ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

নাগিব মাহফুজের গল্প : দুখাই

অনার্য মুর্শিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৯, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নাগিব মাহফুজের গল্প : দুখাই

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

আরবি থেকে রূপান্তর :  অনার্য মুর্শিদ

প্রজারা যখন অতীতের সকল অপকর্ম ক্ষমা করে দিয়েছে সম্রাট শাহরিয়ার তখন তার সিংহাসন ত্যাগ করল। রাতের বেলায় সে আলখেল্লা গায়ে হাতে একটা লাঠি নিয়ে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়ল। তার সামনে এখন তিনটা পথ খোলা। সিন্দাবাদের মত ঘুরে বেড়ানো, নগরের অভিজ্ঞ শায়খ আল বালখির বাড়িতে যাওয়া অথবা সময় নিয়ে সবকিছু একবার ভেবে দেখা।
ভাবতে ভাবতে সে নদীর কিনারে চলে এলো। পরিষ্কার আকাশ, তার নিচে অর্ধাকৃতির চাঁদ। সে চাঁদের নিচে বসে বিলাপ করছে একদল মানুষ। এত রাতে কারা বিলাপ করছে? কৌতূহলী হয়ে সে সন্তর্পণে সামনে এগিয়ে এল।

খেজুর গাছের নিচে গম্বুজাকৃতির একটা পাথর। হঠাৎ তাদের দলনেতা পাথরে ঘুষি মেরে বসল। কিন্তু এরপর তারা পুনরায় বিলাপ শুরু করল। শাহরিয়ারের কৌতূহলী চোখ তাদের চিনতে ভুল করল না। এরা হলো তার রাজ্যের সুলায়মান আল জিনি, খলিল ফারিস ও সামি শুকরি। সারা রাত চলল তাদের কান্নাকাটি। প্রথম আলোর আগমনের আগেই তারা কান্না থামাল। শহরে ফেরার আগে তারা আগামীকাল আসার জন্য পরস্পরের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।

তারা চলে যাবার পর শাহরিয়ার একবার পাথরটার চারদিক দেখল। ঘুরে ঘুরে দেখল। একটা অমসৃণ জায়গা পেল। গত রাতে যেভাবে ঘুষি মারা হয়েছিল সেভাবে সেখানে পরপর কয়েকটা ঘুষি মারল সে। কিন্তু কিছুই হলো না। সে ফিরে আসার সময় পাথরের ভেতর থেকে একটা শব্দ শুনতে পেল! শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে সে দেখল, পাথরের নিচের অংশ খুলে গেছে। সেখান দিয়ে একটি আলোক রশ্মি বের হচ্ছে। সাথে একটা মিষ্টি ঘ্রাণ।  শাহরিয়ার পাথরটার ভেতরে মাথা ঢুকাল। এবং অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, খুব সুন্দর একটা পরিবেশ! সে পুরোপুরি ভেতরে ঢুকে গেল। অমনি দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল! তারপর শুরু হলো তার জীবনের একটা নতুন অধ্যায়।

সে এখন একটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাগানের ফুল দেখছে। মুগ্ধ হচ্ছে। বারান্দার শেষ মাথায় একটা দরজা দেখতে পেল সে। তার মনে হলো  কয়েক মিনিট হাঁটলে সে দরজার কাছে এসে যাবে। কিন্তু অনেক্ষণ হাঁটার পরও সে দরজার কাছে যেতে পারল না। মনে হচ্ছে সে এখনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সারা জীবন হাঁটলেও পথ শেষ হবে না। তবু সে হেঁটে হেঁটে সবকিছু দেখছে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর তার সামনে  একটা বাথটাব পড়ল। যার পাশে একটা পরিষ্কার আয়না। অদৃশ্যলোক থেকে সে শুনতে পেল, ‘শাহরিয়ার, আজ তোমার যা মন চায়, তাই কর।’
সে জামা খুলে বাথটাবে ডুব দিল। পানি থেকে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আবিষ্কার করল সে নতুন রূপে। মসৃণ ত্বক, শক্তিশালী শক্তি এবং কালো চুলের একজন তরুণ সে। মনে মনে ঈশ্বরের প্রশংসা করল শাহরিয়ার। এরপর যখন সে তার শরীরে দামেস্কের রেশমি জামা, খেরেসানের পাগড়ি ও মিশরের জুতো দেখল তখন আরো বেশি অবাক হলো।

