ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘মুক্তিযুদ্ধ করেছি, দেশও আমাকে সম্মান দিয়েছে’

মোসলেম উদ্দিন, হিলি (দিনাজপুর) || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১২, ২ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৮:৩৪, ১১ মার্চ ২০২১
‘মুক্তিযুদ্ধ করেছি, দেশও আমাকে সম্মান দিয়েছে’

দিনাজপুরের হিলির বীর মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন। বীরত্বের সঙ্গে হিলিসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তিনি। তার বীরত্বের কাছে হার মেনেছে বহু পাক সেনা।

জহির উদ্দিন সম্প্রতি রাইজিংবিডিকে তার যুদ্ধদিনের স্মৃতির বর্ণনা দিয়েছেন।

১৯৭১ সালে জহির উদ্দিনের বয়স ছিলো ১৮ বছর, নববিবাহিত তিনি। এরমধ্যে আসে ২৫ মার্চ কালো রাত। সেই রাতে ঢাকাশহরে পাক সেনারা হত্যাযজ্ঞ চালায়। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা আনুমানিক সাড়ে ৭টা বাজে। চট্টগ্রাম বেতারে ঘোষণা, ‘…তোমরা পাক বাহিনীকে প্রতিহত করো।’ ওই রাতে হিলি সীমান্তের ‘ইপিআর’ ক্যাম্পের বাঙালি সদস্যদের কাছে পাকবাহিনীকে প্রতিহতের নির্দেশ আসে।

পরে ভোরের দিকে ইপিআরের বাঙালি সিপাহী আকবর জহির উদ্দিনসহ কয়েকজনকে নিয়ে চুড়িপট্টি ইপিআর ক্যাম্পে প্রবেশ করেন এবং দুই পাক সেনাকে হত্যা করেন। পরে লাশ দুটো ভারত সীমান্তে ফেলে আসেন তারা। পরে পাশের হিলি ক্যাম্পে থাকা দুই পাক সেনাকে আটক করে ভারতীয় বিএসএফের হাতে তুলে দেন তারা।

জহির উদ্দিন মুজাহিদ ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছিলেন। ১০ এপ্রিল মুজাহিদের কমান্ডার খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে তিনিসহ কয়েকজন হিলি থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে ভারতের কামারপাড়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টে গিয়ে উপস্থিত হন। সেখান থেকে ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে দিনাজপুরের পার্বতীপুর, রানীশংকৈল, সেতাবগঞ্জ ও মোহনপুর এলাকায় যুদ্ধ করতেন। দুই মাস ধরে ওই অঞ্চলে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে একের পর এক গেরিলা হামলা চালান জহির উদ্দিনসহ অন্যরা। 

পরে আগস্টের মাঝামাঝিতে রাজশাহীর বোলালিয়া, গোমস্তপুর ও রহনপুর থানায় যুদ্ধে অংশ নেন জহির উদ্দিন। সেখানে তৎকালীন ইপিআর কমান্ডার সুবেদার গোফুর উদ্দিনের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেন। রাজশাহী সীমান্তের ভারতীয় আদিমপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মর্টার মেশিন চালানোর দুই সপ্তাহ ট্রেনিং নেন জহির উদ্দিন। নভেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি ওই এলাকায় যুদ্ধ করেন। ১৫ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জে রাজাকারের গুলিতে শহীদ হন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। খবর পেয়ে জহির উদ্দিন মুক্তি সেনাদের নিয়ে ওই এলাকায় আক্রমণ চালান। ওই আক্রমণে ৬৫ জন রাজাকারকে হত্যা করেন তারা।

জহির উদ্দিন বলেন, তিনি দেশকে ভালোবাসেন। দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। বর্ষাকালে পানিতে ভিজে, নদীতে সাঁতার কেটে শত্রুদের ওপর আক্রমণ করেছেন। তাদের একটায় লক্ষ্য ছিলো- দেশের মাটি থেকে শত্রুদের হটানো; মানুষকে নির্যাতনে থেকে রক্ষা করা।

যুদ্ধের একটা স্মরণীয় ঘটনা বর্ণনা করেন জহির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘সেপ্টেম্বর মাস। রাজশাহীর রহনপুরে পাকসেনাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করবো। চারদিকে পানি। আমরা কয়েকজন মুক্তিসেনা আক্রমণের জন্য বিভিন্নস্থানে অবস্থান নিয়েছি। এক সময় দেখি ১০ থেকে ১২ জন পাকসেনা বাঁশঝাড়ের ভিতর দিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। ওইস্থানে শুধু আমি আর আমার সঙ্গে বগুড়ার এক মুক্তিসেনা। যখন পাক সেনারা ৬০ গজ দূরে অবস্থান করছেন, ঠিক তখন আমরা এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ করতে থাকি। মুহূর্তের মধ্যে তারা মাটিতে পড়ে গেলো।’

জহির উদ্দিন বলেন, ‘ওই যুদ্ধের পর তৎকালীন এমপি খালিদ মিয়া ও ভারতীয় রাজপুত রেজিমেন্টের মেজর মরিস চন্দ্র ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং আমাকে তারা বুকে জড়িয়ে বাহবা দেন। খুশি হয়ে আমাকে এবং বগুড়ার ওই মুক্তিসেনাকে ২০০ টাকা করে উপহার দেন। জীবনে অনেক সম্মান ও উপহার পেয়েছি, কিন্তু ওইদিনের সম্মান আর উপহার জীবনের শ্রেষ্ট উপহার মনে করি।’

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জহির উদ্দিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ব্যক্তিগত জীবনে জহির উদ্দিন দুই ছেলে, দুই মেয়ের জনক। দুই ছেলে পুলিশে কর্মরত। পাঁচ বছর আগে তার স্ত্রী মারা গেছেন।

জহির উদ্দিন দীর্ঘদিন পায়ের সমস্যায় ভুগছিলেন। পরে ইনফেকশনে দুটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে। তবে এখন সুস্থ আছেন এবং ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ভালো আছেন।

জহির উদ্দিন বলেন, ‘দেশের জন্য অনেক কষ্ট করেছি। দেশও আমাকে মূল্যায়ন করেছে, অনেক সম্মান দিয়েছে। শেষ বয়সে আমার কোনো অভাব নেই। সরকার আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে।’

ঢাকা/বকুল

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়