ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

জিংহোং ও মিস্টার ভেসপা || শাকুর মজিদ

শাকুর মজিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩২, ২৮ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জিংহোং ও মিস্টার ভেসপা || শাকুর মজিদ

জিংহোংতে তিনদিন প্রায় একা, এক-দুইজন ইংরেজি জানা গাইড কাম মেহমানদারের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে আমি যখন প্রায় ক্লান্ত, এ সময় শহরের ব্যস্ত এক খোলা চত্বরে দেখা হয়ে যায় এক ইউরোপীয় পর্যটকের সঙ্গে। এবং পরিচয়ের কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা পরস্পর আবিষ্কারও করে ফেলি যে এই তল্লাটে অ-চীনা মানুষ আমরা এই দুইজনই।

 

আলাপ শুরুর আগে তিনি যে আমার ক্যামেরায় বন্দি হচ্ছেন, এমনটা তিনি লক্ষ্যও করেন। কিন্তু কোনো বাধা বা আপত্তি না জানিয়ে তিনি তার ভেসপাটি যখন পার্ক করতে যাবেন, আমি তাকে পুনরায় অনুরোধ করি আরেকবার এই পথে মোটর সাইকেলটি চালিয়ে আসতে।

হাসেন মোটর সাইকেল আরোহী। বলেন- রি শুট? সেকেন্ড টেক? ওকে নো প্রবলেম!

আরেকবার টেক দিতে তৈরি হয়ে আসেন তিনি এবং দক্ষ অভিনেতার মতো ডানে বামে একটু তাকিয়ে নিবিষ্ট মনে ভেসপাটি পার্ক করে এসে হ্যান্ডশেক করেন আমার সঙ্গে।

আমি প্রথমেই নাম বলি, এখানে আসার কারণ বলি।

জবাবে তার নাম জিজ্ঞাসা করার আগেই বলে বসেন- আমি বেতেনালি, তবে আমাকে ‘মিস্টার ভেসপা’ নামেই ডাকতে পারো। এই নামেই আমি স্বাচ্ছন্দবোধ করি।

 

 শুটিংয়ে মগ্ন লেখক

 

আলাপ জমে হুকার টেবিলে। আপাতত; আমি ভিউ ফাইন্ডার দিয়ে তাকে দেখি, আর আমার কানে লাগানো যন্ত্র দিয়ে তাকে শুনি।

জজ বেতেনালি ইতালিয়ান নাগরিক। ঘর ছেড়েছেন গেলো শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝি, প্রায় চল্লিশ বছর আগে। তখন তার বয়েস মাত্র ১৭ বছর। এক প্যাকেট সিগারেট আর ট্যাংকি ভরা পেট্রোল নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন মোটর সাইকেলে করে দুনিয়া দেখবেন বলে। এখন তার বয়স ৫৭, আর তার ঘরে ফেরা হয়নি। মাঝে মাঝে দু’একবার ফিরে গেছেন আত্মীয়দের কাছে কিন্তু খুব কম সময়ের জন্য। বেতেনালি এ পর্যন্ত ১৩৫টি দেশ ঘুরেছেন এবং তার প্রায় সবই এই ভেসপা মোটর বাইকে। গত ২৫ বছর বেতেনালি ইতালিতে ফেরেননি। একটানা ঘুরেই বেড়াচ্ছেন। ইতালির ভাষা, ইতালির মন নিজের মধ্যে ধারণ করে তিনি বিশ্বময় ঘুরে বেড়ান। ইতালিতে তার নিজের কোনো ঘর নাই, প্রয়োজনও মনে করেন না। তার সঙ্গী একটা ইতালিয়ান ভেসপা মোটর বাইক। এটা নিয়েই চষে বেড়াচ্ছেন দুনিয়া। এর মধ্যে গিয়েছেন আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ঘুরে এখন এসেছেন শিশুয়াং পান্নার এই রাজধানী শহর জিংহোং।

 

