ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শাহ্‌নাজ মুন্নীর গল্প || ছেরাদ্ধ

শাহ্‌নাজ মুন্নী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২১, ১৯ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শাহ্‌নাজ মুন্নীর গল্প || ছেরাদ্ধ

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

জীবনের প্রথম মোগরাপাড়া রেজিস্ট্রি অফিসে এসে একটু ঘাবড়ে যায় চারুবালা দাসী। টিনের চালার নিচে কাঠের চৌকির উপর ছোট ছোট ক্যাশ বাক্স সাজিয়ে সারি দিয়ে বসে আছেন দলিল লেখকবৃন্দ, সামনের দালানের নিচ তলায় সাব-রেজিস্ট্রারের এজলাশ। লোকজন কেমন ব্যস্ত হয়ে আসছে আর যাচ্ছে। কেউ কেউ এখানে সেখানে অলস জটলা করছে, ঠোঁট গোল করে খুব মনোযোগ দিয়ে বিড়ি টানছে কেউ। চারুবালা তার সাদা ধুতির আঁচল টানতে টানতে চোখ পিটপিট করে সঙ্গে আসা মেজো মেয়ে অঞ্জনাকে নিচু গলায় ডাক দেয়, ‘ও অঞ্জু, দীলিপে কই?’
‘দাদায় তো আছে, সামনে, ক্যান? কি হইছে? ... কিয়ের লাগি?’

চারুবালা আর কিছু বলে না, দীলিপকে এত ব্যাকুল হয়ে হঠাৎ কেন যে সে খুঁজছে তাও আর মনে পড়ে না তাঁর। দীলিপকে সামনে পেলে চারুবালা কি এখন বলবে, ‘ও দীলিপ জমিটা বেচিছ না, ল’, বাড়িত যাইগা’ নাকি জিজ্ঞেস করবে, ‘জমি বেচার টেকা দিয়া কি করবি, বাপ?’
দুইটার যাই জিজ্ঞেস করুক না কেন দীলিপ যে তাতে মহা ক্ষেপে যাবে সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই চারুবালার। সে অঞ্জুর পেছনে পেছনে গিয়ে রেজেস্ট্রি অফিসের চেয়ে সামান্য দূরে একটা আমগাছতলায় বসে। এখানে লোকজনের আনাগোনা কম, বেশ ছায়া আছে, একটু বাতাসও বইছে, চারুবালার আরাম লাগে আর আরামে তার একটু ঝিমুনি আসে। ঝিমুনির মধ্যেই কি সুন্দর লাঠি ঠুকঠুক করে সাদা ময়লা ধুতি পরা রেবতী দাস সামনে এসে হাজির।

‘বাবা, আপনের এইখানে কি কাম?’
চারুবালা জিজ্ঞাসে। রেবতী দাস বিড়বিড় করে।
‘জমি বেচতে আইছস? মেয়া লোকের আবার জমি থাকেনি?’
‘কেন বাবা, আপনেই না আমার নামে জমিটা লেইখ্যা দিছিলেন, মনে নাই? আপনেই তো কইছিলেন, ও চারু তুই তো নিয়মমতো কোনো সম্পত্তি পাবি না, এই জন্য তোরে আলাদা কইরা এই জমিটা দিলাম।’
রেবতী দাস তখন খুব ক্ষেপে যায়। বলে,‘দিলাম যখন তখন রাখ। বেচতে আইছস কেন? মাটি বেচা কি ভালানি?’
‘আমি না তো, দীলিপে ...’ চারুবালা ছোট্ট মেয়েটির মতো ঘ্যানঘ্যান করে ‘আমি না দীলিপে ...’
আর কি আশ্চর্য চারুবালা তখন ধীরে ধীরে সাত বছরের শিশু হয়ে যায় আর রেবতী দাস তাকে কাঁধে নিয়ে খালের পার দিয়ে হাঁটতে থাকে ... আর সাত বছরের চারু বার বার বলতে থাকে, ‘বাবা মিঠাই খামু ... ও বাবা গুলাগুলা পিঠা খামু ... বাবা ... ও বাবা মিঠাই কিন্যা দেও ... বাবা ...’

