ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

টিনটিন ইন কঙ্গো অথবা রক্তাক্ত ৬০ বছর

জয়দীপ দে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:২২, ৩০ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
টিনটিন ইন কঙ্গো অথবা রক্তাক্ত ৬০ বছর

চে গুয়েভারা কঙ্গো গিয়েছিলেন বিপ্লবের আগুন জ্বালাতে

টিনটিন ইন কঙ্গো। দারুণ একটি কিশোর এডভেঞ্চার কমিক্স! কালো অসভ্য মানুষের দেশে বুদ্ধি খাটিয়ে কত কিছুই না করে বেড়ায় টিনটিন। তার কাছে কালো মানুষগুলো পশুর মতো! দিব্যি সে মানুষের ঘাড়ে চড়ে বেড়ায়। মানুষগুলো তাকে দেবতাজ্ঞান করে। কালোগুলোর নির্বুদ্ধিতায় পাঠকের বিমলানন্দ হয়। ছোটরা এসব দেখে মজা পায়। আমরাও নিছক কমিক্স ভেবে উপভোগ করি। কিন্তু কমিক্সের আড়ালে যে রূঢ় বাস্তবতা, সেটাও অনেকটা কমিক্সের মতোই। কমিক্সটি লিখেছিলেন জর্জ রেমি। বেলজিয়ামের নাগরিক।

১৮৭৬ সালে কঙ্গো নদীর অববাহিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড নিজস্ব সম্পত্তি ঘোষণা করেন। যার আয়তন ২৩ লক্ষ ৪৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার। ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য একে ‘আফ্রিকার হৃদপিণ্ড’ বলা হয়। কঙ্গো নদীর মতো এতো দীর্ঘ খরস্রোতা নদী পৃথিবীতে দুটো নেই! বলা হয় এই নদী থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করে আফ্রিকার বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো সম্ভব। সবুজে ঢাকা এতো বিশাল দেশ আফ্রিকায় আর নেই! আর এই সবুজ মাটির নিচে লুকিয়ে আছে তামা কবাল্ট আর হীরার খনি। রাবার চাষের জন্যও রয়েছে দেশটির খ্যাতি। আমাদের দেশে যেমন নীল চাষ করত ব্রিটিশরা, দিনেমাররা সেভাবে রাবারের চাষ করত সেখানে। আরেকটা গোপন খনি আছে। সেটা হলো ইউরেনিয়ামের। জাপানে আমেরিকা যে পারমাণবিক বোমা ফেলেছিল সেই বোমার ইউরেনিয়াম এই কঙ্গো থেকেই গিয়েছিল।

১৯৬০ সালের ৩০ জুন দেশটি স্বাধীন হয়। দেশ স্বাধীন হয়, সরকার পাল্টায়- কিন্তু টিনটিন সাহেবরা কালো মানুষের কাঁধ থেকে নামে না। সাম্রাজ্যবাদীরা কঙ্গোর উপর থেকে অধিকার ছাড়ে না। ছাড়বে কি করে? যে দেশের পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকে হীরা জহরত মণিমুক্তা, বোকা-হাবড়া মানুষগুলো এসবের মূল্য না বুঝলেও, সাহেবরা ঠিকই বোঝে। এদের কল্যাণে প্রাকৃতিক সম্পদে সবচেয়ে ধনী যে দেশ, সেই দেশের মানুষ হয় পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র।

টিনটিনরা কীভাবে যুগযুগ কালো মানুষগুলোকে অসভ্য করে রেখেছে, কীভাবে সেই অসভ্যতার সুযোগ নিয়ে তাদের দেশে লুটপাট চালাচ্ছে তার একটা চিত্র দেব আজ।

প্যাট্রিস লুমুম্বা। কঙ্গোর প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, বিপ্লবী, ট্রেড ইউনিয়নের নেতা। তার হাতেই কঙ্গো বেলজিয়ামের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছিল।
 


