ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

চোখের সামনে উদ্ভাসিত অ্যাডামস পিক!

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৩২, ২৪ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চোখের সামনে উদ্ভাসিত অ্যাডামস পিক!

রাতের আঁধারে উঠে ছিলাম অ্যাডামস পিক এ। তখন টের পাইনি। ঝরনার শব্দকেও মনে হচ্ছিলো বৃষ্টির শব্দ। ভয় পেয়ে ভালোই হয়েছিলাম জব্দ।

ঘন জঙ্গল,গাছপালা- সব মিলিয়ে অজানা একটা পরিবেশ। কিছুই ঠাহর করতে পারছিলামনা। দিনের আলোতে বুঝতে পারছিলাম- এই পথ পেরিয়ে গিয়েছি কিছুক্ষণ আগে, কেমন সম্মোহিত অন্ধের মতো। তবে রাতের বেলা কোন  ভয়ঙ্কর জীবজন্তু চোখেপড়েনি। ভয়ঙ্কর কিছু আছে বলেও মনে হয়নি। হবে হ্যাঁ, শান্ত শিষ্ট কিছু বানর ছিলো ওই বনে, তবু উঁচু ভূমিতে নয়; তারা থাকে লোকালয়ে। যেখানে সহজে খাবার দাবার মেলে।

নামার সময় দেখছিলাম বিদ্যুতের লাইন রয়েছে। চূড়ায় অবস্থিত স্থাপনা গুলোয় বিজলী বাতি জ্বলে। মোবাইল নেটওয়ার্ক ভালো। ইন্টারনেটও ভালোই চলে। সুতরাং মোবাইল ফোন অবশ্যই সঙ্গে নেয়া উচিত। অনেক সময় এটা টর্চ লাইটের কাজকরে। ইন্টারনেটে যোগাযোগ ছাড়াও প্রয়োজনীয় তথ্যও জানা যাবে। নামার পথে মাঝেমাঝেই পথটা একেবারে খাঁড়া হয়ে নিচে নেমে গিয়েছিলো। মনবলছিলো, রাতের বেলায় কীভাবে এ পথ উঠেছিলাম। মাই গড।

নিচের দিকে মাঝামাঝি নামার পর দেখছিলাম সংষ্কার কাজ চলছিলো। উপরে উঠার ভাঙ্গা সিঁড়ি, ইট সুরকির গাঁথুনি ঠিক করা হচ্ছিলো। কিছু যুবক মাথায় করে সিমেন্ট, বালু নিয়ে যাচ্ছিলেন। কাছেই তাদের একটি বেসক্যাম্প ছিলো। সেখান থেকে ওগুলো নেয়া হচ্ছিলো।

কিছুটা পথ নিচে নামতেই চোখে পড়লো ওই বেসক্যাম্প। রাস্তার পাশেই। সাইনবোর্ড পড়ে দেখলাম ওটা বিমান বাহিনীর ক্যাম্প। বিমান সেনারা একের পর এক গ্রুপ হয়ে বোঝা বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম কি নাম আপনার।নামটা ভুলে গেছি।জানালেন, প্রায় মাসখানেক ধরে তারা ওখানে আছেন। তিনমাস থাকবেন। এটা তাদের প্রশিক্ষণের অংশ। ভালোইতো,কাজও হলো। প্রশিক্ষণও হলো। এমন পাহাড়ে ওঠা বেশ শক্ত কাজই বটে। বেসক্যাম্প খুব একটা বড়না। টিনশেড বিল্ডিং। একটা ডিশ এন্টিনা লাগানো। মাটি কেটে সামান্য কিছু জায়গা সমতল বানানো হয়েছিলো। পাশের একটি ছাউনিতে অনেক সিমেন্টের বস্তা। কাজ করছিলো মূলত রাজমিস্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা। কিন্তু তাদের জোগালিয়া ছিলো বিমান সেনারা। নামতে নামতে তাদের কাজ দেখছিলাম। এতো উপরে কনস্ট্রাকশন কাজ সত্যিই একটু মুশকিলের।

ধীরে ধীরে মেঘ কেটে যাচ্ছিলো। সূর্য উঁকিদিতেই মোবাইল ফোন আর ডিএসএলআর ক্যামেরা রেডি করছিলাম। কিন্তু লুকোচুরি খেলছিলো সুরুজ মিয়া। যেই ক্যামেরা রেডি করি, সেই মেঘ গিয়ে ঢেকে দিচ্ছিলো ব্যাকগ্রাউন্ড। ওই মেঘের যাওয়া আসার মধ্যেই গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম অপরূপ ভ্যালি। যতদূর চোখ যায় শুধু গাছ আর গাছ। গাছের উপর দিয়ে সবুজ পাতার ঢেউ!