অঞ্জু তখন ঘুমে ঢলে পড়ে অস্পষ্ট বিড়বিড় করতে থাকা চারুবালাকে মৃদু ধাক্কা দেয়,
‘ও মা, ঘুমাছ’নি? ... মা?
চারুবালা তখন জাগে। এখানে কেন, কোথায় বসে আছে তা আর কিছুতেই মনে পড়ে না তার। অঞ্জুকে জিজ্ঞেস করতেও ভয় লাগে। চারুবালা একটু বিহ্বল দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকায়। একবার ঘাড় বাঁকিয়ে উপরের দিকেও তাকায়। আমগাছের পাতার আড়ালে কোনো কাক বসে আছে কি-না দেখে নিয়ে চারুবালার মনে পড়ে যে, সে মোগড়াপাড়া রেজিস্ট্রি অফিসে এসেছে দীলিপের সাথে জমি বেচতে। ওই যে মুসলমান বউটা সেও বোধহয় এসেছে জমি বেচতেই, কালো একটা বোরখা পড়ে বউটা ওর স্বামী নাকি ভাই, কার পাঞ্জাবির কোণা ধরে হাপুস নয়নে কেমন কেঁদেই যাচ্ছে দেখো, মুখে চোখে বোরকার রুমালটা চাপা দিয়েও কান্নার বেগ থামাতে পারছে না সে। সঙ্গে থাকা পুরুষটার আসহায় মুখের একপাশটা দেখা যাচ্ছে, চাপা গলায় সে বোরকাকে ধমকাচ্ছে, ‘কান্দিছ না, ওই ... মাইনষে দেখতাছে ...’
বউটা তখন আরো আকুল হয়ে কাঁদতে থাকলে পুরুষটার গলায় সান্ত্বনার সুর বাজে।
‘আরে জমি গেলে কি? ... মানুষ তো আছে, মানুষ বাঁচলে এমন জমি আরো হইবো।’
আহারে, মাটির জন্য কি মায়া দেখো! মাটিই খাঁটি বন্ধু মানুষের গো! মাটিই খাঁটি ঠিকানা!

চারুবালা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আচ্ছা, বউটা কি তবে ভিটা বাড়ি বেচতে আসছে? শেষ সম্বল খানা? অসুস্থ স্বামী কিংবা ছেলের চিকিৎসার জন্য? ... কে জানে, মুসলমান বউটার সাথে একটু আলাপ করার ইচ্ছা জাগে চারুবালার, ইচ্ছা জাগে ওর বিত্তান্তটা শুনে, বুঝ দেওয়ায় জন্য একটা দুইটা সান্ত্বনার কথা বলে, চারুবালা তার দুর্বল শরীরটা সামান্য নাড়িয়ে বউটার দিকে একটু আগানোর উদ্যোগও নেয় কিন্তু অঞ্জু চোখ মটকে বড় বড় করে তাকায়।
‘কই যাছ্?’
চারুবালা মেয়েকে ভয় পায়, সে অপরাধীর মতো মুখ করে বলে, ‘বউটা কেমুন কানতাছে ... দেহোছ না ...’
অঞ্জু মাকে মুখ ঝামটা দেয়, ‘কান্দে কান্দুক, যার যার দুঃখু তার তার ... তুই তোর দুঃখের কথা চিন্তা কর, আজাইরা প্যাঁচাল পাড়তে যাওনের কাম কি?’