বেতেনালি চীনে আছেন প্রায় সাড়ে তিন বছর। এই সাড়ে তিন বছরে চীনের অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। কিন্তু জিংহোং তার মনে ধরে যায়। এখানে একটি বাড়িও কিনেছেন নদীর ধারে। বেতেনালি বলেন, প্রথমেই যে কাজটা করি, তা হলো, যেখানেই যাই সে দেশের ভাষাটা আগে রপ্ত করে ফেলি। যতক্ষণ নতুন জায়গার ভাষা বোঝা না যায় আর মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা না যায়, ততোক্ষণ ঐ জায়গার ঘ্রাণ নাকে লাগানো যায় না। এখানে অনেক সময় লেগেছে ভাষাটা শিখতে। তাও শিখে ফেলেছি। এখন আমি অনেক স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াতে পারি।

 

মজার কথা বললো মিস্টার ভেসপা। পৃথিবীর বহু দেশে গিয়েছি, এই মফস্বলটির মতো দেশ পাইনি। চিন্তা করছি, এখানে একটা বিয়ে করে ফেলবো। আমার একটা বেবি দরকার এবং তা হতে হবে এই শিশুয়াং পান্নার দাই রমণীর গর্ভ থেকে। আমি ধান্ধায় আছি, যদি পটাতে পারি, কাউকে বিয়েই করে ফেলবো। আমার বাচ্চা হবে অর্ধেক চীনা, অর্ধেক ইতালিয়।

ডেবরা আর স্বর্ণা দুজন খুব মনোযোগ দিয়ে কথা বলছে। তার সুবিধা এই যে, এই দুজনের সঙ্গে তিনি ইংরেজি ও চৈনিক দুই ভাষাতেই কথা বলতে পারছেন। কিন্তু আমাকে সংযুক্ত রাখার জন্য তার ভাষাটি রাখছেন ইংরেজি।

আমার সঙ্গে ১০ মিনিটের মাথায় তার খাতির হয়ে যায়। কারণ তিনি তিনবার বাংলাদেশেও এসেছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ার উপর তার আলোকচিত্রের বই আছে, সেখানে বাংলাদেশ নিয়ে একটা চ্যাপ্টার আছে। শেষবার এসেছেন ১৯৮৬ সালে। তার ভেসপা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন ঢাকা, সোনারগাঁও আর বরিশাল। বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের মানুষের প্রসংশায় তিনি পঞ্চমুখ।

 

 জিংহোং নদী শহরকে দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছে

 

বাংলাদেশ আর শিশুয়াং পান্নার মানুষ এবং তাদের পোষাক আশাক আর খাবার দাবারের মধ্যেও মিল খুঁজে পান এই পরিব্রাজক। আমাদের দাওয়াত করে বসেন তার বাড়ি যাওয়ার জন্য। বলেন, সেখানে গেলে তার ফটোগ্রাফির বই দেখাবেন। এ যাবৎ তার দশটা বই প্রকাশিত হয়েছে। এই বইগুলো তিনি লেখেন ইতালিয়ান ভাষায়। নয়টি ভাষাতে কথা বলতে পারলেও লিখতে পারেন শুধু ইতালিয়ান ভাষাতেই। ইংরেজিতেও পারেন, কিন্তু লিখতে চান না। তার ভ্রমণ খরচের একটা অংশ চলে আসে এসব থেকে। অনেকগুলো ট্রাভেল ম্যাগাজিনে তিনি নিয়মিত লেখেন। ভেসপা কোম্পানি তাকে স্পন্সর করে। সেখান থেকেও কিছু পান। ইদানিং ন্যাশনাল জিওগ্রাফির সঙ্গেও কাজ শুরু করেছেন। এ অঞ্চলের আদিবাসীদের জীবনাচার আর তাদের সংস্কৃতি তিনি এখন ভিডিও ক্যামেরায় শুট করেন। এর বাইরে আফ্রিকার উপর ৪০০ পৃষ্ঠার একটা বই লিখছেন এখন।