 

 

কানে বাজ ছিলো একটানা জল পড়ার শব্দ। কয়েক দল মেঘ উড়ে যাচ্ছিলো। কোথাও মেঘ আর ঝরণা একাকার। বা পাশেই ছিলো সুউচ্চ পর্বতমালা। তাতে লাইন ধরে অসংখ্য ঝরনা। কোনোটা ছোট কোনোটা বড়। একসঙ্গে এতো ঝরনা আগে কখনো দেখিনি। আর কখনো দেখব কিনা সন্দেহ! পাহাড়ের মাথায় যেন শতশত জলের উৎস। পাহাড়ের মাথা থেকে এতো পানি কীভাবে আসে?

ভূগোল বলে, ভূগর্ভে উত্তপ্ত লাভা আছে। আছে গরম জল। পৃথিবীর মাটির প্রবলচাপে সেই জল উপরে উঠে। সাধারণত পাহাড় পর্বতের মাটিতে অসংখ্য ফাঁটল থাকে। ওইসব ফাঁটল দিয়ে পানি উপরে উঠেআসে। এরমধ্যে থাকে কিছু গরম জলের ঝরনা। উষ্ণ প্রস্রবণ। ভূগর্ভস্থ গরম পানি ঝরনা দিয়ে বেরিয়ে আসে। যাকে বলে গেইসার।  ওই যে শীতকালে আমরা গরম জলের জন্য গীজার ব্যবহার করি, শব্দটা কিন্তু ওখান থেকেই এসেছে।

আমাদের পাশ দিয়েই একটি শক্তিশালী ঝরনা বয়ে যাচ্ছিলো। যার জলে অনেক তোড়ছিলো। জলের পরিমানও ছিলো অনেক বেশি। মহা খরস্রোতা। এরকম একটা ঝরনা থেকেই একটা নদী হতে পারে। পৃথিবীর বড় বড় নদীর উৎস কিন্তু এরকম ছোট ঝরণা থেকেই।

যেই সূর্য উঠছিলো, মুহুর্তে মনটা কবি হয়ে উঠছিলো। আকুল হয়ে কেবল চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিলো। মন চাই ছিলো, নিচে আর নামব না। জনম জনম ওখানে বসেই সুখ উপভোগ করি। কিন্তু বিবাগী, বৈরাগী না হলে নিরবিচ্ছিন্ন সুখ কি আর মেলে। কত কাজের তাড়া। বলা হয়, কুকুরের কোনোকাজ নেই, দৌড় ছাড়া হাঁটা নেই। জন্মের পর থেকে কেবল দৌড় আর দৌড়। মূল্যহীণ দৌড়! জানা নেই কীভাবে হব গৌড়।

অনেক উঁচু থেকেই একটা বিশাল মন্দিরের ধবল মাথা দেখা যাচ্ছিলো। একজন রাজমিস্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম ওই মন্দিরটার নাম কি? জবাব দিলো, জাপানী টেম্পল। উঠার সময় একটা সাইনবোর্ডে নাম লেখা ছিলো ওই টেম্পলের। অন্ধকারে তেমন একটা বুঝতে পারিনি। জাপানী টেম্পলের মূল গম্বুজে সূঁচালো তীর। সবুজ ক্যানভাসে ওই ধবধবে সাদা মন্দির চরম কন্ট্রাস্ট তৈরি করেছিলো।

 

 

