ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

চৈত্রের এক তপ্ত দুপুরের গল্প || দিলওয়ার হাসান

দিলওয়ার হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪০, ৩০ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চৈত্রের এক তপ্ত দুপুরের গল্প || দিলওয়ার হাসান

দিলওয়ার হাসান

কখনো  বিষণ্নতা এসে মনের মধ্যে উঁকি দিলে গুরু লেখকের কটা লাইন ঘুরে ফিরে মনে আসে : ‘বিরাট বিশ্ব। কাল অনন্ত। তার মাঝে মানুষ দেখি। দেখি গাছপালা, নদী, মেঘ, পাহাড় আলো। দেখতে-দেখতে কোনো ব্যাপারকে মনে হয় বুঝি গত জন্মের। কী এক অজানা ইশারা আমাকে সব মনে করিয়ে দিতে পারছে না।...

পুরনো আসবাবের খাঁজে ধুলো ঝাড়তে গিয়ে সোনার গুঁড়ো পাই, পাই রুপোর গুঁড়ো, রূপের গুঁড়ো। মানুষের যে কত রূপ। কী বিস্ময়কর এই মানুষ। অবিরাম অনুসন্ধানেও ফুরোবার নয়।

 

বিগত এই কটা বছর ঢাকার শহরে বিরাজ করতে গিয়ে কত না মানুষ দেখি, কত না মানুষ চিনি। কত মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক হয়, আবার ভেঙ্গেও যায়। জীবিকার তাগিদে এক চাকরি থেকে আরেক চাকরিতে যাই। ফ্রিলান্স জর্নালিজম থেকে আম্বেসির অনুবাদক, এনজিওর প্রতিনিধি কত কী-ই না করেছি আর মানুষ চিনেছি ঘাটে-ঘাটে। ঠাঁই নাড়া হতে-হতে এখন মোটামুটি একটা ভাল চাকরি নিয়ে থিতু হয়ে বসেছি। মা আর ভাই-বোনদের থেকে থাকি অনেক দূরে। বাবা নেই, সে-বাবদ কাঁধে বিরাট দায়িত্ব। বছরে দু-একবার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে দেখা হয় বাড়ি গেলে।

 

আমাদের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ফার্ম। লক্ষ-লক্ষ টাকার মালামাল আসছে, হাজার-হাজার টাকার মালামাল যাচ্ছে। এই আসা-যাওয়ার মধ্যেই আমাদের কাজ। নানান পদে লোকজন কাজ করে যাচ্ছে। এই কাজের মানুষদের একজন মলি আপা মিসেস ম মলিনা লতিফ। আমাদের এইচ, আর প্রধান। সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত। এই ব্যস্তাতার মধ্যেই আলাপ হয়, কথা হয়। আমার চেয়ে বড় দশেকের বড় তো হবেনই।  ছিপছিপে গড়ন, দীর্ঘাঙ্গী। কোকড়া চুল। টকটকে ফর্সা। এসব থাকলে যে কাওকে সুন্দরী বলা যায়- তিনিও। এ-অফসে ঢোকার পর আমার সঙ্গে হৃদত্যা হয়েছে, বেড়েছে ঘনিষ্ঠতা। দারুণ রান্না করেন। তার বাসা থেকে আনা খাবারে মাঝে মধ্যেই ভাগ বসাই এক্সক্লুসিভ কিছু থাকলে- এই যেমন আনারস দিয়ে খাসির মাংস, চিংড়ির মালাইকারি, ইলশের পাতুড়ি এসব আরকি। একবার একটা শরতব এনেছিলেন, উড়িষ্যা না কোথাকার রেসিপি, গ্লাস তিনেক খেয়েও আশ মেটেনি।

 

মলি আপার বাসাতেও গিয়েছি। ওনার স্বামী গোলগাল মোটাসোটা একজন মানুষ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, মস্তো গোঁফ। চোখে আন্তন চেখভের মতো গোল রিমের চশমা। আমার সঙ্গে গড়ে উঠেছে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। শিল্প বিষয়ে তার সঙ্গে প্রায়ই আলাপ হয়। একটা পত্রিকার শিল্প-উপদেষ্টা। হাসি-খুশি মানুষ। ছবিটাও ভাল আঁকেন। তার করা ছবি আমি দেখেছি- বেশির ভালই অয়েল পোইন্টিং। আঁরি দ্যা তুলোস লত্রেকের ভক্ত। তারপরেই পছন্দ পিকাসো। ফ্রাঁসেয়া জিলোর সঙ্গে পিকাসোর মেমোরাসিটা আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন। ২২ বছর বয়সের সময় শিল্পী ফ্রাঁসোয়ার সঙ্গে পিকাসোর পরিচয় ও বিয়ে। ১৯৪৩ থেকে ১৯৫৩ অবধি পিকানোর স্ত্রী ছিলেন। তারপর বিবাহ বিচ্ছেদ। ছিল  আরেক শিল্পী লুক সিমোনকে বিয়ে করেছিলেন পরে।

