানায়নি। কি আর করা! 

আমরা মেট্রো এবং অটো ধরে উৎসবস্থলে গেলাম। সেশনে অংশ নিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে সৌম্য আর আমি বেরিয়ে গেলাম কুতুব মিনার দেখতে। সেখান থেকে আমরা যাব বাংলাদেশ হাইকমিশনে। দুপুর গড়িয়েছে, টিকিট কেটে ঢুকলাম। ঢোকার পরেই চোখে পড়ল অনন্য ও নান্দনিক কারুকাজে নির্মিত বিশাল লম্বা মিনার। আকাশের দিকে চোখ রাখাও সম্ভব কিন্তু মিনার বরাবর চোখ রেখে এর সৌন্দর্য উপভোগ করা কঠিন! বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না! টেরাকোটা রঙের সোনালি মিনারের শিল্পিত রূপ যত দেখি মন ভরে না। অনেক সময় নিয়ে দেখলাম এবং নানা দিক থেকে ছবি তুললাম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অসংখ্য পর্যটক ও স্থানীয় দর্শনার্থীরা মন ভরে দেখে নিচ্ছে স্মৃতির ঐতিহাসিক মিনার। মনে হলো গতকালের দেখা লালকেল্লা, দিল্লি মসজিদ আর আজকের কুতুব মিনার না দেখলে ইতিহাসের নিবিড় অনুভব থেকে বঞ্চিত হতাম।  এরপর ফিরে এলাম নইদায়।

রাতে অসাধারণ এক আড্ডা হলো, আশরাফ জুয়েল ও শাহেদ কায়েসের রুমে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, স্বস্ত্রীক অধ্যাপক ফখরুল আলম, সেঁজুতি বড়ুয়া ও সৌম্য সালেক মিলে। আড্ডার মধ্যমণি সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি শিল্প-সাহিত্য আর শিল্পী-কবি-লেখকদের নিয়ে একটা চমৎকার ও রসময় কথা বলে আমাদের মোহময় করে তুললেন। যুক্ত করলেন ড. ফকরুল আলম। কবিতা পড়লাম আমি, আশরাফ জুয়েল, শাহেদ কায়েস, সেঁজুতি বড়ুয়া ও সৌম্য সালেক। সবাই একাধিক কবিতা পড়লাম। প্রায় রাত তিনটা পর্যন্ত কবিতাময় আড্ডা চলল এবং সবাই আনন্দ আহরণ করলাম। 

৬ ডিসেম্বর উৎসবের শেষদিন। সেদিন আগত সকল অতিথিদের নিয়ে ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শনের আয়োজন করেছে আয়োজকরা। নইদা থেকে আমরা গাড়িতে উঠলাম। উঠেই ইতোমধ্যে ঘনিষ্ঠ হওয়া লেখকরা খুব মজা করা শুরু করলেন গান, কৌতুক, রঙ্গ-রসিকতায়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কবি সৌম্য সালেক রবীন্দ্রসংগীতসহ কয়েকেটি গান গেয়ে সবাইকে আকৃষ্ট করলেন। আমরা গিয়ে পৌঁছালাম আকাদেমি অব ফাইন আর্টস এন্ড লিটারেচার কেন্দ্রে। ওখানে কোনো সময় নষ্ট না করে ওই বাসেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো হুমায়ুন টম্বে। ‘দিল্লির সম্রাট বাবরের পুত্র হুমায়ুন স্বাস্থ্যগতভাবে দুর্বল ছিলেন। তাই তিনি পুত্রের জন্য মঙ্গল কামনা করে বললেন, হে সৃষ্টিকর্তা তুমি আমার শারীরিক শক্তি সব পুত্রকে দিয়ে দাও। এই চাওয়ার দুই মাস পর বাবর মৃত্যুবরণ করেন এবং পুত্র বলবান হন’—সার্ক সাহিত্য উৎসবে অংশগ্রহণ করা চার দেশের লেখকদের এই তথ্য দিয়ে বলছিলেন গাইড (তিনবার ডক্টরেট করা) রবিন সন। তিনি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন বর্তমান হুমায়ুন টম্ব। বললেন, ‘সম্রাট শাহজাহান স্ত্রীর জন্য তাজমহল তৈরি করেছিলেন আর হুমায়ুনের স্ত্রী আবার তার স্বামীর জন্য বানিয়েছেন এই টম্ব’। বিশাল জায়গাজুড়ে নান্দনিক সৌন্দর্যের এক অসাধারণ স্থাপত্য যেখানে হুমায়ুনের কবরও রয়েছে। সুন্দর এক সকাল কাটল। ফিরে এসে আয়োজক প্রধান জনাব অজিত কৌরের সঙ্গে দেখা করে বিদায় নিয়ে নইদায় ফিরে এলাম।

