ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

করোনার দিনরাত্রি: আমার ব্যক্তিগত ভাবনা

সেলিনা আলম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৫১, ১৩ মে ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
করোনার দিনরাত্রি: আমার ব্যক্তিগত ভাবনা

বিশ্বের টিভি সংবাদ আর বাংলাদেশের চারপাশের ঘটে যাওয়া ঘটনার টিভি সংবাদের দৃশ্য দেখতে দেখতে নিজেকে আজকাল অর্ধমৃত মনে হয়। মানসিক চাপে এক অস্থির সময় পাড় করছি। আমি মোটেও ভালো নেই। এতোটুকু বয়স অব্দি শুধু কাজই করে গেলাম! ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জীবনের নানা আয়োজন। কোনো কিছুই পূর্ণভাবে শেষ করতে পারিনি। আরো কিছুটা সময় পেলে হয়তো সাজানো না হলেও কিছুটা পরিপাটি হতো যাপিত জীবনের শেষ অধ্যায়টুকু। ভোগের চিন্তা থেকে নয়, জীবনটাকে উপভোগ করতে চেয়েছিলাম। সব আয়োজন শেষে সেই উপভোগের সময়ে এসেই ঝড়ের তাণ্ডবে পড়ে গেলাম- যার নাম করোনা।

কেউ কি এখন ভালো আছি? নেই। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে যেতে পারি না, মানুষ হয়ে মানুষকে বিশ্বাস করতে পারি না, মানুষ হয়ে আজকাল মানুষকেও ভয় পাই। মানুষ হয়েও আপনজনদের কাছে গিয়ে জড়িয়ে আহ্লাদিত হওয়া যায় না- এ কেমনতর কঠিন বিপর্যয়! এর মাঝেও ত্রাণের চাল চুরি হয়, তেল চুরি হয়, বিশ্বাসের সাথে প্রতারণা চলে, আস্থার সাথে বেঈমানী চলে- মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও মানুষ কেন নিজেদের খারাপ চরিত্র বদলাবে না?

যে জীবনের নিশ্চয়তা নেই, তার জন্য কি এতো সঞ্চয়! মরে গেলে ওই সঞ্চয় কে ভোগ করবে? অন্তত দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে একটু না হয় মানবিক হই। নিজের ভোগের চিন্তা বাদ দিয়ে অভুক্ত একজনের অন্নের সংস্থান করি। বেঁচে থাকলে অনেক কিছু করার, অনেক কিছু পাবার সম্ভাবনা থাকবে। মৃত্যু যদি ভাগ্যে লেখাই থাকে অন্তত ভালো কাজ করার মধ্য দিয়ে মৃত্যু হোক আমাদের।

আমাদের সময়টা সামনে আরো বেশি খারাপের দিকেই হয়তো যাবে। এখনো যারা আমরা সুস্থ আছি প্রত্যেকের নিজস্ব পরিকল্পনা থাকা জরুরি। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দেশের তরুণরা অনেক মেধাবী, মানসিকভাবে তারা অনেক শক্তিশালী। আমাদের ভাষা আন্দোলন, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ এর সবচেয়ে বড়ো স্বাক্ষর। কেউ দায়িত্ব দিক বা না-দিক, আমি মনে করি, তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে। ডিজিটাল যুগ। ফোনে ফোনে, মেইলে মেইলে, ভিডিও কনফারেন্সে অনেক কাজের প্ল্যান করে তা সফল করার জন্য কার্যপদ্ধতি ও কার্যধারা তারা দিতে পারবে। এলাকাভিত্তিক এই প্রস্তুতি প্রয়োজন। প্রত্যেক এলাকার জনপ্রতিনিধিরা তারুণ্যকে কাজে লাগিয়ে অনেক কিছু করতে পারেন। সুপরামর্শ দিতে পারেন, তাদের পাশে থেকে সাহস দিতে পারেন। আর প্রতিটি গ্রামের স্বচ্ছল এবং সফল ব্যক্তি যারা আছেন, তারা বাংলাদেশের যেখানেই বাস করেন না কেন, যদি সম্মিলিত হয়ে শুধুমাত্র তার নিজ গ্রামের অস্বচ্ছল ও অসহায় মানুষের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন, জোর গলায় বলতে পারি, অন্তত একজন ব্যক্তিও না খেয়ে মারা যাবে না।