উঠার সময় যেমন কষ্টে বুক ফেঁটে যাচ্ছিলো, নামার সময় তার বিপরীত। মাধ্যাকর্ষন শক্তি ঠেলে ঠেলে নামাচ্ছিলো। যেন সেই দৌড়! ছবি তুলছিলাম। গল্প করছিলাম।এভাবে কতটা পথ পাড়ি দিয়েছিলাম মনে ছিলোনা। হঠাৎ দেখলাম পরিষ্কার সূর্য উঠেছে। তার তেজ জ্যোতিতে চারদিক উদ্ভাসিত।

এরমধ্যে অপরূপ একটা দৃশ্য দেখে থমকে গেলাম। এমন দৃশ্য দেখব কখনো কল্পনাও করিনি। আগেরদিন অনেক চেষ্টা করেছিলাম অ্যাডামস পিক দেখা যায় কিনা। অন্তত ওই পাহাড়ের আশপাশটা দেখা যায় কিনা। কিছুই দেখা যায়নি। সূর্যের প্রখর আলোয় হঠাৎ চোখের সামনে এ্যাডামস পিক! এতোটা স্পষ্ট! এতোটা দীপ্তিমান! এতো মনোমুগ্ধকর! এতোটা অপরূপ! কি শোভা কি মায়া গো!

সামনে বিশাল একটা বনভূমি। কিছুটা ঢেউয়ের মতো বাঁকা। তার উপরেই আদম পাহাড়ের চূঁড়া। চোখের সামনে এমন দৃশ্য কল্পনাও করিনি। চোখ যেন সে সুন্দরে ঝলসে যাচ্ছিলো!

দেখতে পাচ্ছিলাম যে পথ দিয়ে আমরা চূঁড়ায় উঠেছিলাম সেটাও। তবে দূর থেকে পথটা স্পষ্ট ছিলো না। উপরের স্থাপনা দেখা যাচ্ছিলো। ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সার্চ লাইটের মতো সূর্য আলো ফেলেছিলো। সে আলোয় দেখছিলাম- চোখের সামনে ভয়ঙ্কর সুন্দর। মনে হচ্ছিলো এইতো সামনেই। হয়তো মিনিট পনেরোর পথ। সামনের ওই পাহাড়টুকু পেরোলেই অ্যাডামস পিক।যতটা কাছে, যতটা সামনে মনে হচ্ছিলো আসলে তা নয়। ওখানে যেতে যেতে কাহিল না হয়ে কেউ ফিরবেই না। কিন্তু এতো সজীব,এতো জীবন্ত মনে হচ্ছিলো অ্যাডামস পিক। এতোক্ষণে কষ্ট সার্থক মনে হচ্ছিলো। নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো।

আমরা কেউ কল্পনাও করিনি ওভাবে আদাম পাহাড়ের চূঁড়া দেখব। প্রথম দেখেছিলাম আমি। দেখার সঙ্গে সঙ্গে একটা চিৎকার দিয়েছিলাম। প্রথমে ফিরোজ আলমকে বলেছিলাম। সে-ও দেখে অবাক। গাঁছের ফাঁক দিয়ে এমন দৃশ্য অপেক্ষা করছিলো আমাদের জন্য কে ভেবেছিলো। ফিরোজ সঙ্গে সঙ্গে রেডি হয়ে গেলো ছবি তোলার জন্য। পাশেই একটি রেলিং ছিলো। সেখান থেকে আরো ভালো দেখা যাচ্ছিলো পাহাড়টাকে। পুরো চরাচর যেন বনজ সৌন্দর্যে ভরপুর। চোখ সেগুলো গোগ্রাসে গিলছিলো। আহা পোড়া চোখ! কতদিন এমন সুখ দেখেনি। প্রথমে অ্যাডামস পিক এর। পরে নিজেদের ছবি তুলছিলাম। 

মিলটন কিছুটা পেছনে ছিলো। ডিএসএলআর তার হাতেই ছিলো। মিলটন বুঝতে পারছিলো না কি নিয়ে আমাদের এতো উচ্ছ্বাস! কাছাকাছি আসতেই যখন তাকে দেখালাম, সে-ও যেন প্রেমে পড়ে গেলো ওই দৃশ্যের। মুখ দিয়ে বললো, ওয়াও..। একের পর এক ক্লিক ক্লিক..।
 


 

শ্রীলঙ্কা/উদয় হাকিম/নাসিম

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়