উৎসব শেষ, এবার সবারই দেশে ফেরার পালা। আমি, কবি বিমল গুহ ও কবি কামরুল হাসান ওখান থেকে চলে এলাম নয়াদিল্লি বিমান বন্দরের কাছের একটি হোটেলে। বাকিরা যার যার মতো চলে গেলেন। কেউ কলকাতা হয়ে ফিরবেন, কেউ কেউ ঐদিনই চলে গেলেন এবং দুই একজন কয়েক দিন পরে আসবেন বলে যার যার গন্তব্যে চলে গেলেন। দুপুরে বিমলদা বললেন, চলো শিহাব কিছু কেনাকাটা করতে বের হই। বের হলাম তিনজন। অটো নিয়ে একটা বিশাল উন্নত একটি শপিং মলে গেলাম। এখানে চকলেট থেকে শুরু করে সবকিছুর দাম অনেক চড়া, তাই বেরিয়ে একটা মার্কেটে গেলাম। সেখান থেকে যার যার প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করে ফিরে এলাম হোটেলে। কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে চা খেতে বের হলাম। চা খাওয়ার পর কবি বিমল গুহ বললেন, চলো এক জায়গায় যাই। বললেন, এখান থেকে অটোতে পনের মিনিটের পথ, যার কাছে যাবো তিনি বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে জন্ম নেয়া বাংলা ও হিন্দি ভাষার কবি প্রাণজি বসাক। পূর্ব পুরুষের ভিটা ছেড়ে দেশ বিভাগের সময় তিনি চলে আসেন ভারতে। বর্তমান নিবাস এই নয়াদিল্লিতে। সরকারি চাকরি করেন। 

নাম বলাতে আমার স্মরণ হলো, তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় মৌলভীবাজারে, একটি সাহিত্য উৎসবে। তাঁর সম্পাদিত একটি কবিতার বই আমাকে দিয়ে বলেছিলেন, আমি কাণজি বসাক। এই বইয়ে তসলিমা নাসরিনের কবিতাও আছে। তারপর দুজনেই মঞ্চে উঠে আলোচনা করলাম। জানলাম তিনি বাংলা কবিতার টানে প্রায়ই বাংলাদেশে ছুটে আসেন। এবার দিল্লি গিয়ে তার বাসায় যাবো ভাবিনি, কবি বিমল গুহও ওভাবে বলেননি। কিন্তু বিমলদা ঢাকায় আসার পূর্ব-সন্ধ্যায় আমাকে ও কবি কামরুল হাসানকে বললেন, চলো কাণজির বাসায় যাই; আমি তখনো জানি না যে, ইনিই কবি কাণজি বসাক! গিয়ে তো অবাক, দেখা হওয়ার পর বললেন, আমিই বিমলদাকে রহস্য রাখতে বলেছি। তাঁর বাসায় গেলাম, সুন্দর ফ্ল্যাটে তিনি স্ত্রী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও পুত্র-কন্যা নিয়ে থাকেন। বাসায় আগে থেকেই ছিলেন কবি ইউসুফ মোহাম্মদ। তারপর চা-নাস্তা, কবিতা পাঠ, আড্ডা ও রাতের খাবার খেয়ে চলে এলাম। বললেন, দিল্লিতে প্রায় ২০ লাখ বাঙালি থাকেন। উঠে আসার আগে তার নতুন কবিতার বই ‘রূপবৃত্তে ছায়াবৃত্ত’ আমাদের উপহার দিলেন। তিনি বিনয়ী বাঙালি, লিখেনও ভালো। আপনার জয় হোক কবি।

ফিরে এলাম হোটেলে। সকাল ছয়টায় আমাদের ঢাকার বিমান। সুতরাং কয়েক ঘণ্টা মাত্র ঘুমানোর সময় অর্থাৎ তিনটায় আমরা বেরিয়ে যাবো, সেই একটা রুমই নিয়েছি এবং হোটেলের মাধ্যমে একটা উবার ঠিক করে রেখেছি, সে এসে আমাদের নিয়ে পৌঁছে দেবে ইয়ারপোর্টে। ঘুম তেমন হলো না তিনজনেরই। রাত আড়াইটার দিকে ড্রাইভার এসে আমাদের জাগালো আর হোটেলে তখন ডিউটি করছিল বাংলাদেশি একটা ছেলে, সেও আমাদের খুব সহযোগিতা করলো। আমরা ভোরের কোমল আলোয় শরীর মাড়িয়ে বিমান বন্দরে পৌঁছালাম। ইমিগ্রেশন শেষে বিমানে উঠলাম। উইন্ডো খুলে দিল্লিকে বিদায় জানিয়ে প্রিয় শহর ঢাকার দিকে রওয়ানা হলাম। যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম ‘দিল্লি বহু দূর’, সেই দিল্লিকে কিছুটা দেখলাম, কিছুটা কাছের হলো।  

পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব : নয়াদিল্লি: কিছুটা কাছের হলো

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়