বিচ্ছিন্নভাবে চুরি ডাকাতির ঘটনা এখন ঘটছে। অসচ্ছল জনগণের কেউ ত্রাণ পাচ্ছেন, কেউ আবার একেবারেই পাচ্ছেন না। নিম্ন আয়ের এই জনগোষ্ঠী কিন্তু বাংলাদেশের একটা বিশাল অংশ। এদেরকে অন্তত খাবার সরবরাহ করে শান্ত রাখতে হবে। আমাদের অসহযোগী মনোভাব আর আচরণে ওরা সুসংগঠিত হয়ে গেলে আমরা কেউ কিন্তু নিরাপদে ঘরে বসে থাকতে পারবো না। বাংলাদেশের চিত্র পাল্টে যাবে তখন। মারো, কাটো অবস্থা দাঁড়াবে। আর সুযোগ-সন্ধানী কিছু মানুষ তখন লুটপাটে মত্ত হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে এমন দৃশ্য আমাদের চোখেও পড়ছে।

সারাক্ষণ মাঠে থেকে, রাস্তায় থেকে, হাসপাতালে থেকে যেসব প্রতিষ্ঠান এবং যে মানুষগুলো দিনরাত আমাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, এমন সেবা অন্য সময় আমরা চাইলেও তার জন্য ঝক্কি কম পোহাতে হয় না। আজ তারা স্বেচ্ছায় বা দায়িত্ব কর্তব্য পালন করার নির্দেশে আমাদের জন্য জীবনবাজী রেখে এ দেশের জন্য, আমাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কিছু ভুল-ত্রুটি তাদের অনিচ্ছাকৃতভাবে হতেই পারে। তারা নিজেরাও কি সংকটাপন্ন নন? তাদেরও তো পরিবার আছে, আছে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তাদের প্রতি বিরূপ না হয়ে আমাদের উচিত ধৈর্যশীল হওয়া। এই বিপর্যয়ে তারাই তো আমাদের বন্ধু হয়ে পাশে আছেন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেও অন্তত আমরা একটু ঘরে থাকি এবং তাদের কাজকে ধন্যবাদ দিতে যেন কৃপণতা না করি।

১৭ কোটি জনগণ। নানা অজুহাতে সবাই যদি বারবার বাইরে বের হই, তবে তো করোনা সামাল দিতে একজন ডাক্তারও আর বেঁচে থাকবে না। তাদেরকেও তো আমাদের প্রয়োজন। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আইন মেনে তাদের দিকেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তারা ত্রাণের কাজে দেখবে না আমাদের পাহারা দেবে? রমজান মাস চলছে। সংযমটা সব ক্ষেত্রেই না হয় প্রয়োগ করি! আর আমাদের বাড়ির ভেতরের চারপাশে বা ছাদে বা ঘরের বারান্দায় যতোটুকু খালি জায়গা পড়ে আছে, প্রয়োজনে সেই অব্যবহৃত জায়গাগুলোকে সবজি চাষ করে সময়টুকু ভালো কাজে লাগাতে পারি। নিজের যা কিছু আছে তাই নিয়েই এখন লড়াই চালিয়ে যাবার সময়। কারণ সংকট পরবর্তী সময়ে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খুব বেশি প্রয়োজন আছে। বিলাসবহুল জিনিসপত্র, বিদেশী প্যাকেটজাত খাবার আমদানী করে বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় করা উচিত হবে না।