এখন অবশ্য একটি ছোট্ট হ্যান্ডিক্যাম নিয়ে চীনের বিভিন্ন উপজাতীদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড রেকর্ড করছেন। ডিসকোভারি চ্যানেলের সাথে তার যোগাযোগ হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই ডিসকোভারির জন্য তার কাজ শুরু করার কথা।

 

খানায় পিনায় আর আড্ডায় আমাদের সময় অতিক্রান্ত হয়ে যায়। পরদিন সকালে আমরা বেরিয়ে পড়ি সেই পরিব্রাজকের বাড়ির খোঁজে।

শিশুয়াং পান্না চৈনিক শব্দ। এর মানে ‘বারো হাজার ধান ক্ষেত’। এক সময় হয়তো এমনটিই ছিলো এই অঞ্চলের অবস্থা। এখন অবশ্য সময় পাল্টেছে। দক্ষিণ সীমান্তে মিয়ানমার আর লাওসের সীমানার কাছাকাছি এই অঞ্চলটি বিখ্যাত অন্য কারণে। চীনের ৫৬টি নৃ-গোষ্ঠির ১২টিরই বাস এখানে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির আদিবাসীরা এই অঞ্চলে বসবাস করছেন তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে।

 

অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হলেও হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্যের চিহ্নসমূহ এখন শুধু তাদের একার নয়, পর্যটকদেরও দেখার বিষয়। এই বিষয়টি নিজের চোখে দেখার জন্য ইয়ুন নান প্রদেশের রাজধানী শহর খুন মিং থেকে উত্তর পূর্ব কোনাকুনি ৬০০ কিলোমিটার দূরের শহর শিশুয়াং পান্নায় আমরা এসে পড়ি। 

শিশুয়াং পান্না, একটা ছোট্ট শহরতলী। প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই অঞ্চলে প্রায় ১০ লাখ লোকের বাস। কম ঘনত্বের শহর বলেই হয়তো অনেক কম যানবাহনের চলাচল। পরিচ্ছন্ন এই শহরটাকে প্রথম দেখাতেই কেমন যেন খুব আপন বলে মনে হয়।

খুব ভোরেই রাস্তার পাশের খাবার হোটেলগুলোতে চীনাদের ভিড়। ফুটপাথের উপর বেঞ্চ বা টুল বসিয়ে দেয়া হয়েছে। সকালের নাস্তা খাবার জন্য এ রকম আয়োজনই পছন্দ স্থানীয় বাসিন্দাদের। ফুটপাথ হোটেলের খদ্দেরদের দেখে মনে হলো তারা কেউই নিজের ঘরে সকালের নাস্তা বানান না। পরিবারের লোকজন সবাই মিলে এক সাথে নাস্তা খেয়ে যে যার কাজে বেরিয়ে যান। নাস্তার মেনু হিসেবে নুডুলস স্যুপটাই তাদের বেশি প্রিয়। নুডুলস এর সাথে মাংসও মেশানো থাকে। এর সাথে যে পানীয় অংশটুকু থাকে তা দিয়েই মিটে যায় পানির তৃষ্ণা। সকালের ঘরোয়া নাস্তা হিসেবে এই নাস্তাটাই তাদের প্রিয়।

 

দাই নৃ-গোষ্ঠির জনগণ অধ্যুষিত এই এলাকাকে এক সময় বলা হতো বন্যপশুর রাজত্ব। হাতি ছিলো এই অঞ্চলের প্রধান পশু। শিকার, যুদ্ধ বিগ্রহ এবং মালামাল পরিবহনে এই হাতির ব্যবহার ছিলো সবচেয়ে বেশি। দাই জনগোষ্ঠি যেহেতু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই পশুটি তাদের কাছে পরম শ্রদ্ধার বিষয়ও। সে কারণেই হয়তো রাস্তাঘাটে, বড় সড়কের মোড়ে, বিভিন্ন আকারের হাতির মূর্তি এই শহরে দেখা যায়।