নতুন জামা পরে সে পুনরায় দরজার দিকে হাঁটতে লাগল। পথিমধ্যে দেখা হলো এক সুন্দরী তরুণীর সাথে।
- কে তুমি?
- আমি শাহরিয়ার।
অতঃপর তরুণী যখন তাকে দরজার সামনে নিয়ে গেল তখনি দরজাটা খুলে গেল। ভেতর থেকে কিছু বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি শোনা গেল। ফুলের আদলে তৈরি প্রাসাদ দেখে শাহরিয়ারের চোখ ধাঁধিয়ে উঠল। এই প্রাসাদের তুলনায় তার প্রাসাদ জীর্ণ কুটির। মহারানীর মুক্তোখচিত সিংহাসনের সামনে গিয়ে একজন তরুণী বলল, ‘এই আপনার প্রতিশ্রুত নতুন বর!’
মহারানী তাকে দেখে একটু মুচকি হাসল। সে হাসিতে শাহরিয়ারের বুক কেঁপে উঠল। তারপর মাটিতে নুইয়ে মহারানীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলল, মহারানী, আমি আপনার সেবা দাস ছাড়া অন্য কিছু নই।
না, আপনি এই সিংহাসন এবং আমার ভালোবাসার অংশীদার- মহারানী বলল।
- একটা কথা। আমার দীর্ঘ জীবনের অতীত আছে। যা পার করে এখন আমি বুড়িয়ে গেছি।
- বুঝতে পারছি না, আপনি কোন বিষয়ে কথা বলছেন?
- প্রর্থনা করি আমাদের এ বন্ধন অটুট থাকুক।

তারপর চল্লিশ দিন যাবত সানাই বাজল। শহরের সবাই বিয়ের অনুষ্ঠান উপভোগ করল। প্রেম, ভালোবাসা, নাচ, গানের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে শাহরিয়ারের দিন। তার মনে হচ্ছে এ উদ্যানের রহস্য বের করতে হাজার বছর লেগে যাবে।
একদিন রানীর সাথে বাগনে হাঁটছিল সে। পথিমধ্যে স্বর্ণালি একটি দরজার সামনে লেখা দেখতে পেল- ভেতরে প্রবেশ নিষিদ্ধ। রহস্য থেকে উত্তরণের জন্য সে রানীকে প্রশ্ন করল, সতর্কবাণীটা কেন ঝুলানো হলো?
- আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বসবাস করি। ক্ষমার অযোগ্য কোন অপরাধ আমাদের দিয়ে যেন না হয়। তাই এ সতর্কবাণী।
- এটা আপনার রাজকীয় নির্দেশ নয় তো?
- আমি চাই আমাদের এ ভালোবাসা দীর্ঘজীবি হোক।

একদিন শাহরিয়ার রানীকে জড়িয়ে ধরে বলল, অনেক দিন তো হলো আমাদের কী কোনো সন্তান হবে না?
রানী অবাক কণ্ঠে বলল, আমাদের বিয়ের বয়স মাত্র একশ বছর।
কী, একশ বছর! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল শাহরিয়ার।
- এর চেয়ে বেশি হবে না প্রিয়তম!
- আমার মনে হচ্ছে, এই কয়েকটা দিন পার করে এলাম!
- বুঝতে পারছি! তোমার মাথা থেকে এখনো অতীত যায়নি।  
- তবু অন্য সকলের চেয়ে সুখে আছি।
- যখন তুমি তোমার অতীত ভুলে যাবে, তখন তুমি প্রকৃত সুখ অনুভব করবে। বুঝতে পারলে প্রিয়তম।
রানীর কথায় শাহরিয়ার একটু হাসল। অতঃপর রানী চুম্বনে চুম্বনে তার গাল ভরে দিল। কিন্তু দরজার কৌতূহলটা শাহরিয়ারের মন থেকে গেল না। দিন যত বাড়ছে তার কৌতূহলও তত বাড়ছে।