এই দুঃসময়েও স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগে। সারারাত জেগে থেকে দুশ্চিন্তায় ডুবে গিয়েও এক রূপকথার দেশকে নিজের মনে আবিষ্কার করি। প্রকৃতির অনেক কিছুর মাঝে পরিবর্তন এসেছে। কক্সবাজার নূতন রূপে সেজেছে। গাছে গাছে পাতারা এখন অনেক ঘন সবুজ। ঢাকার বাতাসে এখন ধূলিকণা কম। তাই কতো যে সাধ জাগে মনে...।  রমনা পার্কে আবারও সেই ছোটবেলার মতো আব্বুর হাত ধরে হাঁটতে যেতে ইচ্ছে করছে। পাড়া মহল্লায় ছেলে-মেয়েরা ক্লাবের অনুষ্ঠানের জন্য চাঁদা তুলে মুরুব্বীদের দলবেঁধে এসে আমন্ত্রণ জানাবে। রমজান মাসে পাড়ার ছেলেদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে সেহেরির আয়োজন করবো। কত কিছু! শহরের এই নিস্তব্ধতা আমাকে সেই সময়ে নিয়ে গেছে। সেই সময় কি এই সময়ে এসে আর পাওয়া যাবে না? কিছুই কি চেষ্টা করা যায় না?

রামপুরা ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটা সেই কবেই মরেছে। মেঘনা নদীর জল এখন আর বড়ো বড়ো ঢেউয়ে উপচে পড়ে না আমাদের বাড়ির ঘাটে। বনানী গুলশানের আবাসিক এলাকার বাড়িগুলো থেকে ফুলের লতা এসে ছেয়ে যায় না ফুটপাত। এখন ভোরের বাতাসে আসে না ভেসে মাধবী ফুলের ঘ্রাণ। শিউলি কুড়ানো ভোরবেলা সে তো কবেই হারিয়েছি। ছাদে বোনা শিউলী গাছের ফুলে তবুও খুঁজি সোনালি অতীত। যা কিছু ছিলো আমাদের তাকে কি ধরে রাখা যেতো না? এগুলো রেখেও তো করা যেতো এই শহরকে নূতন করে বিন্যাস! সবকিছুই বদলে গেছে। সারা বাংলাদেশ বদলে গেছে। এই বদল হারিয়ে যাওয়ার বদল, হেরে যাবারও বদল।

আমাদের অত্যাচারে যে প্রকৃতি নিস্তেজ ছিলো আজ তার রূপ নূতন করে পেখম মেলেছে। ঢাকাও কতো সুন্দর হয়ে উঠেছে! ছাদে উঠে যতোদূর চোখ যায়, দেখা পাই স্বচ্ছ সবুজের, কি ঝকঝকে! আকাশ এখন অনেক গাড় নীল। চাঁদের আলো এখন অনেক তীব্র। বাতাস এখন অনেক বেশি স্নিগ্ধ, কেমন আলতো আদরে ছুঁয়ে যায় আমাকে, শীতল করে দেয় মন। বৃষ্টির জল এখন অনেক পরিষ্কার। দু'হাত হাতের পাতায় ভরে সেই পানি পান করতে ইচ্ছে করে। আহা রে স্বপ্ন আমার!

স্বপ্ন মনের মাঝে বারবার উঁকি দিয়ে আবার নিজেকে গুটিয়ে ফেলে। কারণ, করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। তবুও আমরা বাইরে বের হচ্ছি প্রয়োজনে এবং অপ্রয়োজনে। অনুরোধ থাকবে সবার প্রতি অপ্রয়োজনে বাইরে বের হয়ে নিজের পরিবার এবং অন্য আরেকজনের পরিবারের বিপদ ডেকে আনবেন না। অনেক ভয়, অনেক মানসিক যন্ত্রণা বুকের মধ্যে পুষে নিয়েও একটা নূতন বাংলাদেশে নূতন করে বাঁচতে ইচ্ছে করে আমার। তাই আমি স্বপ্ন দেখি, ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখা নয়, দিবাস্বপ্নও নয়, দু'চোখ খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে, প্রকৃতির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখি- এক পরিবর্তিত নূতন বাংলাদেশ। হয়তো সেই দেশে আমিও হয়ে উঠবো এক নূতন মানুষ।

লেখিকা: মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ভাইস-প্রেসিডেন্ট

 

ঢাকা/হাসনাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়