ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

দেশীয় পর্যটনের বিকাশ ঘটানোর সুবর্ণ সুযোগ

মো. কামরুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৫, ১৭ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ০৮:৪৪, ২৯ আগস্ট ২০২০
দেশীয় পর্যটনের বিকাশ ঘটানোর সুবর্ণ সুযোগ

মো. কামরুল ইসলাম

আমরা শুদ্ধাচারের কথা বলি, কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারি সারাবিশ্বকে অঙ্গুলি প্রদর্শন করে শুদ্ধাচার কি, তা দেখিয়ে দিয়েছে। প্রত্যেকের দুর্বলতাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তুলে এনেছে। পরনির্ভরশীলতাকে দূরে ঠেলে আত্ননির্ভর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে কোভিড-১৯।  

বিশ্ব বাণিজ্যের দু’একটি খাত ছাড়া সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোনো বার্ষিকী পরিকল্পনাই কাজে আসেনি। স্বল্পমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি কিংবা অতিদীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনাই কোভিড এর কাছে টিকে উঠতে পারেনি।  উন্নত বিশ্ব কিংবা আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ অথবা আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলো, কেউই কোভিড-১৯ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। 

পরম পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, চীন, বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতাধর ভারত কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশ করোনাভাইরাসের কাছে পর্যদুস্ত। মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হচ্ছে চিকিৎসা। অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে সারবিশ্বের চিকিৎসা ব্যবস্থা। 

কোভিড-১৯ এর কারণে উড়োজাহাজ চলাচল ও পর্যটন খাত চরমভাবে বিপর্যস্ত। যেসব দেশের আয়ের প্রধান খাতই পর্যটন, সেখানে অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয় হওয়ার শঙ্কায়ও পড়েছে। সারাবিশ্বের আকাশপথ অনেকটা লকডাউন ছিলো।  ধীরে ধীরে সেই আকাশ খুলতে শুরু করেছে। বিভিন্ন শর্তারোপের মধ্যেই এয়ারলাইন্সগুলো হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি মাথায় নিয়ে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবকালীন সময়ে ব্যবসার ভিন্নতার মধ্যেই আয়ের উৎস খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করছে। 

সারাবিশ্বে পর্যটনখাত একটি অন্যতম শক্তিশালী শিল্পখাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলো।  বাংলাদেশে ইনবাউন্ড-আউটবাউন্ড ট্যুরিজমকে কেন্দ্র করে শতশত প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিলো, যেখানে লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছিলো। করোনাভাইরাসের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ের সব পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো।  প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম। গত এক দশকে বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বাংলাদেশে পর্যটক শ্রেণি গড়ে ওঠে। যারা সুযোগ পেলেই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের বিভিন্ন আকর্ষণীয় গন্তব্যে ভ্রমণ করার অভ্যাস গড়ে তুলে।  ভ্রমণ করার পরিকল্পনার সঙ্গে আয়ের সক্ষমতাও একটা বড় ব্যাপার।

বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের প্রতিযোগিতামূলক ভাড়ার কারণে, সহজলভ্য ট্যুরিস্ট ভিসা পাওয়াও একটা বড় বিষয়। একটা সময় বাংলাদেশে পর্যটন বলতেই আমরা বুঝতাম কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত অথবা সিলেটের চা-বাগান কিংবা সুন্দরবন। সেটাও আবার শীতকাল কেন্দ্রিক।  বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকেও শুধুমাত্র শীতকালে সপ্তাহে দু’টি কিংবা তিনটি ফ্লাইট পরিচালিত হতো ঢাকা থেকে কক্সবাজার। হাতে গোনা কিছু ভালোমানের হোটেল (বেশীরভাগই পর্যটন কর্পোরেশন পরিচালিত) ছিলো। 

প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের যাত্রা শুরুর পর থেকেই কক্সবাজারে সারা বছর ফ্লাইট পরিচালনা করতে থাকে।  সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গড়ে উঠতে থাকে আন্তর্জাতিকমানের চার/পাঁচ তারকামানের হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট। ফলে দেশীয় পর্যটকদের পাল্লা দিয়ে বিদেশি পর্যটক বাড়তে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরিণত করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।

গত সাত বছরে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী সংখ্যা বেড়েছে তিনগুণ। যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পর্যটনকে উৎসাহিত করেছে। সারা দেশে গড়ে উঠেছে অনেক উন্নতমানের হোটেল-মোটেল কিংবা রিসোর্ট। মানুষ একটু সুযোগ পেলেই ঘুরতে বেড়িয়ে পরে পরিবার পরিজন নিয়ে।  আজ কোভিড-১৯ এর কারণে এভিয়েশন, ট্যুরিজম এর সঙ্গে হোটেল ব্যবসায়ও চরম ধ্বস নেমেছে। এখাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারী কিংবা কর্মী সবাই একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