কাজে কর্মে মলি আপা খুব ভাল। ইকনোমিক্স-এ মাস্টার্স করেছেন ঢাকা ভার্সিটি থেকে। কোনো কিছুতে ঠেকলে তার পরমর্শ নেই। গার্জিয়ানের মতো হয়ে গেছেন। আমাকে নাকি বিয়ে করাবেন। আমার মোটেও আপত্তি নেই তাতে। মাকে জানিয়েছি সে কথা। মা বলেছে, ‘বেশ তো একজন বড়বোন পেয়েছিস। তোর নিজের বড় বোন নেই,...।’

 

তার মতো মানুষ-ই হয় না এ-যুগে। তার এক ছেলে মেয়ে। কোয়েল আর মায়া। দুটোই ফুটফুটে। উইল্স লিটন ক্লাওয়ার্স স্কুলে পড়ে। আমাকে মামা ডাকে। খুব আদর করি তাদের। অফিসের পিকনিক টিকনিকে সারাক্ষণ আমার সঙ্গে থাকে। অফিসে আমার আরও নারী-কলিগ আছে। তাদের সঙ্গে আমার হাই-হ্যালোর বেশি বলে ডাকে। আমার দুজনেই জানি সেকথা- হেসে উড়িয়ে দেই।

একবার মালয়েশিয়া গেলেন বেড়াতে। আমার জন্যে চমৎকার কয়েকটা টাই, আফটার শেভ নিয়ে এলেন, সঙ্গে একটা বই-সিঙ্গারের সর্ট ক্লাইভে অ্যান্ড আদার স্টোরিজ। সেটা থেকে ক’টা গল্প অনুবাদ করে ছাপতে দিলে খুব খুশি হয়েছিলেন। রেসিপ্রোকেট করবার জন্যে সে-ঈদে তাকে একটা জামদানি শাড়ি উপহার দিয়েছিলাম।

একদিন বাড়িতে খেতে ডাকলেন। বললেন, ‘আমার এক্সটা অর্ডিনারি রান্নাগুলোই তো তোমাকে খাওয়ানো হয়নি।’

সাগ্রহে বললাম, ‘যেমন?’

‘এই ধর তোমার চিতল মাছের কোপ্তা, নারকেল দিয়ে মুরগির মাংস, ছুরি মাছের জুনটকি, শর্ষে বাটা ইলিশ, কুচো চিংড়ির বড়া...।’

 

সে-দিন শুক্রবার ছিল। মাটি-ফাটা রোদ উঠেছিল চৈত্র শেষের ওই দিনটাতে। জুমার নামাজ পড়ে মগবাজারের আস্তানা থেকে বেরুতে-বেরুতে প্রায় দুটো। একটা জিন্সের প্যান্ট আর সূতির টি সার্ট পরলাম। বাতাস নেই। রাস্তায় বেরুতেই আগুনের হলকা এসে গায়ে লাগল। রিকশা-বিরল রাস্তা, অথচ গন্তব্য বেশ একটু দূরে-আজিমপুর। এক জোয়ান রিকশাওয়ালাকে পাওয়া গেল শেষমেষ। ফুকফুক বিড়ি টানছিল। তা দেখে একটা সিগ্রেট ধরিয়ে হুড তুলে দিলাম। একটু এগুতেই লেভেল ক্রসিং-এ আটকা পড়লাম। একটা লোকাল হেলে-দুলে পার হয়ে গেল।

 

পৌঁছুতে-পৌঁছুতে আড়াইটার ওপরে বেজে গেল। মলি আপা নির্ঘাৎ রাগ করবেন, একটু আগে ভাগে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু শুক্রবার সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে পারা যায় না। সকালে বাজার করে সবকিছু ফ্রিজবন্দি করতে হয়। অতঃপর শুক্রবাসরীয় সাহিত্য পাতায় চোখ বুলানো। একটা-দুটো লেখা পছন্দ হলে পড়ে ফেলা। ইদানিং সাহিত্যপাতাগুলোর দিকে তাকান যায় না। সাকুল্লে দু’ পাতা বরাদ্দ, তার ভেতরেও ঠাসা বিজ্ঞাপন, মেকাপের ছিরিছাদ নেই। আগে গোটা ছয়েক নিতাম, এখন কমিয়ে তিনটে করেছি। সে তুলনায় অনলাইনওয়ালাদের সাহিত্য পাতা অনেক ভাল হয়।

