ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

প্রথম দেখলাম সৈয়দ হককে, যেদিন || টোকন ঠাকুর

টোকন ঠাকুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৮ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রথম দেখলাম সৈয়দ হককে, যেদিন || টোকন ঠাকুর

সৈয়দ শামসুল হক

রিকশায় বসে যাচ্ছেন দুজন। একজনকে চিনে ফেললাম। কারণ, তার মাথায় চুল নেই, বিরাট জুলফি। তার ছবি দেখেছি বইয়ের ফ্ল্যাপে। অনেক বই পড়ে ফেলেছি তার, সেই বয়সেই, যখন আমি ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র, ঝিনাইদহ কেশবচন্দ্র কলেজে।

 

কলেজের সবেদা গাছতলায় দাঁড়িয়েছিলাম, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম। পাঁচিলের ওপারে রাস্তা- অগ্নিবীণা সড়ক। দেখলাম, রিকশায় যাচ্ছেন দুজন। একজনকে চিনে ফেললাম তার জুলফি দেখেই। মনে হলো, উনিই সৈয়দ শামসুল হক। বন্ধু হুমায়ুনের বাইসাইকেল ছিল। বললাম, চল তো। মনে হলো রিকশায় সৈয়দ শামসুল হক।

 

ঝিনাইদহ সদরের প্রধান দুটি সড়কের নাম দুটি কাব্যগ্রন্থ’র নামে। যে-কালে শহর পৌরসভা হয়, সে-কালেই, প্রথম পৌরপিতা ডা. কে আহমেদ শহরের প্রধান দুটি রাস্তার নামকরণ করেন দুটি কবিতার বইয়ের নাম। এক, গীতাঞ্জলি সড়ক। দুই, অগ্নিবীণা সড়ক। আমাদের কেসি কলেজ অগ্নিবীণা সড়কের গা-ঘেঁষে। জেলা শহরের প্রধান কলেজ। সরকারি। আমি ইন্টারে পড়ি। ঢাকার পত্রপত্রিকায় কবিতা পাঠাই ডাকযোগে। বছরে দু-চারখানা লেখা ছাপা হয়। সেই আনন্দেই ঘুরে বেড়াই। ঢাকার কোনো বড় কবি-সাহিত্যিককে ঝিনাইদহে দেখতে পাব, এ তো প্রায় অসম্ভব। কিন্তু মনে হল, দেখে ফেললাম সৈয়দ শামসুল হককে। কিন্তু যাকে দেখলাম, উনিই সৈয়দ শামসুল হক তো?

 

তখন, সেই সময়, সেই আশির দশকের একেবারে অন্তিম প্রান্তে দাঁড়িয়ে ঝিনাইদহ থেকে ঢাকা ছিল অনেক দূর। একমাত্র বিটিভিই ছিল পৃথিবীর টেলিভিশন-ধারণা। ঢাকার দৈনিক পত্রিকা ঝিনাইদহে পৌঁছুত বিকেলে বা সন্ধ্যায়। কাজেই, বইয়ের ফ্ল্যাপ দেখেই লেখকের ছবি দেখতে হতো। তো, ঝিনাইদহ শহরের তখন যে বাসস্ট্যান্ড, লোকে বলত ‘চুয়াডাঙ্গা স্ট্যান্ড’। স্ট্যান্ড থেকে চুয়াডাঙ্গাগামী গাড়ি ছাড়াও যশোর ও কুষ্টিয়া যাওয়ার বাসও ছাড়ত। তাই আমি ও আমার বন্ধু হুমায়ুন বাইসাইকেলে গিয়ে পৌঁছুলাম চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে। আমরা প্রথমে কোন দিকের কাউন্টারে যাব? মনে হচ্ছিল, সৈয়দ শামসুল হককে কোনো না কোনো বাস কাউন্টারেই পাব। ছোট ছোট ঘর বাস কাউন্টারের। খুঁজতে খুঁজতে কুষ্টিয়াগামী এক বাস কাউন্টারের মধ্যে গিয়ে পেলাম। দেখলাম, রিকশায় বসে থাকা সেই দুজন। একটু দুরু দুরু আবার প্রবল আগ্রহ- এই দুই ঝাপটা নিয়েই গেলাম কাছে। জুলফি বড় দেখেই আর মনে মনে বইয়ের ফ্ল্যাপে দেখা ছবি মিলিয়েই, তাকে প্রশ্ন করি, আপনি কি সৈয়দ শামসুল হক?

