ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

করোনাকালে মশা দমনে এখনই যা করতে হবে

ড. মো. আসাদুজ্জামান মিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ২১ মে ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
করোনাকালে মশা দমনে এখনই যা করতে হবে

বৈশ্বিক মহামারির দুর্যোগ বাংলাদেশেও সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি করেছে। জীবন বাঁচাতে সবকিছুই প্রায় অচল। সবার করুণ দৃষ্টি করোনার দিকে। আমাদের হাসপাতালগুলো করোনা রোগী নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এরই মধ্যে শোনা যাচ্ছে ডেঙ্গুর খবর। সারা দেশে মশার উৎপাত বাড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তিও হয়েছে।

বর্ষা মৌসুম আসন্ন। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। ফলে মশা বংশবৃদ্ধি করতে শুরু করেছে। গত বছর মশা বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ডিম পেড়ে রেখেছিল; সেগুলো থেকে এখন লার্ভা বের হচ্ছে। এতদিন পর্যাপ্ত পানির অভাবে মশার ডিমগুলো ফুটতে পারে নি। এই বৃষ্টির পানি যেখানেই (পরিত্যক্ত টায়ার, পানির ট্যাঙ্ক, বালতি, টব, গাছের গুঁড়ির ফাঁকা জায়গা, আবদ্ধ নালা ইত্যাদি) ২-৩ দিন পর্যন্ত জমা থাকছে সেখান থেকেই মশার লার্ভা জন্ম নিচ্ছে এবং তা থেকে তৈরি হচ্ছে মশা। এখনকার লার্ভাগুলো থেকে যেসব পূর্র্ণাঙ্গ মশা হবে তাদের ডেঙ্গু ভাইরাস জীবাণু বহন করার ঝুঁকি রয়েছে। গত বছর ভাইরাসবাহী মশারা যে ডিমগুলো পেড়ে রেখেছিল মূলত সেখান থেকে জন্ম নেওয়া মশাগুলোই আবার ভাইরাস বহন করার ক্ষমতা রাখতে পারে। এটা হচ্ছে মশার ভার্টিকাল ট্রান্সমিসন অর্থাৎ মশার বংশানুক্রমিক ভাইরাস জীবাণু বহন করার স্বক্ষমতা।

বর্ষা মৌসুমের শুরুতে এভাবেই নতুন জন্ম নেওয়া মশা ডেঙ্গু ভাইরাস জীবাণু বহন করে। পরবর্তী সময়ে সুস্থ মানুষকে কামড়ানোর মধ্যে দিয়ে নতুন করে ডেঙ্গু রোগের বিস্তার ঘটায়। যা পরে মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে (হরাইজন্টাল ট্রান্সমিসন পদ্ধতিতে অর্থাৎ মশা থেকে মানষু কিংবা মানুষ থেকে মশা)। তখন মশা ও মানুষ উভয়েই ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে এবং নতুন জন্ম নেওয়া মশাগুলোও খুব সহজে সংক্রমিত হয়। তখন শত চেষ্টা করেও ডেঙ্গু পরিস্থিতি আর নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। যেটা গতবছর আমরা দেখেছি। গেল বছর মশা আমাদের অনেক ভুগিয়েছে। প্রায় এক লাখেরও বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। অনেক প্রাণহানী (১৬৪ জন) ঘটেছিল। ২০১৯-এর জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর এই ৩ মাস দেশে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ। এ বছর এপ্রিলেই দেশে ডেঙ্গু রোগীর ছড়াছড়ি। গত বছর মশা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আগাম ও কার্যকরী পদক্ষেপ না নেওয়ার ফলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল এবং অনেক চেষ্টা করেও তারা উল্লেখযোগ্য সফলতা দেখাতে পারেনি। তাই মশা নিয়ে আমাদের এখনই ভাবতে হবে। করোনা দুর্যোগের এই সময়ে ডেঙ্গুুর প্রতিকার নয় বরং করতে হবে মশার শক্ত প্রতিরোধ। কর্তৃপক্ষকে মশা নিয়ন্ত্রণে এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।

২.