 

আজিমপুর গোরস্থান ডানে রেখে রাস্তার উল্টো দিকের একটা গলিতে মলি আপার বাসা। তিন তলা বাড়ির দোতলা। ছিমছাম তিনটে কামরা, একটা ড্রইং-কাম ডাইনিং। সামনে টানা বারান্দা। ফ্ল্যাট বাড়ির যুগে এ-বাড়িটা মন্দ না- ফ্ল্যাটের মতো চাপাচাপি নেই। বাড়ির সামনে বেশ কটা বড় দোকান। একটা আইসক্রিম কেক কিনে মলি আপার বাসার দিকে হাঁটা দিলাম। রাস্তার লোকজন নেই একেবারে। হুহু বাতাসের সাথে গাছের পাতা ঝরে যাচ্ছে। ধুলো উড়ছে।

দোতলায় ওঠার মুখে মলি আপার গলার আওয়াজ পেলাম। কাকে যেন কুৎসিত ভাষায় গালাগাল করছেন। অবাক হয়ে নিজেকে আড়াল করলাম। সিঁড়ির ওপরে তিনি, নিচে দশবার বছরের একটা ছেলে। পরনে মলিন একটা প্যান্ট আর গেঞ্জি। ধুলোয় ভরা খালি পা। বুকটা আমার ছ্যাৎ করে উঠল। কারও খালি পা দেখলে খুব খারাপ লাগে আমার। মনে হয় সে খুব অভাগা। চৈত্রের এই পিচগলা রোদে খালি পায়ে সে আছে কী করে?

 

মলি আপা চিৎকার করে ওঠেন, ‘এই হারামজাদা, কুত্তার বাচ্চা, আজ মাসের কত তারিখ ভিক্ষে নিতে এসেছিস?’ ছেলেটা বলল, ‘ভিক্ষে? ভিক্ষে কেন নেব, আমার বাবা মাসে-মাসে এই টাকা দেন। মায়ের খুব অসুখ করেছিল। ওষুধ টষুধ কিনতে অনেক টাকা খরচ হলো বলে মার হাতে টাকা নেই, তাই আপনার কাছে পাঠালেন।’

‘অ্যাই বাস্টাটার্ড, আবার মুখে-মুখে কথা বলছিস? আমি কি এখানে দানছত্র খুলে বসেছি! টাকা কি গাছের গোটা, ঝাঁকি দিলেই পড়বে?’

‘বাবাকে একটু ডেকে দেন, তার কাছে চাইব।’

‘আমাকে ডিঙ্গিয়ে বাবাকে বলবি? আয় দেখাচ্ছি মজা। চাবকে তোর পিঠের ছাল তুলে ফেলব। তোর বাবার কাছে টাকা থাকে নাকি। সব টাকা আমার। যা ভাগ এখান থেকে। পাঁচ তারিখের পর এসে নিয়ে যাস তোদের মাসিক বরাদ্দের ভিক্ষে। বেজম্মাটা দিল আমার দিনটা মাটি করে। বাসায় একজন মেহমান আসবে আজ।’

 

একথা বলে বেশ কিছু বেফাঁস গালি দিলেন মলি আপা। কোনো মহিলার মুখ থেকে আজ অবধি এ-রকম বাজে কথা শুনিনি। মনটা যার পর নাই খারাপ হয়ে গেল।

ছেলেটা মাথা নিচু করে বেরিয়ে এল। দরাম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন আপা। এক অন্য রকমের মলিনা লতিফ। ঘামছিলাম আমি। চোখের সামনে পৃথিবীটা থর থর করে কাঁপছিল। ছেলেটা গেটের বাইরে এলে তার কাছে এগিয়ে গেলাম। বললাম, ‘এই মহিলা তোমার কে হন?’

‘আমার বাবার স্ত্রী।’

‘বাবার স্ত্রী মানে তো মা, তাই না?’

‘জি, উনি আমার সৎ মা। আমার মাকে ছেড়ে এই মহিলাকে বিয়ে করেছেন বাবা, কিন্তু আপনি?’

