ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

তাহেরপুরে দেশের প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপূজা ।। মেহেদী হাসান

মেহেদী হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৯ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তাহেরপুরে দেশের প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপূজা ।। মেহেদী হাসান

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী জেলা রাজশাহী প্রাচীন ইতিহাসের অসংখ্য নিদর্শনে সমৃদ্ধ। বৃটিশ আমলে এই জেলা সৃষ্টি হলেও এর প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। নানা স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রত্নপীঠের কথা এবং বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত শিলালিপি, তাম্রলিপি, পট্রোলি, মুদ্রা, ভাস্কর্য, মৃৎপাত্র এবং বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ তার প্রমাণ করে।

রাজশাহী জেলায় লোকায়ত শিল্পের অন্তর্ভুক্ত জমিদার বাড়ি বা রাজবাড়ি ছিলো মোট ১৭টি। এ জেলার জমিদারিসমূহের মধ্যে তাহেরপুর রাজবংশ সবচেয়ে প্রাচীন। রাজশাহী জেলায় এর আগে কোনো রাজবাড়ি হয়ে ওঠেনি। তাহেরপুর  বর্তমান রাজশাহী জেলার বাগমারা থানার অন্তর্গত।  তাহেরপুর বর্তমানে পৌরসভায় উন্নীত হয়েছে।

এখন রাজা নেই, নেই রাজার পাইক-পেয়াদা বা সৈন্য সামন্ত। তবুও প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনাগুলো আজো রাজার আড়ম্বরপূর্ণ রাজত্বের সাক্ষী দিচ্ছে। বর্তমানে স্থাপনাগুলোর অনেক সম্পদ চুরি হয়ে গেছে আবার ধ্বংসপ্রাপ্তও হয়েছে। বিশেষ করে তাহেরপুরে যতগুলো মন্দির ছিল তার কয়েকটি ছাড়া বাকিগুলোর সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত। পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তাহির খানকে উৎখাত করে জনৈক বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ কামদেবভট্ট জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে বংশানুক্রমিক ধারায় জমিদারি চলতে থাকে।

১৬৩৯ সালের দিকে তৎকালীন কামদেবভট্টের বংশের জমিদার সূর্য নারায়ণের সঙ্গে বাংলার সুবাদার শাহ্ সুজার সংঘাত হয়। অনেক হতাহতের পর সম্রাট আওরঙ্গজেব সূর্য নারায়ণের পুত্র লক্ষ্মী নারায়ণের কাছে সমস্ত ঘটনা শুনে তাহেরপুর জমিদারি ফিরিয়ে দেন এবং রাজা উপাধি প্রদান করেন।
সুজার আক্রমণে রামরামা ধ্বংস প্রাপ্ত হলে বাড়–নই নদীর ওপারে সাবরুল গ্রামে নতুন করে জমিদারি স্থাপন করেন।
 


১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর এটি পুনর্নির্মিত হয়। রাজা শশি শেখরেশ্বরের মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ পুত্র শিব শেখরেশ্বর তাহেরপুরের জমিদারি লাভ করেন। ওই অঞ্চলে প্রজা বিদ্রোহ শুরু হলে সরকারের নির্দেশে তিনি জমিদারি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন এবং শশি শেখরেশ্বর দ্বিতীয় পুত্র শান্তি শেখরেশ্বরের ওপর জমিদারির ভার অর্পিত হয়। তিনি প্রজা বিদ্রোহ ঠেকাতে না পেরে ১৯৩০ সালে রাজ কর্মচারীদের ওপর জমিদারি পরিচালনার ভার ছেড়ে দেন এবং এ রাজপরিবার স্থায়ীভাবে দেশত্যাগ করে কলকাতা চলে যায়। ১৯৫০ সালে এ জমিদারির বিলুপ্তি ঘটে। ১৯৫১ সালে রাজকর্মচারীদের সহায়তায় তাহেরপুর রাজপ্রসাদ লুণ্ঠিত হয়।

১৯৬৭ সালে এই রাজবাড়িতে তাহেরপুর কলেজ স্থাপিত হলে প্রসাদটি কলেজ ভবন হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। প্রাসাদের উত্তরের প্রাচীরের পরেই রয়েছে মন্দির প্রাঙ্গণ। এ প্রাচীরের মধ্যস্থলের একটি তোরণ দিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে হতো। অঙ্গনের উত্তর ভিটায় গোবিন্দ মন্দির ও পূর্ব ভিটায় একটি ভগ্ন মন্দির এবং এই মন্দির দুটির বাইরে উত্তর-পূর্ব কোণে শিখর বিশিষ্ট একটি অষ্টকোণাকৃতির শিবমন্দির। এটিকে ‘নবরত্ন’ মন্দিরও বলা হয়। আগে গোবিন্দ মন্দিরের পশ্চিমে একটি দশভুজা মন্দির ছিলো। মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় সেখানে নতুন একটি দূর্গা মন্দির নির্মাণ করেছে।