একদিন সে দরজার নিকট কোনো প্রহরী না দেখে দরজার পাশে লাগানো চাবি দিয়ে দরজাটা খুলে ফেলল। ভেতর থেকে একটি ঘ্রাণ এলো। ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে সে সামনে হেঁটে যেতে লাগল। পথিমধ্যে পড়ল বিশাল আকৃতির একটা দানব। দানবটা তাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল। সে যেন একটা ক্ষুদে পাখি। শাহরিয়ার বাঁচার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে, পারছে না। সে চিৎকার করে কেঁদে উঠল, তোমার খোদার দোহাই লাগে আমাকে যেতে দাও তুমি।
দানবটা তাকে মাটিতে আছড়ে ফেলল। শাহরিয়ার সংঙ্গাহীন হয়ে পড়ল।

রাতে মরুভূমির উষ্ণ হাওয়া, অর্ধাকৃতির চাঁদ আর কিছু মানুষের বিড়বিড় দেখে শাহরিয়ার স্বগক্তি করল, এ আমি কোথায়? অবশেষে সে বুঝতে পারল তার শরীরটা অনেক বুড়িয়ে গেছে। সে কোনোমতে হাঁটতে হাঁটতে কাঁদোয়া লোকগুলোর সারির শেষ মাথায় গিয়ে বসল। অতঃপর অর্ধাকৃতির চাদের নিচে সকলে অশ্রুপাত করতে লাগল। ভোর হওয়ার আগে যথারীতি সকলেই প্রস্থান করল। কিন্তু শাহরিয়ার উঠল না। সে অবিরাম কেঁদে চলছে। নগরের পুলিশ প্রধান এসে তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কাঁদছেন কেন?
- এটা জেনে তোমার লাভ নেই।
- দায়িত্ব হিসেবে যা করার আমি তাই করছি।
- কিন্তু আমার কান্নার আওয়াজ তো কারো ঘুমে ব্যাঘাত করছে না!
- বুঝতে পারলাম।
- হারানো অতীত সকলকেই কাঁদায়। বুঝলেন?
- আপনার কি এখন থাকার জায়গা নেই?
- ন।
- ওখানে সবুজ দ্বীপের কাছে একটি খেজুরের বন আছে। আপনি চাইলে সেখানে থাকতে পারেন।
- মন্দ নয়।
-একজন অভিজ্ঞ লোক বলেছেন, যার সকল দুয়ার বন্ধ তার জন্য স্বপ্নের দুয়ার খোলা। মানুষকে স্বাধীন করে দেয়া হয়েছে যেন তারা হতবুদ্ধির মধ্যে ঘরে বেড়ায়। পৃথিবীতে অর্জনের কিছু নেই। আবার বিসর্জনের কিছু নেই।

পুলিশ তার কথা শেষ করে শহর অভিমুখে হাঁটতে থাকে।



[নাগিব মাহফুজ আরবি সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ। কথাশিল্পে আবদানের জন্য ১৯৮৮ সালে নোবেল পুরুষ্কার লাভ করেন। তাঁর নন্দিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে আবস আল আকদার (ভাগ্যের পরিহাস্য) , কাসরোশ শাওক ( প্রেমের প্রাসাদ), আল হুব্বু তাহতাল মাতার (বৃষ্টির নিচে ভালোবাসা)। দুনিয়া আল্লাহ (আল্লাহর দুনিয়া), হামসুল জুনুন (পাগলের প্রলাপ), শাহরুল আসাল (মধু মিলন) তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ। অনূদিত রচনাটি তাঁর এরাবিয়ান নাইটস এ্যান্ড ডেইজ (আরব্য রজনী ও দিবস) গ্রন্থ থেকে নেয়া। প্রাচীন ও আধুনিক আরবি সাহিত্যের এই প্রতিভূ ২০০৭ সালে পরলোক গমন করেন। ]

 


অনার্য মুরশিদ : গল্পকার, অনুবাদক, সাংবাদিক।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়