মেয়ে বড় হলে সে হয়ে যায় মা, মায়ের মতোই ধমকায়, শাসন করে, অঞ্জু আইএ  পাস করেছে, ফ্যামিলি প্ল্যানিং অফিসে চাকরি করে। উপযুক্ত বয়সে বিয়েও হয়ে গেছে। দেখাশোনা, পড়ালেখা সব দিক দিয়েই বড় হয়ে গেছে সে। চারুবালা তাই মা হয়ে ওঠা মেয়ের মুখের ওপর আর কোনো কথা বলে না, বসে বসে উসখুস করে, এদিকে সেদিক তাকায়। ক্রন্দসী বউটা চলে গেছে, এখন আরো দুটো মুসলমান বউ এসে ছায়ার জন্য আমগাছ তলায় বসেছে। অঞ্জু মার একটু কাছে ঘেষে আসে, নিচু গলায় প্রশ্ন করে,
‘জমি বেচা টেকা দিয়া দাদায় কি করব? ... কইছে?’
‘...হ-অ’ মনে কয় কইছিলো ...’ চারুবালা মেয়ের প্রশ্নের উত্তরে স্মৃতি হাতড়ায়। জমি বেচা টাকা দিয়ে দীলিপ কিছু একটা করবে বলেছিল, কিন্তু ঠিক কি বলেছিল, তা আর মনে পড়ে না তার। অঞ্জু এবার আরেকটু কাছে ঘেঁষে আসে, ‘কি? কইছিলো?’
‘... কইছিলো বলে ছেরাদ্ধ করতে মেলা টেকা লাগে ...’ চারুবালা অনেক কষ্টে মনে করতে পারে যে দীলিপ একদিন বলেছিল তার শ্রাদ্ধে অনেক টাকা খরচ হবে। মায়ের এই উত্তরে হতাশ হয়ে মুখ ঝামটা দেয় অঞ্জু। ‘জমি বেইচ্যা তোর পোলায় ছেরাদ্দ করব? জমি বেইচ্যা? ... কতো টেকা লাগে ছেরাদ্দ করতে, এ্যাঁ?’

অঞ্জুর গলাটা সম্ভবত একটু চড়েই গিয়েছিল, মুসলমান মহিলা দুটো সেই চড়া শব্দে সচকিত হয়ে ওদের দিকে তাকায়, কম বয়সী সুন্দর মতো একজন কৌটা খুলে পান মুখে দেয়, তারপর আলাপ জমানোর জন্য জিজ্ঞেস করে, ‘জমি রেস্ট্রি করতে আইছেন?’
চারুবালা মাথা ঝাঁকায়। বউটি তার লাল ঠোঁট দুটো ফাঁক করে তখন আবার জিজ্ঞাসে, ‘ও বেচতে?’ চারুবালা উত্তর দেয়ার আগেই বউটি জিভের আগায় সামান্য একটু চুন লাগিয়ে আপন  মনেই বলে, ‘আমরা আইছি জমি রেস্ট্রি করতে ... আমি হইলাম উনার দ্বিতীয় পক্ষ, আগের জন মারা গেছেন ... বয়স বেশি, আমার বাপ-ভাইরা উনার কাছে বিয়া দিতে চায় নাই ... উনি বিয়ার আগেই ওয়াদা করছিলেন, জমি লেইখ্যা দিবেন ... ধানী জমি, দুই বিঘা ... জোতদার তো ... অনেক জমি .... অহন উনার আগের পক্ষের পোলারা এইটাতে আবার বাগড়া দিতাছে ... তারা কয় বলে জমি লেইখ্যা দেয়ার দরকার কি? বাপ মরলে কি উনারে আমরা সাগরে ফালায়া দিবো? তা উনি আবার এক কথার মানুষ। বলে যে, আমার পোলাদের আমি চিনি, অগো বিশ্বাস নাই। আমি মরলে তোমারে চুলের মুঠি ধুইরা বাইর কইরা দিবো ...’
‘আপনেদের নিয়ম তো তবু ভালো, বাপের সম্পত্তি পান, স্বামীর সম্পত্তি পান ...’ মহিলার পানের পিক ফেলার অবসরে অঞ্জু চট করে বলে ফেলে।
‘হ, নামেই পাই,  কামে পাই না।’
দ্বিতীয় পক্ষের সঙ্গে আসা প্রৌঢ়া মহিলাটি তখন বিক্ষুব্ধ কন্ঠে বলে।