প্যাট্রিস লুমুম্বা স্বাধীনতার জন্য সোচ্চার ছিলেন
 

বহুগোষ্ঠীতে বিভক্ত কঙ্গোয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে কে কোন গোষ্ঠীর লোক সেটা প্রধান বিবেচ্য বিষয়। তাই সেখানে কারো পক্ষে সব গোষ্ঠীর মন জোগানো সম্ভব নয়। তিনি ছিলেন ছোট্ট টেটেলা জাতিগোষ্ঠীর লোক। ১৯৬০-এর মে মাসে জাতীয় নির্বাচনে ১৩৭টি আসনের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে লুমুম্বার এমএনসি মাত্র ৩৩ আসন পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়। বাধ্য হয়ে তাকে কোয়ালিশনে যেতে হয়। কঙ্গোর আরেক জাতীয়তাবাদী নেতা জোসেফ কাসাবুভু আবাকোর দল পায় ১৩টি আসন। এই দুই দলের নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। লুমুম্বা, কাসাবুভুকে প্রেসিডেন্ট পদ দিয়ে নিজে হলেন কঙ্গোর প্রথম প্রধানমন্ত্রী। অবশেষে জুন মাসে ৭৫ বছরের বেলজিয়াম শাসনের অবসান হয়। কিন্তু ক্ষমতায় বসার পর থেকে তাকে সেনাবাহিনীর দেশীয় সৈনিকরা সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য চাপ দিচ্ছিল। এদিকে সেনাপ্রধান এমিলি জনসন (বেলজিয়ান অফিসার) সৈনিকদের অসন্তোষ কমাতে ক্যাম্প লিওপোল্ড-২ তে দরবার ডাকেন। সেটা হয়ে যায় হিতে বিপরীত। অধীনস্থ সেনাসদস্যদের সঙ্গে তার বাদানুবাদ হয়। সেই অসন্তোষ সারা সেনাবাহিনীতে ছড়িয়ে পড়ে। অসন্তোষ নিবারণে লুমুম্বা জনসনকে বরখাস্ত করেন। সকল স্বদেশী সৈনিকদের এক পদ উপরে পদোন্নতি দিয়ে ইউরোপিয়ান অফিসারের জায়গায় তাদের বসান। জোসেফ মবুটু নামে অবসরে যাওয়া এক সৈনিককে সেনাপ্রধান বানান। তারপরও সেনাবাহিনীতে অস্থিরতা থামেনি। বরং নেতৃত্বহীনতার কারণে শুরু হয়ে বিশৃঙ্খলা। সৈনিকরা বিভিন্ন জায়গায় লুটপাট শুরু করে। ইউরোপীয়দের ঘর বাড়িতে আক্রমণ চালায়। এ অজুহাতে বেলজিয়াম ৬০০০ সৈন্য পাঠায় কঙ্গোয়। কঙ্গোর সৈনিকদের সঙ্গে এদের খণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। বেশির ভাগ ইউরোপীয় কাতাঙ্গা প্রদেশে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কারণ সেখানে কঙ্গোর বেশির ভাগ খনি হওয়ার কারণে এমনিতেই ইউরোপীয়দের সংখ্যা বেশি।

এ সুযোগে কাতাঙ্গার মুখ্যমন্ত্রী তসম্বে কাতাঙ্গাকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে। লুমুম্বার সেনাবাহিনীর বেলজিয়ান সেনাবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়ানোর সামর্থ্য ছিল না। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করে তারা। জাতিসংঘের ১৪৩ নম্বর রেজুলেশনে বেলজিয়ামকে তার সৈন্য ফেরত নিতে আহ্বান জানানো এবং কঙ্গোয় শান্তিরক্ষী বাহিনী নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। জাতিসংঘ বাহিনী এলেও তারা কোনো অভিযানে নামেনি। বাধ্য হয়ে ১৪ জুলাই সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য চায় লুমুম্বা সরকার। এতেই ক্ষেপে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