‘তোমার সৎ মায়ের কলিগ। আজ আমার নিমন্ত্রণ ছিল ও-বাড়িতে; কিন্তু যাব না। চল ওদিকটায়। তোমার সঙ্গে একটু কথা বলি।’ আইসক্রিমের দোকানে গিয়ে বললাম, ‘আপনার ওই ছেলেটাকে একটু দেবেন? আইসক্রিমটা লতিফ ইয়ার সাহেবের বাসায় দিয়ে আসুক, না হলে গলে যাবে। এই দশটা টাকা রাখুন ছেলেটার জন্যে।’

‘টাকা লাগবে না। আইসক্রিমের প্যাকেট লতিফ সাহেবের বাসায় পৌঁছে দেব। কিছু কি বলতে হবে?’

‘বলবেন ঝিলু সাহেব পাঠিয়েছেন। একটা জরুরি কাজে আটকে পড়ায় আসতে পারেননি বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।’

 

 অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

 

ছেলেটাকে নিয়ে মেইন রোডে এলাম। বাটা সু স্টোর থেকে এক জোড়া স্যান্ডেল কিনে দিলাম। লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। বলল, ‘আমার একজোড়া ছিল স্পঞ্জের। দুটো ফিতেই ছিড়ে যাওয়ায় আজই ফেলে দিয়েছি, আপনি কেন আমাকে স্যান্ডেল...’

‘মনে করো না, তোমার বাবা আমার বন্ধুর মতো, যদিও তিনি বয়সে আমার চেয়ে অনেক বড়। তাতে কী’। খিদেয় আমার পেট চো-চো করছিল। ছেলেটিও নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত। এ এলাকায় আমাদের একটা প্রিয় রেস্তোরাঁ আছে- ক্যাফে ডি আজিমপুর। আমি ও আমার ভবঘুরে বন্ধু মঈন সিদ্দিকী প্রায়ই নীলক্ষেতের ফুটপাতে পুরনো বইট-ই দেখে ওখানে যাই। দুপুরে গেলে মোগলাই খাবার আর রাতে নানা রকমের ভত্তার সঙ্গে সাদা ভাত। মাঝে মধ্যে নাশতাও করি মুরগির লটপটি কিংবা গরুর নেহার দিয়ে মচমচে পরোটা। মনে আছে এ-রেস্তোরাঁতে বসেই আমরা তালাত মাহমুদের বিখ্যাত গান ‘যায়ে তো যায়ে কাঁহা অনুবাদ করেছিলাম-যেতে হয় তো কোথায় যাব। ফুটপাতে সদ্য পাওয়া মীনা কুমারীর শায়েরী নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। মীনা কুমারী ভারতীয় চলচ্চিত্রে এক অদ্বিতীয় নাম। উপমহাদেশের তিন দেশে আসংখ্য গুণগ্রাহী এই নামজাদা নায়িকার। প্রচণ্ড খ্যাতি আর জনপ্রিয়তা। খ্যাতি আর জনপ্রিয়তার আড়ালে লুকিয়ে ছিল গভীর দুঃখ আর হতাশা, যার অভিযাতে তার কলম থেকে বেরিয়েছিল অজস্র শের আর নজম।

 

তারই একটা আমরা উচ্চস্বরে পাঠ করেছিলাম নিরতিশয় আবেগের বশে :

মহকতে, রঙ ভরে

হো গায়ে দিন রাত মেরে,

মেরে মুহসিন, তেরী খুশবু

তেরী চাইতে কে তুফয়াল

 

সদ্য পাওয়া বইয়ে কমলেশ সেন এর অনুবাদ করেছেন :

সুগন্ধ আর রঙ

আমার দিন আমার রাতকে

ভরিয়ে তুলেছে,

হে আমার মনের মানুষ,

তোমার খুশবু

সে তো তোমাকেই,

তোমাকেই পাওয়ার জন্যে।

 

মঈন খুব ভাল উর্দু জানে। ভবঘুরেমির কারণে চর্চা করতে পারেনি।

রেস্তোরাঁয় বসিয়ে ছেলেটাকে বললাম, ‘কী খাবে?!’ লজ্জায় মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হয় না। শেষে বলল ‘আপনি যা খাওয়াবেন তা-ই।’ খাসির কাচ্চি, বোরহানি আর দইয়ের অর্ডার দিলাম। শুক্রবার বলে রেস্তোরাঁয় ভিড় নেই, তাছাড়া তিনটের ওপরে বাজে।

ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করি, ‘কোথায় থাক?’

‘ষোলঘর, বিক্রমপুরে। এখন থেকে বেশি দূরে নয়, যেতে ঘণ্টা দেড়েক লাগে।’

‘চিনি আমি। যাওয়ার পথে একবার গিয়েছিলাম ও গাঁয়ে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে। নাম মোজাম্মেল। শাহবাগে বইয়ের দোকান আছে।’

‘ও আচ্ছা। আমি চিনিনে।’

‘তোমার ক’ভাই-বোন? তোমার মা কি কিছু করেন?’