হাতিগুলো এই এলাকার মানুষের জীবনাচারণের সাথে মিলেমিশে একাকার। কখনো এইসব হাতি এসেছে জীবনে সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে। জীবনে-মরণে-হাতি শিশুয়াং পান্নাবাসীর একটা বড় অংশ দখল করে আছে। তারই বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল তাদের এই সব উপস্থাপনার মাধ্যমে।

 

 বেতেনালি তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন

 

ইতালিয়ান পরিব্রাজকের বাড়িটি খুঁজে পেতে আমাদের বেগ পেতে হয় না। স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিলো। তার বাড়ির সামনেই দাঁড় করিয়ে রাখা ভেসপাটি। যে ভেসপা অতিক্রম করেছে ১৩৫টি দেশ। সুন্দর একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি। একজনের থাকার জন্য বাড়ি হিসেবে এটা বেশ বড়ই। ডোর বেল বাজতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন বেতেনালি। ঘরে ঢুকতেই যেদিকেই চোখ যায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্যুভেনির। আর বড়বড় সেলফগুলো বিভিন্ন ভাষার বই’তে ঠাসা। দেয়ালজুড়ে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের আলোকচিত্র।

 

পৃথিবীব্যাপী ইতালিয়ান ভেসপা মোটরবাইকের সুনাম আছে। কিন্তু এখন এই ভেসপা মোটরবাইককেই প্রতিযোগীতায় নামতে হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বাইকের সাথে। বিশেষ করে চীন, ইন্ডিয়া আর ভিয়েতনামের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোটরবাইকের সাথে। যেহেতু মোটরবাইকের গ্রাহকরা হন বিভিন্ন দেশের নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ এবং এই শ্রেণীর মানুষগুলো সাধারণত তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য আর তাদের সংস্কৃতির প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল। সে কারণেই এই মানুষগুলোর মানসিক চিন্তা চেতনার সাথে সম্পৃক্ত থাকতে হবে পণ্যটিকে। পণ্যটিকে তাদের চিন্তা চেতনা, তাদের আবহাওয়া আর ভূমিরূপের সাথে সম্পৃক্ত করতে দরকার বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জ্ঞান। সে কারণেই হয়তো ইতালির ভেসপা কোম্পানি বেতেনালির স্পন্সর হতে এগিয়ে এসেছে। তার এইসব ছবি, বই, আর প্রান্তীক জনগোষ্ঠির যাপিত জীবনের খণ্ড চিত্রগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়তো স্পন্সর কোম্পানি তাদের পরবর্তী পদক্ষেপগুলোতে কাজে লাগাবে।

 

বেতেনালির সাথে খানায় পিনায় গল্পে গানে আমদের আড্ডাটা বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। দিনের সূর্যটা নরম রোদ ছড়াতে শুরু করেছে। এই নরম রোদে আমরা চলে আসি বেতেনালির বাড়ির ছাদে। এখান থেকে হাত বাড়ানো দূরত্বে মেকং বা নানচিং নদী শুয়ে আছে শরীর ছড়িয়ে। তার ওপারে সবুজ পাহাড়গুলো বিকেলে নরম রোদ গায়ে মেখে আকাশে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। বাহ! চমৎকার।

 

উপর থেকে জিংহোং’র এই বনেদি এলাকার বাড়িগুলোর দিকে তাকালে একটি কমন বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। বাড়িগুলোর নকশা, রং এবং উচ্চতা সব এক। শহর কর্তৃপক্ষই হয়তো এই উচ্চতা, রং এবং নকশার রূপরেখাটা বেঁধে দিয়েছেন। কিন্তু যেগুলো বাণিজ্যিক ভবন, হোটেল, রেষ্টুরেন্ট এবং সরকারি অফিস বিল্ডিং সেগুলোর স্থাপত্য নকশা এবং রং আলাদা। কোনটি আবাসিক ভবন আর কোনটি অনাবাসিক বাণিজ্যিক ভবন সেটি যাতে বাইরে থেকে রং দেখেই বোঝা যায় সে কারণেই হয়তো নগর কর্তৃপক্ষ এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। অথবা শহর যাতে অবয়ব বৃদ্ধির সাথে সাথে তার শ্রী হারিয়ে না ফেলে সে কারণেও হয়তো এমন স্থাপত্য নকশা হতে পারে।