এদিকে কোনো পক্ষ থেকে সাহায্য না পেয়ে আগস্টের মাঝামাঝি লুমুম্বা তার সৈন্যবাহিনীকে কাতাঙ্গার দিকে মার্চ করতে বলেন। দক্ষিণ কাসাই অঞ্চল দখলের জন্য তার সৈন্যরা যুদ্ধ শুরু করে। এখানে রেল জংশন। অনেকগুলো খনি। আবার কাতাঙ্গা প্রদেশে ঢোকার মুখ। কিন্তু সেখানে অভিযান চালাতে গিয়ে লুবা জনগোষ্ঠীর উপর নির্বিচার গণহত্যা চালায় সেনাবাহিনী। লুবারা এর জন্য লুমুম্বাকে দায়ী করে। এদিকে প্রেসিডেন্ট কাসাবুভু দাবি করে ইউনিটারি গভর্নমেন্ট ভেঙে একটি ফেডারেল সরকার গঠনের জন্য। এটা না করলে সমস্যার সমাধান হবে না। এদিকে লুমুম্বা আগস্টের ২১ তারিখ আফ্রিকার বিভিন্ন নেতাকে তার রাজধানীতে দাওয়াত দেন কাতাঙ্গা সমস্যা সমাধানে তাকে সাহায্যের আহ্বান জানিয়ে। কিন্তু সে নিমন্ত্রণে কেউ সাড়া দেয়নি। জাতিসংঘও সেনা অভিযানে অস্বীকৃতি জানায়। এমন অবস্থায় সোভিয়েত হস্তক্ষেপ সময়ের ব্যাপার বোঝা যাচ্ছিল। তখন তৎপর হয়ে ওঠে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ।

সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০ প্রেসিডেন্ট কাসাবুভু বেতারে ঘোষণা করেন তিনি লুমুম্বা সরকারকে বরখাস্ত করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা কঙ্গো ও সোভিয়েত রাষ্ট্রের যোগসাজশে গণহত্যা চালিয়েছে। কিন্তু লুমুম্বা নিজের অবস্থানে পরিষ্কার। তিনি জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রিত বেতারকেন্দ্রে গিয়ে সে অভিযোগ অস্বীকার করে। এবার কাসাবুভু আর লুমুম্বার মধ্যে শুরু হয় ক্ষমতার টানাটানি। এই ফাঁকে ১৪ সেপ্টেম্বর সেনাপ্রধান মবুটু বিদ্রোহ করে। এতে যারপরনাই অবাক হোন লুমুম্বা। কারণ পথ থেকে তুলে এনে যাকে তিনি সেনাপ্রধান বানালেন সেই কিনা বিশ্বাসঘাতকতা করে বসল। তিনি সরাসরি প্রধান সেনানিবাস লিপোল্ডে গিয়ে মবুটুর সঙ্গে দেখা করেন। কোনোভাবে তিনি তাকে সম্মত করাতে পারছিলেন না। আলোচনার শেষে রাতে তিনি সেনানিবাসে ঘুমিয়ে পড়েন। সকালবেলা লুবা গোষ্ঠীর সৈনিকরা তাকে বন্দি করে। পরে জাতিসংঘের সৈনিকরা এসে লুমুম্বাকে উদ্ধার করে। কিন্তু এই ফাঁকে সৈনিকদের হাতে তার ব্রিফকেসটি চলে যায়। তাতে পাওয়া যায় চাঞ্চল্যকর সব তথ্য ও কাগজপত্র। তাতে দেখা যায় এক সপ্তাহের মধ্যে সোভিয়েত বাহিনী কঙ্গো আসছে। সঙ্গে ঘানার স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা এনক্রুমার চিঠি। সিআইএ এবার হার্ড লাইনে যায়।
 