 

‘আমরা দু’বোন এক ভাই। আমি বড়। অবশ্য কোয়েল আর মায়াকে ধরলে আমরা পাঁচ ভাই-বোন। মা একটা স্কুলে পড়াতেন। রোজ চার চার আট মাইল হাঁটতে হয় বলে ছেড়ে দিয়েছেন। এখন ঘরে বসে লোকজনের কাপড় চোপড় সেলাই করেন আর মুরগি পোষেন।

‘ঢাকায় থাকতে পারলে মা কোনো চাকরি করতে পারতেন। তার গ্রাজুয়েশন আছে। এখানে তো আমাদের কেউ নেই।’

‘বাবার সঙ্গে দেখা হয় না?’

‘না, মাঝেমধ্যে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। তখন কেন জানি না খুব কাঁদেন। তার অফিসে গিয়ে দেখা করা যায়, কিন্তু ইচ্ছে করে না। তিনি যে কেন ওই মহিলাকে বিয়ে করলেন ভেবে পাইনে।’

 

আমি তখন বলি, ‘মলি কি সব সময় তোমার সঙ্গে এমন দুর্ব্যবহার করেন?’

‘মাঝে মধ্যে করেন।’

‘বাবাকে বলতে পার না।’

‘লাভ নেই। বাবা কিছুই করতে পারবেন না। মানসিক বরাদ্দের টাকাটা নিজ হাতেই দিলে পারেন অফিসে। কিন্তু না, তিনি বোধ করি তাকে খুব ভয় পান। খুব রাগী মানুষ তো, তাই  বোধ হয়। টাকাটা নিতে আমাদের খুব খারাপ লাগে, কিন্তু কী করব বলুন আমাদের তো তেমন কিছু নেই।’

লজ্জা ভেঙে ক্রমেই মুখর হয়ে ওঠে ছেলেটা। বলে, ‘আমার জন্যে আপনার দাওয়াত মাটি হলো। নিশ্চয়ই তিনি আপনার জন্যে অনেক কিছুর আয়োজন করেছিলেন।’‘বাদ দাও তো। তোমাকে ওই অবস্থায় দেখে দাওয়াত খাওয়া সম্ভব হতো না আমার পক্ষে। ও রকম একজন মানুষ কেমন করে এমন আচরণ করতে পারেন। আসলে হয়েছে কী জানো? আমরা সবাই অনেকগুলো মুখোশ ব্যবহার করি। যখন যেটা প্রয়োজন পরে নেই, প্রয়োজন শেষ হলে খুলে ফেলি আবার অন্যটা পরি। তুমি ছেলেমানুষ, সব কথা তোমাকে বোঝাতে পারব না। তুমি কি আর কিছু খাবে? সংকোচ করো না।’

‘না না। এত কিছু  খেয়ে পেট একদম ভরে গেছে।’

 

পকেটে হাজার দু’য়েক টাকা ছিল। ছেলেটার হাতে দিয়ে বললাম, ‘রাখ। তোমাদের কাজে লাগবে। তোমার বাবার বন্ধু হিসেবে এতটুকু উপহার দেবার অধিকার হয়ত আমার  আছে। তা-ও যদি না ভাব, তাহলে একজন মানুষ বলে গণ্য করতে পার আমাকে। মানুষের জন্যে কিছু করবার অধিকার মানুষের থাকে।’

ছেলেটা বিহ্বল হয়ে পড়ে। টাকা হাতে মৌন দাঁড়িয়ে থাকে। আমি ওর মাথায় হাত রাখি। গুলিস্তান অবধি যাওয়ার জন্যে একটা রিকশা ঠিক করে ওকে তুলে দেই।

মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে কখন থেকে। এত কিছুর পর মলি আপার মুখের দিকে কী করে তাকাব? মুখোশ খুলে ফেলার সাধ্য তো আমার নেই!

ঢাকা শহরটা তখন প্রচণ্ড তাপে দগ্ধ হচ্ছিল। ঘরে ফিরতে মন চাইছিল না। মঈন সিদ্দিকীকে কল করলাম মোবাইল ফোনে। ওপার থেকে বার-বারই বলছিল- এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, কিছুক্ষণ পর আবার ডায়াল করুন। কিছুক্ষণ পরে আবার ডায়াল করার পরও সেই একই কথা ভেসে এল। কী যন্ত্রণা বলুন দেখি?

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ জুন ২০১৬/এএন/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়