ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

গণমানুষের স্বপ্ন।। শরিফ নূরুল আম্বিয়া

শরিফ নূরুল আম্বিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৬, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গণমানুষের স্বপ্ন।। শরিফ নূরুল আম্বিয়া

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালি জাতির অহংকার ও গৌরবের বিষয়। বলা চলে এই মুক্তিযুদ্ধের চিন্তা-চেতনায় উজ্জ্বীবিত হয়ে আমি নিজেকে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নিয়োজিত করি। বিশেষ করে ১৯৬৪ সালে ৬ দফা আন্দোলন আমাকে বেশি আলোড়িত করে।

 

আমি কলেজ জীবনের শেষ প্রান্তে তখন। রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। এরপর পড়তে আসি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। একজন প্রকৌশলী হয়ে গর্বে বুক ভরে নিয়ে দাঁড়ানোর সাহস থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। তবে তার আগের সময়টাতে বেশি তাড়িত হই বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে।

 

১৯৬৯। গণআন্দোলন। ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে আমিও যোগ দেই। সে সময় ছাত্রলীগ নেতা ইসহাক ও অন্যদের সঙ্গে মধুর ক্যান্টিনে যেতাম। সেখানে আন্দোলন সংগ্রাম নিয়ে বক্তৃতা হতো। নেতাদের আবেগ, চিন্তা-চেতনায় আমরাও শানিত হতাম। এখানে একটি কথা না বললেই নয়, আর তা হলো সে সময়ের ছাত্রলীগই ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম বাহক ও ধারক। বাংলাদেশের মানুষকে ৬ দফা, ১৯৬৯-এর আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার জন্য ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকাও ছিল তখন অনেক। সব আন্দোলনই সে সময় দেশকে স্বাধীন করার জন্য করা হতো। কেননা, নেতারা আগেই ধারণা করেছিলেন যে, এমন একটা সময় আসবে যখন বাংলাদেশকে পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধে অংশ নিতে হবে। আর এই ধারণা সবাই পেয়েছিল ভাষা আন্দোলনের পর পরই। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণে ও ছাত্রলীগের কর্মী হওয়ার ক্ষেত্রে আমাকে যারা সহযোগিতা করেছিলেন তাদের মধ্যে সিরাজুর রহমান, আ স ম রব ছিলেন অন্যতম।

 

১৯৭১। ২৫ মার্চ। বাঙালির ইতিহাসে কালো রাত। এদিন আমরা সবাই ঢাকায়ই ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর আমরা যুদ্ধের প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। সে সময়ে তীর বল্লম নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বধ করার জন্য সবাই সচেষ্ট ছিলাম। গাছ কেটে ২৫ মার্চ রাতে ব্যারিকেড দিয়ে পাকিস্তানিদের শহরে ঢোকার পথ বন্ধ করেছিলাম। কিন্তু সে বাধা অতিক্রম করে পাকিস্তানিরা যে হত্যাযজ্ঞ চালায় তা সব নির্মমতাকে হার মানিয়েছে সে সময়। আমরাও হাতে বোমা বানিয়েছিলাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাবে। সে সময় হকার সালেমুল আমাদের বেশ সহায়তা করে। দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য বানানো কামান ও গোলাবারুদ বস্তায় ভরে মাটির নিচে রেখে দেয় সে। এখানে একটি কথা বলে রাখছি, ৭ মার্চের পর ঢাকা শহরে এক ধরনের অভ্যুত্থানের চিত্র ফুটে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বঙ্গবন্ধুর কর্মীরা মিছিল নিয়ে আসতে থাকে। আমরাও ৩২ নম্বরের বাড়িতে যেতাম। মূলত সেই মিছিলের চিত্র দেখেই ইয়াহিয়া সরকার ২৫ মার্চ রাতে হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়।

 

আজিমপুর থেকে ওই রাতে আমরা চলে যাই ওয়ারিতে। দুই দিন পর আজিমপুরে আসি। ইনু, নজরুল সবাই একসঙ্গে মনিরুল ইসলামের বাড়িতে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি নেতারা নদীর ওপারে চলে গেছে। আমরাও যোগাযোগ রেখে তাদের পথে রওনা দেই। রুহিতপুর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে সে সময় পুলিশ, বিডিআর আর ছাত্রদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। কিন্তু সেখানে বেশিদিন থাকা হয়নি। কেননা, পরের দিনই কেরানীগঞ্জে আক্রমণ করে পাকিস্তানি মিলিটারি। আমরা নেতাদের পরামর্শে ঢাকায় চলে আসি। কিছু অংশ চলে যায় মুজিবনগরে। আমাদের বলা হলো ঢাকা সিটি রক্ষার জন্য কাজ করতে হবে। কিন্তু ঢাকায় বসে আমরা কি করব। যুদ্ধে যেতে হবে। এর মধ্যে ১৭ এপ্রিল শুনলাম সরকার গঠন হয়েছে। আমাদের অস্ত্র দেওয়া হবে। কিন্তু কিছুদিন পর আমরা আর অস্ত্রের অপেক্ষা না করে ২৫ মে মুজিবনগরের উদ্দেশ্যে রওনা হই। ৩/৪ দিন হেঁটে করিমপুর ক্যাম্পে যাই। সেখানে বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেল ফোর্স গড়ে তোলা হচ্ছিলো। এই বিএলএফ মূলত বঙ্গবন্ধুর আশ্রয় প্রশ্রয়ে গড়ে তোলা হয়। বিএলএফ আগে থেকেই সাধারণ মানুষকে পলিটিক্যাল মোটিভেশনের জন্য কাজ করত। তবে বিএলএফ নিয়ে সে সময় খন্দকার মোশতাক এবং জে. ওসমানীরা অন্যান্য দলের সঙ্গে ব্যবধান তৈরি করেন। ক্যাম্পে বিএলএফ প্রথম ট্রেনিং শুরু করে।

 

গেরিলা ট্রেনিং ছিল সেটি। এরপর বিএলএফের কর্মীরাই আবার ভাগ হয়ে বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদেরও ট্রেনিং দিত। এ সময় বিএলএফকে ভারতীয় মিলিটারিরা যুদ্ধোত্তর সময়ের জন্য লিডারশিপ ট্রেনিংসহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়। শুধু বিএলএফই নয়, এ সময় একটি দল থেকে ট্রেনিং নিতে শুরু করে। বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পে এসে ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে চলে যায়। তবে সে সময় আমরা দেখেছি বাংলাদেশের প্রতিটি সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছে খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসা দিয়ে। এর জন্য সাধারণ মানুষরা রাজাকার, আলবদর ও পাকিস্তানি মিলিটারিদের হাতে নির্যাতনের শিকারও হয়েছে। আমি বলব, মুক্তিযুদ্ধ সফল হতো না, যদি সে সময় সাধারণ মানুষ এগিয়ে না আসত। বাঙালির অজেয় নেতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই মিলে যুদ্ধ করেছে দেশকে স্বাধীন করার জন্য। সাধারণ মানুষের সেই ত্যাগের ইতিহাস আজ সবার মনে রাখা উচিত। এখানে আরেকটি কথা হলো সে সময়ের ভারত সরকার তথা গান্ধী পরিবার মুক্তিযুদ্ধে যে সহায়তা করেছে তা বাঙালি চিরদিন মনে রাখবে।

 

লেখক : রাজনীতিক

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ডিসেম্বর ২০১৫/শাহনেওয়াজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়