 

 শিশুয়াং পান্নার দাই রমণীদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য

 

এখানে প্রতিটি দালান কোঠার স্থাপত্য-নকশা এসেছে দাই সম্প্রদায়ের আদি ঘর বাড়ির আদল থেকে। বাড়ির ছাদ বা চিলে কোঠার নকশায় এসেছে তাদের ঐতিহ্যিক চৌ-চালা ঘরের ঢালু ছাদ। লম্বালম্বি একটি চৌ-চালা ছাদের ভিতর দিয়ে আড়াআড়িভাবে ঢুকে গেছে আরেকটি চৌ-চালা ছাদ। আড়াআড়ি ছাদের মাথায় সমদূরত্ব অনুসরণ করে আরো কয়েকটি চৌ-চালা ঘরের মটকা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘরের ছাদের কার্নিশে বা ত্রিকোণ জায়গাগুলোতে রিলিফ কাজের নকশা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে তাদের বিশ্বাসের প্রতিক কতগুলো প্রাণী। সেখানে ময়ূর, হাতি আর ড্রাগনের উপস্থিতি আবশ্যক।

 

জিংহোং শহরের রাস্তার সড়কদ্বীপ বা বিভিন্ন বড় বড় ভবনের সামনে অনেকগুলো ভাস্কর্য। বেশিরভাগ কাঠের, কিছু সিমেন্টের। কোথাও নৌকা, কোথাও হাতি, কোথাও ময়ূর। সবগুলোতেই যেন পাহাড় ছেড়ে আসা যাপিত জীবনের ত্রিমাতৃক রূপ।

চীনা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সামনে দেখি হাতি দুটির ওপর কলার কাদি, উৎপাদিত ফসল, আর আদিবাসী মানুষ। পাহাড়ে উৎপাদিত এইসব ফসল বয়ে নিয়ে উপরে ওঠা বা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বয়ে নিয়ে যাওয়া ছিলো খুবই কষ্টসাধ্য। সেসময় তারা বুনো হাতিকে পোষ মানিয়ে তাদের জীবনযাপন অনেক সহজ করে তুলেছিলো। পাহাড় ছেড়ে এলেও তারা তাদের সেই উপকারী বন্ধুদের কথা ভুলতে পারে না। সে কারণেই এইসব উপকারী বন্ধু এখন অবধারিত হয়ে ওঠে তাদের ভাস্কর্যে। তাদের বসবাসের দালান কোঠার সৌন্দর্যের নকশার কাজে।

 

পাহাড় তারা যেমন ভুলতে পারে না, তেমনি পাহাড়ের শরীর বেয়ে বয়ে যাওয়া মেকং নদীকেও তারা ভুলতে পারে না। সে কারণেই জিংহোং শহরের এই সড়কদ্বীপে এ রকম একটি নৌকা বাইচের ভাস্কর্য জায়গা করে নিয়েছে। আদীকাল থেকেই নদী এবং নদীপথ তাদের জীবনের সাথে লতার মতো জড়িয়ে আছে। আর নদীপথে তাদের প্রধান বাহন ছিলো নৌকা। এই নদীপথ এবং নৌযানগুলো কখনও তাদের জীবনের বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে এসেছে। আর সেটা এসেছে নৌকাবাইচ প্রতিযোগীতার মাধ্যমে। সে কারণেই নৌকাবাইচ প্রতিযোগীতার এ রকম একটি ত্রিমাতৃক রূপ এই সড়কদ্বীপে। আর নৌকার কাঠামোটা এসেছে তাদের বিশ্বাসের প্রতীক ড্রাগন থেকে। তারা মনে করে ড্রাগন সৌভাগ্য আর সৌর্যবীর্যের প্রতীক। এই ড্রাগন তাদের সমস্ত বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবে।