‘উনি আমার ফুফু’ দ্বিতীয় পক্ষ পানের পিক ফেলা শেষ করে পরিচয় দেয়। ‘ফুফুই তো কোনো সম্পদ পায় নাই, দাদায় মরণের পরে আমার বাপ চাচারা কইছে বলে, জানু, তুই জমি জিরাত নিয়া কি করবি? আমরা ভায়েরা আছি, তর দেখশোন করুম-ই, জমি নিলে তো সম্পদই নিবি। ভাইগো, ভাই-বউ গো সমাদর আর পাইতি না, সেই কারণে উনি আর জমি  সম্পদ নেয় নাই।’
ফুফু ওরফে জানু তার ভাতিজীর মুখের কথা টেনে নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশে তৎপর হয়, ‘হের পর কি ভাইরা আমার দেখ্শোন্ করছে? ক’? করছে? আমার মা-ও তো ভাইগো কাছ থেইক্যা কিছু পায় নাই ...’
‘কি আর করবা ফুফু? কপাল...’ দ্বিতীয় পক্ষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে।  
তবে ফুফ হয়তো শুধু কপালের দোষ বলে ব্যাপারটা হালকা ভাবে দেখতে রাজি হতো না, যদি কি-না দ্বিতীয় পক্ষের প্রায় বৃদ্ধ জোতদার স্বামী এসে তাড়াহুড়া করে তাদের ফুফু ভাতিজীকে ডেকে নিয়ে না যেত। ওরা চলে গেলে অঞ্জু আবার তার পুরানা প্যাঁচাল শুরু করে।

‘জমি বেচনের টেকা দিয়া দাদা কি করব? ... কম তো না ... চাইর লাখ টেকা ... চাইর লাখ টেকা খরচ কইরা তোর ছেরাদ্ধ করবো? ... পাগল হইছস্ তুই? আইচ্ছা, এই জমির উপরে আমগো অধিকার নাই? খালি তোর পোলাগো অধিকার? ... মা-র সম্পদ কি মাইয়ারা পায় না? ... মাইয়া গো কোনো দাবি নাই? ক? ...
চারুবালা মেয়ের উপর্যুপরি প্রশ্নের আঘাতে রীতিমতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সে দুর্বল কণ্ঠে পাল্টা প্রশ্নে মেয়েকে সমর্থন জানায়, ‘... দাবি থাকবো না কেন? ... অধিকার থাকবো না কেন? ... দীলিপরে যে পেটে ধরছি, হেই পেটে তোগোরে ধরি নাই? ...
‘অখন তো বুড়ি, সুন্দর মতোই কথা ক’ছ, পোলাগো সামনে বোবা হইয়া থাকোস কেন ভগবান জানে’ অঞ্জু নিজের রাগ চেপে রাখে না।
‘বোবা থাকি কই, আমি জিগাইছি না, ও দীলিপ ছেরাদ্ধে কত টেকা খরচ করবি? ... দীলিপ কইছে এক  লাখ টেকা তো বলে লাগবই...’
‘বাকি টেকা? বাকি টেকা কি দাদায় একলা খাইব? ... একলা খাইয়া হজম করতে পারব মনে করছে? তোর পোলার জিহ্বা অত বড় কেন? সব একলা খাইতে চায়...’
অঞ্জু তার মায়ের সাথে সমানে তর্ক করেই যায়, দীলিপ যে একটি কুটিল, স্বার্থপর, কঞ্জুস, লোভী আর বোনবিদ্বেষী ভাই তা প্রমাণ না করা পর্যন্ত তার যেনো শান্তি নাই। চারুবালাকেও তখন উপায়ান্তর না দেখে মেয়ের কথায় সায় দিতেই হয়। নিজের মৃত বাবার উপরেও রাগ হয় অঞ্জুর।
‘ঠাকুরদা হেই কবে ব্রিটিশ আমলে তোরে জমি লেইখ্যা দিয়া গেল আর আমগো বাবা মাইয়ার লাইগ্যা এক টুকরা জমি রাখলো না? মাইয়ার ভবিষ্যত ভাবল না?’