কঙ্গোর খনিতে কাজ করছেন একজন শ্রমিক
 

পরিস্থিতি সুবিধার নয় বুঝতে পেরে লুমুম্বা তার পরিবার ও অনুচরদের নিয়ে রাজধানী ত্যাগ করেন। ১ ডিসেম্বর সাংকুরু নদী পার হওয়ার সময় মুবুটুর সৈনিকরা তার স্ত্রী ও সন্তানকে গ্রেপ্তার করে। লুমুম্বা ততক্ষণে নদী পার হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের কথা ভেবে আবার ফেরি নিয়ে ফিরে আসেন। গ্রেপ্তার হন। তারপরের ইতিহাস বড় নির্মম। তাকে লুবা সৈনিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তারা তাকে কেটে টুকরো টুকরো করে এসিড দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। শেষ হয় যায় টিনটিন সাহেবদের কঙ্গো থেকে তাড়ানোর স্বপ্ন।

তারপর ৩৭ বছর মুবুটু কঙ্গো শাসন করেন। দক্ষিণ কিভু প্রদেশে গড়ে ওঠা একটি মার্ক্সবাদী দল রাজধানী কিংসাসা দখল করলে ১৯১৯৭ সালের ১৬ মে তিনি দেশ ছেড়ে মরক্কো পালিয়ে যান। তিন মাস পর তিনি ক্যানসারে মারা যান। ক্ষমতায় আসেন যুদ্ধবাজ উপজাতি নেতা লরেন্ট কাবিলা। ২০০১ সালে তিনি চিকিৎসার জন্য জিম্বাবুয়ে যাওয়ার পথে নিহত হন। তারপর ১৮ বছর তার ছেলে জোসেফ কাবিলা দেশ শাসন করেন। তিনি ২০০৬ ও ২০১১ সালে নির্বাচনে জয় লাভ করেন। ২০১৯-এর জানুয়ারি থেকে ফেলিক্স সিসেকেডি ক্ষমতায় আছেন।

১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে চে গুয়েভারা কঙ্গোতে এসেছিলেন বিপ্লবের আগুন জ্বালাতে। তিনি বিপ্লবী নেতা লরেন্ট-ডেজায়ার কাবিলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কাবিলা দেশে ছিলেন না বলে দেখা হয়নি।

মবুটুর পরিণতির জন্য নিজেই দায়ী ছিলেন। আমেরিকার খেয়েপরে তিনি চীন থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। অথচ তার আমলে ১২ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এ টাকা কোথায় গেছে তিনিই জানে! কঙ্গোতে এখনো কোনো ভালো সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। প্রাগৈতিহাসিক কালের মতোই কঙ্গো নদী যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম। মবুটু অবশ্য ব্যক্তিগত কনকর্ড বিমান ছাড়া ইউরোপ যেতেন না। তার বাগান বাড়ি আর শান শওকত ইউরোপীয়দের কাছে রূপকথার মতো ছিল।

তবে যতটা সংক্ষেপে ক্ষমতা বদলের ইতিহাস বলে গেলাম ততটা সংক্ষিপ্ত ও মসৃণ ছিল না যাত্রাপাথ। ১৯৯৬ সালে লরেন্ট কাবিলার কিংসাসা আক্রমণ থেকে শুরু হয় কঙ্গোর গৃহযুদ্ধ। কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে ডজনখানেক যুদ্ধবাজ গ্রুপ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সক্রিয় ছিল। এটা নিয়ন্ত্রণের জন্য জাতিসংঘের বিপুলসংখ্যক শান্তিরক্ষী বাহিনী সেখানে কাজ করে। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরাও সেখানে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন। ২০০৬ সালে জাতিসংঘের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হওয়া পর্যন্ত তা চলতে থাকে। এতে ৩০ লাখ মানুষ মারা যায়।

এ রক্তাক্ত জনপদে স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের ৬০ বছর পূর্ণ হবে ৩০ জুন। সাময়িক স্বস্তিতে থাকলেও আবার যুদ্ধের ঝুঁকি রয়ে গেছে বিবাদমান জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে। যতদিন পর্যন্ত ইউরোপীয়দের হাত থেকে এদের খনিগুলো মুক্ত না হবে, এই ঝুঁকি থেকেই যাবে। ৮ কোটি কঙ্গোবাসী টিনটিন সাহেবদের গোলামীর হাত থেকে মুক্তি পাবে না।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়