 

নৌকা বাইচ প্রতিযোগীতায় সহযোদ্ধা মাঝিমাল্লাদের উৎসাহিত করার জন্য তারা বিভিন্ন ধরনের গান পরিবেশন করতো। সাথে থাকতো তাদের ঐতিহ্যিক বাদ্যযন্ত্রের বাজনা। এ সবই এসেছে এই ভাস্কর্যে ত্রিমাতৃক রূপ নিয়ে।

আমাদের চারজনের দল নিয়ে এসে পড়ি মেকং নদীর ধারে। শিশুয়াং পান্নার রাজধানী শহর জিংহোং দু’ভাগে ভাগ করে মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে এই নদী। একে ভিয়েতনামে ডেকে এসেছি ‘মেকং’ হিসেবে। এখানে এর নাম ‘ল্যাংচং’। চীনের উত্তর অঞ্চলের ট্যাংগুলাশান পাহাড়ে জন্ম নিয়ে পৃথিবীর ছয়টি দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভিয়েতনামে গিয়ে সাগরে মিশেছে এই নদী। সে কারণে এটি একটি আন্তর্জাতিক নদীও।

 

 ভিয়েতনামের ‘ মেকং’  নদী এখানে এসে নামধারণ করেছে ‘ল্যাংচং’

 

আর ইয়ুন-নান প্রদেশের আটটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল Nujiang, Lijiang, Dali, Baoshan, Lincang, Simao, and Xishuangbanna উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এই নদী। দীর্ঘ এই যাত্রা পথে মেকংকে পাড়ি দিতে হয় প্রায় ৪,৮৮০ কিলোমিটার পথ। এই দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে তাকে গায়ে মাখতে হয়েছে বিভিন্ন ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির রং। আর আজ এর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠছে শিশুয়াং পান্নার রাজধানী শহর জিংহোং। যেহেতু মেকং-এর দু’তীরেই শহরটি সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সে কারণেই নদীর উপরে এই সেতুটি আবশ্যকীয় হয়ে ওঠে। এই সেতুটিই শিশুয়াং পান্নার  ল্যান্ডমার্ক স্থাপনা। ডেবরা বলে, এই ব্রিজ দিয়েই কিন্তু পৃথিবীতে শিশুয়াং পান্নার পরিচিতি। এটি শিশুয়াং পান্নার প্রবেশ এবং বাহির দ্বারও। মেকং-এর উপরে প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুটি যে কোনো পর্যটককেই আকর্ষণ করবে। জিংহোং শহরের যেখানেই অবস্থান করা হোক না কেন সেখান থেকেই এই সেতু দেখা যাবে।

 

ধীরে ধীরে সূর্য নেমে আসে। অন্ধকার হয়ে গেলে এই নদীর পাড়ে বেশি কিছু দেখার থাকবে না। আজ সন্ধ্যায় আমার নতুন সঙ্গী হয়েছে মিস্টার ভেসপা। আমি আরো তিনদিন আছি এই শহরে। আমরা ঠিক করে ফেলি, বাকি দিনগুলোতে আর কী কী দেখবো। বেতেনালিকে বলি, এখানকার প্রধান ট্যুরিস্ট স্পট আমার দেখা হয়ে গেছে। অন্য কিছু দেখতে চাই।

 

বেতেনালি বলে- ট্যুরিস্ট স্পট হচ্ছে সাধারণ পর্যটকের জন্য। সেগুলো দেখার বয়স আমি পার করে এসেছি। এখন অনেক ঘনিষ্ঠভাবে মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে তাদের বুঝতে হবে। কাল থেকে আমার ভেসপা থাকবে তোমার জন্যও। আমি তোমার হোটেল থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাবো। দেখি না, আর কী আছে এখানে!

 

 ছবি : লেখক

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুন ২০১৬/এএন/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়