জৈষ্ঠের শুরু হলো মাত্র। এ সময় ২-১ দিন পরপর থেমে থেমে ঝড়-বৃষ্টি হবে। বৃষ্টির পানি চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে এবং অনেক জায়গায় জমে থাকবে। জমা পানিতে জন্ম নেবে মশার লার্ভা। সুতরাং বর্ষার শুরুতে জন্ম নেওয়া এই লার্ভা ধ্বংস করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য প্রয়োজন বিশেষ ব্যবস্থাপনা। লার্ভা ধ্বংস করতে এর উৎস ধ্বংসকরণ ও কীটনাশক কার্যক্রম বিশেষভাবে পরিচালনা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি গণসচেতনতা বৃদ্ধি ও সাধারণ মানুষের করণীয় নিশ্চিত করা দরকার। মশার লার্ভা যাতে আমাদের বাসায় বা আঙিনায় জন্ম নিতে না পারে সেটি লক্ষ্য রাখতে হবে। ব্যক্তিগত স্থাপনা বা বাসাবাড়ি পরিষ্কার পরিছন্ন রাখার দায়িত্ব স্ব-স্ব মালিককে বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমরা এখন একটা কঠিন সময় পাড়ি দিচ্ছি। ব্যক্তিগত প্রোটেকশন নেওয়া এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিকও বটে।

৩.

বৈশ্বিক কোভিড-১৯ দুর্যোগে দেশ মূলত এখন লকডাউন অবস্থায় আছে। তাই সরকারি-বেসরকারি বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান, অফিস, বিল্ডিং, স্থাপনা বা পরিত্যক্ত স্থানগুলো বন্ধ। হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও তালাবদ্ধ। তাই এসব জায়গায় মশা এবং এর লার্ভা নির্বিঘেœ জন্ম নেওয়ার সুযোগ পাবে। সুতরাং এসব জায়গায় কর্তৃপক্ষকে এখনই বিশেষ নজর দিতে হবে। তাছাড়া করোনার এই সময়ে আমদের বেশিরভাগ বাসাতেই থাকতে হচ্ছে এবং এতে মশারাও আমাদের কামড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে বেশি। করোনাকাল দীর্ঘ হলে এই সুযোগ আরো বাড়বে এবং ডেঙ্গুর ঝুঁকিও বাড়বে। মশা করোনাভাইরাস না ছড়ালেও ডেঙ্গু ঠিকই ছড়াবে। তাই আমাদের মশা থেকে সুরক্ষিত রাখতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এ সময়গুলোতে ফুল-স্লিভস জামা পরিধান, ঘুমের সময় মশারী টানানো, দরজা-জানালায় নেট স্থাপন বা অপ্রয়োজনে না-খোলা, বাজারের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ক্রিম, স্প্রে বা কয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে।

৪.

সরকার এ বছর মশা দমনে আগাম ভাবতে শুরু করেছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষও সজাগ আছে। মিডিয়াও যথারীতি সোচ্চার। গত বছর মিডিয়া ডেঙ্গু মহামারি নিয়ে ব্যাপক কাভারেজ দিয়েছিল। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণে মিডিয়াগুলোকে আরো বেশি সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন, বিশেষ করে বৃষ্টির পানি জমতে না-দেওয়া বা লার্ভা না-জন্মানোর ব্যাপারে। কারণ ডেঙ্গুর ভয়াবহতা ঠেকাতে মশা নিয়ন্ত্রণ পূর্বশর্ত। ঠিকমতো মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না-পারলে ডেঙ্গুর মহামারি ঠেকানো যাবে না। তাই সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই মশা রুখতে হবে। তবে মশা সামলাতে গিয়ে করোনার কথা ভুলে গেলে মহাবিপদ হবে

লেখক: মশা গবেষক ও সহযোগী অধ্যাপক (কীটতত্ত্ব), পবিপ্রবি, বাংলাদেশ


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়