চারুবালা ছোট্ট মেয়েদের মতো তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, ‘আহহারে, আমার বাপ আর তোর বাপ? হেহ্! কার লগে কি? আমার বাবায় কইতো মাইয়া আমার ঘরের লক্ষ্মী। আমার লক্ষ্মীরে সম্পদ থেইক্যা বঞ্চিত করুম কেন? .. করলে অধর্ম হইবো না? .. বাবায় তো হেই আমলে স্কুলে মাস্টারী করত, আর চলতো নিজের বিচারে, নিজের বুদ্ধিতে...’
বহুদিন আগে মরে যাওয়া বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গলা বুজে আসে চারুবালার, চোখে পানি এসে যায়, সে চোখ মুছে আরো কিছু বলতে যাওয়ার আগেই দেখে কখন যেন দীলিপ এসে তাদের পাশে বসেছে। মাকে চোখ মুছতে দেখে দীলিপ বিরক্ত কণ্ঠে ধমকায়,
‘কান্দোছ কেন? জমি লইয়া কি চিতায় উঠবি? ক?’
কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে না। অঞ্জু তখন একটু ইতস্তত করে বলে, ‘দাদা, জমি কি শেখে-গো কাছে বেচতাছো?’

দীলিপ হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর মতো একটা অবজ্ঞার ভঙ্গি করে।
‘তোরা তো খুঁজ-খবর রাখোছ না? উপরে দিয়া আইয়া টেকা দাবি করোছ... কত ঝামেলার মধ্যে যে আমি জমি বেচতাছি... শেখরা তো দুই লাখ টেকার উপরে দাম তুলে না ... মনে করছে, ওগো কাছে জমি না বেইচ্যা কই যামু? হেষে মহাদেব এক গাহক আনছে, হেয় জমি দেইখ্যা দাম ধরছে চাইর লাখ টেকা ... এর মধ্যে শেখের পোলারা আইয়া আমারে কত হুমকি ধামকি দিতাছে যে বলে জমি বেচবার পারবা না ... জানে শেষ কইরা দিমু, আমাগো কাছে বেচো ... অহন কয় যে বলে চাইর না পাঁচ লাখ টেকা দিমু, তবু জমি আমাগো কাছে বেচো...’
‘আ ভগবান ... কি কও এই ডি?’ অঞ্জু এবার বিস্ময় প্রকাশ করে।
‘হ, শুন্ না, কতো কিরতী ... হেরা জীবনে আমারে টেকা দিবো? তোর বিশ্বাস হয়? ...’

দীলিপ একটু থেমে বলে, ‘.. হেরপরে তারা কয়, আমারে বলে কিডন্যাপ করব, জমি রেস্ট্রি করতে দিব না, আবার মহাদেবের গাহকরেও গিয়া সমানে হুমকি দেয়, কয়, এই জমি কিনতে পারবেন না, আমরা কিনুম ... ঠাকুর জানে কত বিপদের মইধ্যে দিয়া আমি যাইতাছি..’
দিলীপ নিজের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অঞ্জু মনে মনে দাঁত কিড়মিড়ায়।
‘হুহ্ চাইর লাখ টেকা খাইবা, আর বিপদের মইধ্যে পড়বা না, এইটা কি হয় নাকি...’
মুখে বলে, ‘ইশ্ মগের মুল্লুক পাইছে, না? আগে কইলা না কেন? তোমাগো জামাইয়ের এক বন্ধু র্যা বে চাকরি করে, কইলে দিত ছেঁচা...’
দীলিপ আপন মনেই বলে, ‘আমাগো কথা কেডা শুনে? ... খালি কইলেই অইবো? জমি লইয়া যায় টেকা দেয় না, সম্পদ দখল করে বিচার পাই না, ঘরের বউ-মাইয়া পর্যন্ত ছাড়ে না ... ওগো লগে ফাইট দিয়া আমরা পারুম’নি?
দুই ভাইবোন এরপর আর কথা খুঁজে পায় না। তাদের বিভিন্ন ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। এই নীরবতার সুযোগে চারুবালা পুরনো কথাটা পারে। সে তার ভাঙা ভাঙা গলায় একটু ভয়ে ভয়ে বলে, ‘জমি বেচার টেকা দিয়া কি করবি`রে দীলিপ?’
‘তোর ছেরাদ্ধ করুম, কইছি না?’

