ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আমার দুর্গাপূজা এবং অর্থনৈতিক বাণিজ্যায়ন || বাবলু ভট্টাচার্য

বাবলু ভট্টাচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ১৯ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমার দুর্গাপূজা এবং অর্থনৈতিক বাণিজ্যায়ন || বাবলু ভট্টাচার্য

বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবন থেকে অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। অনেক ভালো লাগা জিনিসই বড় হয়ে গেলে আর ভালো লাগে না। দুর্গাপূজাও কি সেই ভালো না লাগার তালিকার একটা? একা আমারই কি পূজোর মজাগুলো ম্যাড়মেড়ে, পানসে লাগে? আর কি মনে ধরে না সেই ছোটবেলার মতো? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর অনেকেই খুঁজে ফেরেন। একা আমি নই, অনেকেই ভোগেন একটা অতৃপ্তিতে। বোঝেন আনন্দ ঠিক কোথা থেকে আসে, বোঝেন আনন্দের উৎস শুধু হুল্লোড় নয়। আমাদের জীবন থেকে অনেক কিছুই চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে। মনে মনে নিজেই তার একটা তালিকা তৈরি করেছি। এই হারিয়ে যাওয়া, ক্ষয়ে যাওয়া, পরিবর্তিত হয়ে যাওয়া, তলিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কবে থেকে শুরু হলো কে জানে!

অনেকে বলেন, ষাটের দশকের গোড়া থেকে। বিষয়টাকে অর্থনীতির নিরিখে বিচার করে তাঁরা বললেন, এক আনা, দু’আনা, চার আনা, ষোল আনার বদলে নতুন দশমিক পদ্ধতির টাকা-পয়সা যখন ধেয়ে এলো, অচল হয়ে গেল তামার পয়সা, ফুটো পয়সা, তখন থেকেই বাঙালির মানসিকতা পরিবর্তিত হয়ে গেল ব্যাপকভাবে। যাকে বলে পজিটিভ চেঞ্জ। কথাগুলো আমার মনে ধরেছে। অন্তত পূজোটুজো নিয়ে যখন ভাবি, তখন দেখি কোথায় গেল সেই পাঁচ সিকে পাঁচ আনার পূজো, ষোল আনার মানত কিংবা প্রণামীর থালায় তামার পয়সা ছুঁড়ে দেওয়ার অনির্বচনীয় শব্দ! অর্থনীতি যে আমাদের দাপিয়ে নিয়ে, ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে সে বিষয়ে তো কোনও সন্দেহ নেই। সে দশমিক পদ্ধতির অর্থনৈতিক সচেতনতাই হোক কিংবা মেট্রিক পদ্ধতির বাণিজ্যায়ন!

পূজার স্মৃতিচারণে প্রথমেই যেটা মনে আসে সেটা আগমনী গান। আজকাল আর আগমনী গান শুনতেই পাওয়া যায় না। পূজোর নিজস্ব আগমনী গান হারিয়ে গেছে। গ্রামোফোনের পর ক্যাসেট-সিডির সঙ্গে সঙ্গে পূজার গানটাও গেছে। আর এখন গান ব্যাপারটাই তো চলে গেছে। এখন শুধু শব্দদৈত্য তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে লম্ফঝম্প করে দেদার হুল্লোড়। আমার ছোটোবেলার আগমনী গানের স্মৃতি খুঁড়ে বের করেছি রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের- ‘গিরি, এবার আমার উমা এলে, আর উমা পাঠাব না।

বলে বলবে লোকে মন্দ, কারো কথা শুনবো না।

যদি এসে মৃত্যুঞ্জয়, উমা নেবার কথা কয় —

এবার মায়ে-ঝিয়ে করবো ঝগড়া, জামাই বলে মানব না।’

এই গানও একদিন বাঙালি তথা বাংলা থেকে মুছে গেল। দুর্গাপূজা আসে, কিন্তু কোথাও আগমনী গান তো দূরের কথা হাবিজাবি গান ছাড়া আর কিছু বাজে না। পূজা, বিয়ে, অন্নপ্রাশন, পিকনিক, হুল্লোড় — সবেতেই একই গান। একই তার মেজাজ। মহালয়া থেকে শুরু হয়ে যেত পূজার। আজও  হয়,কিন্তু কতটা আলাদা। আজ আর মহালয়ার ভোরের রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠ কারো মনে আবেশ তৈরি করে না। কিন্তু একটা সময় মানুষ পাগল থাকত এই কণ্ঠের জন্য। চতুর্দিকে তখনও অন্ধকার। মা ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতেন। খুব ভোরে মহালয়া শুনবো— এই উত্তেজনায় রাত্রে ভালো ঘুমও হত না। তখন তো ঘরে ঘরে ট্রানজিস্টার রেডিওর এমন চল ছিল না। আর টেলিভিশনের কথা তো ভাবতেই পারতাম না। বাল্‌ব লাগানো, এরিয়াল ঝোলানো ঢাউস সব রেডিও। পরেশদার রেডিও`র দোকান থেকে আমার বাবা ১১৫ টাকা দিয়ে একটা `মারফি` রেডিও কিনেছিলেন। তিনি মহালয়ার আগের দিন থেকে ঝেড়ে মুছে, শব্দ যন্ত্র পরীক্ষা করে, আমাদের নাগালের বাইরে তুলে রাখতেন। যাতে করে, স্বপ্নের মহালয়া ঠিকঠাক শুনতে পারা যায়। আর সেখান থেকেই শুরু হয়ে যেত পূজা। কিন্তু আমাদের পূজা শুরু হতো আরো আগে থেকেই- সেই রথের দিন থেকে।