কোভিড-১৯ এর বিস্তার জ্যামিতিক হারে না বাড়লেও গাণিতিক হারে এখনো বাংলাদেশে বেড়ে চলেছে। কিন্তু সরকার বেশ কিছু স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনা দিয়ে এভিয়েশন, ট্যুরিজম ও হোটেল ইন্ডাস্ট্রিজকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে, কিংবা এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার ভবিষ্যতকে নিরাপদ রাখতে ১ জুন থেকে ধারাবাহিকভাবে অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেয়। প্রথম দিকের তুলনায় বর্তমানে কিছুটা যাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। 

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, বহির্বিশ্ব থেকে যাত্রী আসা বন্ধ বলা চলে, পর্যটক শূন্যতা, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কারণে ওয়ার্ক স্টেশন ছেড়ে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোথাও মুভমেন্টের নিষেধাজ্ঞা আছে। সবাই ভার্চুয়াল মিটিংয়ে অভ্যন্ত হয়ে গেছে।  নানাবিধ কারণে যাত্রী সংখ্যা কমে গেছে। সেই সঙ্গে রয়েছে সরকারি কিছু বিধি নিষেধ। 

এত কিছুর পরও ফ্লাইট শুরু হওযার পর ধীরে ধীরে যাত্রী সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে কক্সবাজার রুটে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি পাওয়ায় পর্যটকদের উপস্থিতি দেখতে পাচ্ছি। ১৭ আগস্ট থেকে সরকারি স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনা দিয়ে সব হোটেল মোটেল রিসোর্টসহ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দের্যের লীলাভূমি দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের। 

পৃথিবীর প্রায় সব দেশই নিজেদের নাগরিকদের কথা বিবেচনা করে কোভিড-১৯ সময়ে পর্যটকদের নিরোৎসাহিত করছে। ট্যুরিস্ট ভিসা পুরোপুরিভাবেই বন্ধ রেখেছে দূতাবাসগুলো। এ অবস্থা চলতি বছরের বাকি সময় থেকে আগামী বছরও স্থায়ী হতে পারে।  সব কিছুই নির্ভর করছে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ওপর। সেই সঙ্গে ভ্যাকসিনের সহজলভ্যতা একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। 

অর্থনীতির গতিশীলতা বাড়াতে সরকার কাজ করছে। বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে সরকার ব্যবসা বাণিজ্যকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে অনবরত। আত্ননির্ভরশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধ পরিকর। চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিচ্ছে। দুর্নীতিকে জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এ খাতকে শক্তিশালী করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। বর্তমানে তৈরি হওয়া পর্যটক শ্রেণিকে দেশীয় পর্যটনে উদ্বুদ্ধ করতে সারাদেশের আনাচে কানাচে গড়ে ওঠা পর্যটনকেন্দ্রগুলোকে স্বাস্থ্য সম্মতভাবে প্রস্তুত রাখতে হবে।  বিশেষ করে কক্সবাজারের পাশাপাশি সেন্টমার্টিন, হিমছড়ি, ইনানী বিচসহ সব দর্শনীয় স্থানগুলো।

সিলেটের চা বাগান, জাফলং, রাতারগুল জলাবন, হাকালুকি হাওর, লালাখাল, ভোলাগঞ্জ, বিছনাকান্দি, তামাবিল, মাধবকুণ্ডের জলপ্রপাত, পাহাড়, ঝরনা সব মিলিয়ে নানা বৈচিত্র্যের সম্ভার রয়েছে সীমান্তঘেঁষা বিস্তীর্ন সবুজ লীলাভূমি। 

ঐতিহ্যময় বাংলার সৌন্দর্য সুন্দরবন, বগুড়ার মহাস্থানগড়, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, রামসাগরসহ সারা দেশের আকর্ষণীয় সব পর্যটনকেন্দ্রগুলো পর্যটকদের সামনে তুলে ধরতে হবে। পর্যটকদের সামনেও দেশকে চেনার-জানার একটি সুযোগ চলে এসেছে করোনা মহামারির কারণে। 

বিগত একদশক ধরেই বাংলাদেশের একশ্রেণির পর্যটক যারা প্রতিবছর ভারত, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, মালয়শিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, চীন, জাপানসহ মধ্যপ্রাচ্য কিংবা ইউরোপ-আমেরিকায় পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে যায়; এ বছর দেশের বাইরে ভ্রমণে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে বিভিন্ন দেশের নিয়মনীতি কারণে।

আবার অনেকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধও করবে না বিদেশ ভ্রমণে। করোনাভাইরাস দেশীয় পর্যটকদের অভ্যন্তরীণ ট্যুরিজমের প্রতি আকৃষ্ট করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করার সম্ভাবনা রয়েছে। করোনাভাইরাস পর্যটন শিল্পের জন্য একটা ব্রেকথ্রু হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর সেটার জন্য দেশীয় পর্যটন শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পরিণত করতে হবে।   

পজিটিভ বাংলাদেশ গঠনে ২০২১ সাল হোক দেশীয় পর্যটন শিল্পের জন্য স্মরণীয় বছর।

 

লেখক- মো. কামরুল ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক- জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স লিমিটেড

ঢাকা/জেডআর

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়