দীলিপ রাগী রাগী গলায় একথা বলে উঠে দাঁড়ায়। চারুবালা ক্ষীণ কণ্ঠে প্রশ্ন করে, ‘আইচ্ছা ... বইনগো`রে কিছু দিবি না ...?
দীলিপ এই প্রশ্নটা যেন শুনতেই পায়নি এমন ভাব করে সামনে পা বাড়ায়। বলে, ‘যাই দেখিগা, সাব-রেজিস্ট্রার আইল নাকি... মা, দলিলে তোর সই লাগব ... লোক পাঠাইলে আইয়া পড়িস।
অঞ্জু আবার জ্বলে উঠে।
‘দেখছো’ছ্নি, ভাবটা? দেখছস? ... টেকার কথা কইলে তোর পোলা কানে কিছু শোনে না ... ঠাকুর ... ঠাকুর কি কলিকাল আইল গো ... এত অবিচার সহ্য করবা ঠাকুর...’

সংলাপের শেষ ভাগে অঞ্জু ভাইয়ের স্বার্থপরতা ও অবিবেচনার কথা মনে করে রাগে দুঃখে কান্নার প্রস্তুতি নিতে থাকে। গলার কাছটা ভারী হয়ে চোখে এক ঝলক অশ্রুও এসে পড়ে প্রায় আর সে চোখ কুঁচকে সেই অশ্রু জল গালের ওপর ফেলার প্রয়াস চালায় তখনই হঠাৎ করে চারুবালার ঠোঁট মুখ গলা কেমন শুকিয়ে যায়, খাঁ খাঁ মরুভূমি যেন, সে শুকনো জিভ দিয়ে আরো শুকনো ঠোঁট ভেজানোর চেষ্টা করতে করতে বলে,‘ও অঞ্জু একটু জল খামু’।
মায়ের কাতর কণ্ঠ শুনে চোখের জল ফেলার প্রকল্প বাদ দিয়ে অঞ্জু উঠে দাঁড়ায় এবং এদিক ওদিক তাকিয়ে জলের জন্য সম্ভবত টিউবওয়েলের খোঁজ করে।
চারুবালা তখন আবার বলে, ‘জল খামু’।
‘মরণ! এইখানে জল পামু কই?’ অঞ্জু এবার খনিকটা বিরক্ত। বুড়িদের নিয়ে এই বিপদ, শিশুদের মতো, সময়-গময় বুঝে না। চোখের দৃষ্টিসীমায় টিউবওয়েল না দেখতে পেয়ে অঞ্জু আর চারুবালার পিপাসাকে খুব একটা পাত্তা দেয় না। তখন দীলিপ একজন লোক পাঠায়, সে তাদেরকে এজলাশে নিয়ে যেতে এসেছে, অঞ্জু এসে চারুবালাকে ধরে, ‘উঠ্, দাদায় এজলাশে যাইতে কইছে ... তোর সই দেওন লাগব’