সেই পূজোও পাল্টে গেছে। রথের দিন থেকে তো অনেক দূরের কথা। এখন ষষ্ঠী কিংবা সপ্তমীতেও উমার জন্যে মন কেমন করে না। কাশ আর শিউলি ফুলের শরৎ কি মনের মাঝে সেই দোলা তৈরি করে এখনও? কিন্তু এই পাল্টে যাওয়া তো একমুখী নয়। পাল্টে গেছে পূজার ফ্যাশন, পূজার ধরণ সবকিছুই। ফ্যাশনে রেডিমেড পোষাকের চল এতটাই বেড়ে গেছে যে পাড়ায় পাড়ায় যে সব দর্জির দোকানগুলো ছিল সেগুলোর অধিকাংশ এখন উঠেই গেছে। আমার ছোটবেলার পূজার ফ্যাশনের স্মৃতি বলতে থান কিনে দর্জির দোকানে দিয়ে বানানো মাপসই সুতির জামা-কাপড়। যেটা একটু একটু করে গ্রাস করে নিয়েছে রেডিমেড পোষাক বিপ্লব।

এভাবেই পাল্টেছে মণ্ডপ-সজ্জা, প্রতিমা-সজ্জা, শৈলী। এমন কি পারিবারিক পূজো থেকে বারোয়ারী পূজার পরিবর্তন। এখন পূজা মানে পৃথিবীর বিভিন্ন বিখ্যাত মনুমেন্টের অনুকরণে তৈরি প্যাণ্ডেলের জোয়ার। সে আরও বীভৎস। অনেকেই বাহবা দিচ্ছেন— দেখেছ, সামান্য কারিগর কাপড় আর কাঠ দিয়ে কী অভাবনীয় কাজ করেছে! আমি কোনওদিনই এগুলো দেখে উল্লসিত হইনি। বরং ভেবেছি, যে-শিল্পীরা এমন অনুকরণ করতে পারেন, তাদের দিয়ে কোনও মৌলিক শিল্পিত কাজ করালে ক্ষতি কি হতো! পূজোর ক’টা দিন আনন্দে আর মেতে উঠতে পারি না। ছোটোবেলার সেই মজা, সেই আনন্দ আর পাই না। বিশাল বিশাল মণ্ডপের সামনে লম্বা লম্বা লাইন ঠেলে জৈলুসপূর্ণ প্রাণহীন সেই পূজো দেখা আর ছোটোবেলায় আমার গ্রামের বা মামার বাড়ির গ্রামের সেই ঢাকের সাজের মাতৃগন্ধময় পূজো- এ দুটোর মধ্যে কোনো মিল পাই না আমি।

পূজার দিনগুলোতে তাই আমার কাছে মণ্ডপমুখী হওয়ার চেয়ে লেখাপড়া করে কিংবা শহর থেকে অনেক দূরে গিয়ে নিজের মত করে সময় কাটানো অনেক বেশি সুখকর, স্বস্তিদায়ক। ফেলে আসা দিনগুলোর সঙ্গে এখনকার পূজার তুলনা করলে মন খারাপ হয়ে যায়। অনেক কিছুই মেলে না। ঐতিহ্য শব্দটাকে নড়বড়ে মনে হয়। আবার এ কথাও ঠিক, দুর্গাপূজা আমাদের জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিলে বাঙালির সংস্কৃতি বলে আর কিছুই থাকবে না। আসলে দুর্গাপূজা বাঙালির জীবনে অঙ্গীভূত হয়ে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু যেখানে বাঙালিই পাল্টে গেছে গ্লোবালাইজেশন নামক এক ছায়াময় তত্ত্বকথায় পা মেলাতে সেখানে তার জীবনের অঙ্গ দুর্গাপূজা পাল্টাবে না এমন আশা করাটাই তো বোকামি।

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ অক্টোবর ২০১৫/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়