এই মন্দিরগুলোর পশ্চিমের বেষ্টনি প্রাচীরের মাঝে একটি প্রবেশপথ ছিলো যা এখন বন্ধ। প্রাচীরের ওপারে রয়েছে সরস্বতী মন্দির। সরস্বতী মন্দিরের পরে ছিলো ভুবনেশ্বরী শিবমন্দির। মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায় সেখানে তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজের ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়েছে।

দীর্ঘদিন পরেও ঐতিহ্যবাহী এ মন্দিরগুলোর কদর কমেনি। বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্যই পুরাতন এই দুর্গামন্দিরে তাহেরপুরের হিন্দু সম্প্রদায়ের হারানো জাঁকজমকপূর্ণ দুর্গোৎসব আবার পালিত হচ্ছে। এখানকার রাজারাই যে এ দেশে দুর্গাপুজার প্রচলন করেছিলেন সে সংক্রান্ত একটি প্রস্তর ফলক অষ্টকোণা শিবমন্দিরের পূর্ব দিকে সামান্য দূরে উন্মোচিত রয়েছে।
 


তবে সঠিক পরিকল্পনা ও সরকারি পদক্ষেপ না থাকায় ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে জমিদারি আমলের মন্দিরগুলোর নিদর্শন। বিভিন্ন সময়ে চুরি হয়ে গেছে জমিদার বাড়ি, মন্দির ও মন্দির প্রাঙ্গণের মূল্যবান আসবাবপত্র। তবে বর্তমানে মন্দির প্রাঙ্গণের  সম্পদগুলো স্থানীয় হিন্দুরা ‘ঐতিহাসিক শ্রীশ্রীদুর্গামাতা মন্দির কমিটি’ গঠন  করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে।

এ সম্পর্কে কথা হয় তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ মো. মোবারক আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রাজা কংসনারায়ণের বংশধরদের রাজত্ব ছিলো এটা। পরবর্তী সময়ে রাজারা এখানে ঠিকমতো আসতেন না। বছরান্তে দুর্গাপুজার সময় আসতেন। এ সময়ই সারা বছরের হিসাব নিকাশ করে কর্মচারীদের বেতনাদি পরিশোধ করে উদ্বৃত্ত অর্থ নিয়ে কলকাতায় চলে যেতেন। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর ১৯৬৭ সালে জমিদার বাড়ির মুল প্রাসাদসহ জমিদারির কিছু জায়গা নিয়ে কলেজ স্থাপন করা হয়। এখন শুধু ভালোভাবে টিকে আছে এই মুল প্রাসাদ ভবনটি। তাও আবার দ্বিতীয় তলা ব্যবহার করা যায় না। এগুলো আগেও অবহেলিত হয়ে ছিলো এবং এখনো আছে। সরকার যদি এগুলো সংরক্ষণের জন্য দৃষ্টি দেয় তাহলে এলাকায় পর্যটকদের আগমন হতো।’

সংরক্ষণের কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন মাধ্যমে এসব প্রাচীন নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য অনুদানের জন্য প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিশ্রুতিতেই শেষ হয়ে যায়।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কাজী মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি রাজশাহী অঞ্চলের জমিদার বাড়ি নিয়ে গবেষণা করেছি। তাহিরপুরের জমিদার বাড়ির মন্দিরগুলো এখন আগের মতো নেই। সংরক্ষণ-সংস্কারের অভাবে এগুলো ধ্বংসের পথে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে জানিয়েছিলাম রাজশাহীর পুঠিয়া, তাহিরপুর, নাটোর, রাজশাহী নগরী ও নওগাঁ এই কয়েকটি স্থানের স্থাপত্য নিদর্শন যেন সংরক্ষণ করা হয়। প্রাচীন নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করা গেলে রাজশাহীতে পর্যটক আসবে এবং এ শহরটি পর্যটন শহর হিসেবে গড়ে উঠবে- এটা আশা করা যায়।’






রাইজিংবিডি/রাবি/১৯ অক্টোবর ২০১৫/মেহেদী হাসান/রণজিৎ/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়