চারুবালা মেয়ের হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আরেকবার বলে, ‘জল খামু’।
‘খাইও, খাইও, সইটা দিয়া হের পর ইচ্ছামতো জল-খাবারই খাইও ... অহন লও ... লও ...’
বার্তাবাহক এমন তাড়া দিলে অঞ্জু চারুবালার হাত ধরে তাকে প্রায় টেনে-হিঁচড়ে সামনে আগায়।
‘আপনের জমি?’
চারুবালা মাথা ঝাঁকায়।
‘দাগ নম্বর, খতিয়ান নম্বর, ঠিক আছে? নাম জারি আছে?
সাব-রেজিস্ট্রার দলিলপত্র উল্টায় আর জিজ্ঞেস করে। চারুবালা এসবের কিছুই বোঝে না। সে হক্চকিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য তেষ্টার অনুভূতিটা ভুলে যায়। দীলিপ উত্তর দেয়, ‘ঠিক আছে স্যার,’ সঙ্গে দলিল লেখকও বলে, ‘স্যার কাগজপত্র ঠিক আছে, হিন্দু-তো, ওয়ারিশের ঝামেলা নাই।’

সাব-রেজিস্ট্রার খস্ খস্ করে দলিলে সই দেয়। একজন এসে চারুবালাকে ডেকে কাছে নিয়ে যায়। বলে, ‘নাম দস্তখত করতে পারেন?’
শিক্ষকের কন্যা, নাম দস্তখত পারবে না, লোকটা বলে কি? চারুবালা তার হাত থেকে কলম নিয়ে অনেকক্ষণ লাগিয়ে নিজের নাম দস্তখত করে। রেবতী দাস কোত্থেকে এসে কে জানে চারুবালার পাশে বসে শিখিয়ে দিতে থাকেন, ‘চ-য়ে আকার, র-য়ে রস্সুকার, ব-য়ে আকার, লয়ে আকার, এই বার দাসী ... না, না, দন্ত-স্যয় দীর্ঘিকার দে’
‘দিদির লেখা তো দেখি সুন্দর ওই-’
দলিল লিখক বলে। আর স্বাক্ষর দেওয়া শেষ হলে চারুবালা দাসীর জমি বিক্রি হয়ে যায়, বদলে যায় জমির মালিকানা, ১০০ টাকার স্ট্যাম্পে লেখা হয়- ‘জিলা নারায়ণগঞ্জ, থানা সোনারগাঁ সাফ কবলা তাং ... পরম সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণে ২০ শতাংশ কৃষি জমি বিক্রয়ের সাফ কবলা দলিলের আইনানুগ বয়ান আরম্ভ করিলাম। যেহেতু নিম্ন তফসিল বর্ণিত সম্পত্তিতে দলিল দাত্রী শ্রীমতি চারুবালা দাসী...’

চারুবালার তখন আবার তেষ্টা পাওয়ার অনুভূতিটা ফিরে আসে, সে ক্ষীণকণ্ঠে বলে,
‘ও দীলিপ জল খামু’
দীলিপ সেই ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শোনে কি শোনে না, সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আরো কি কি কাগজপত্র সামাল দিতে, হিসাব নিকাশ মিটাতে। জমি কেনা-বেচার ভেজাল কি কম? অঞ্জু তখন চারুবালাকে আবার আমগাছ তলার দিকে টেনে নিয়ে আসে। চারুবালা ঘোলা চোখ মুখে মিনমিন্ করে,‘জল না খাইলে মইরা যামু’
‘মর! তুই অহন মর, তোর জমি নাই, তোর বাইচ্যা থাইক্যা কাম কি? তুই মর, মা, তুই মর, তোর পোলা না তোর ছেরাদ্ধ করার লাইগ্যা টেকা রাখছে ...’
কথাটা অঞ্জু বলছে নাকি দীলিপ নাকি রেবতী দাস বলছে চারুবালা বুঝতে পারে না, সে শুকনো ঠোঁট ফাঁক করে আরেকবার বোধহয় বলতে চায় ‘জল খামু ...’






রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ অক্টোবর ২০১৫/তারা


রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়