 

তিনি মাথা নাড়ান। তিনি তখন তাকিয়ে দেখছেন ইন্টারমিডিয়েটে পড়া এক মফস্বলের অচেনা ছাত্রকে। তিনিও আমার নাম জিজ্ঞাসা করলেন। কোন ক্লাসে পড়ি, জিজ্ঞাসা করলেন। আমি তাকে প্রশ্ন করি, ‘যাচ্ছেন কোথায়?’
সৈয়দ হক উত্তর দেন, ‘কুষ্টিয়ায়।’
‘ওখানে কি কোনো অনুষ্ঠান আছে?’
সৈয়দ হক মাথা নাড়ান। বললেন, ‘আগামীকাল কুষ্টিয়ায় বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের জাতীয় সম্মেলন। ইনাকে চেনো?’
সৈয়দ শামসুল হক তার পাশে বসা লোকটাকে দেখালেন। রিকশায় সৈয়দ হকের পাশেই বসা ছিলেন তিনি। আমি মাথা নাড়ালাম। ‘না’ চিনি না।
এতক্ষণে সৈয়দ হক আমার চরিত্রের অস্থিরতা ধরে ফেলেছেন। আমি যে কবিতা লিখি এবং ঢাকার পত্রিকায় দু-একটি ছাপাও হয়, তাও বলেছি তাকে। সেসময়, তখনকার বেশ কুলীনগোছের মাসিক সাহিত্যপত্র ‘দীপঙ্কর’ যেটা দৈনিক ‘সংবাদ’ থেকেই বের হতো, সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আমার দুটো কবিতা ছাপা হয়েছিল তখনকার ‘চলতি’ সংখ্যায়। সেই সংখ্যাতেই সৈয়দ হকের ছোটগল্প  জাদুবাস্তবতার শিহরণ ‘রক্তগোলাপ’ নিয়ে বড় একটা আলোচনা লিখেছিলেন অধ্যাপক শহীদুর রহমান। শহীদুর রহমান কবি ও ছোট গল্পকার। আমাদের কেসি কলেজেরই শিক্ষক। একদা ঢাকাতেই ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে যুক্ত হয়েছিলেন তখনকার দৈনিক পাকিস্তান-এ। শিক্ষকতায় ঢুকলেন শহীদ স্যার। জগন্নাথ কলেজে। বাংলা বিভাগ। ইন্টারে পড়তে আসেন শহীদুর রহমান ঢাকায়, ১৯৫৮ সালে। ভর্তি হলেন ঢাকা কলেজে। ৮১ সাল পর্যন্ত ঢাকায় থাকলেন। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘দিবারাত্রির কাব্য’ নিয়ে উচ্চতর গবেষণায় কলকাতা গেলেন ১৯৮১-তে। গবেষণা অসমাপ্ত রেখে বাংলাদেশে ফিরলেন এবং জয়েন করলেন ঝিনাইদহ সরকারি কেশবচন্দ্র কলেজে। সেই কলেজেই আমি তখন ইন্টারে পড়ি; যেদিনকার কথা লিখছি আজ।
শহীদুর রহমানের বন্ধুরা যারা ঢাকায় ছিলেন, আমি পড়েছি তাদের লেখাও। কারা শহীদুর রহমানের বন্ধু? আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবুল কাসেম ফজলুল হক বা মনসুর মুসা, এঁরা, আমি জানতাম। তো সৈয়দ শামসুল হক, তখন, সেই ১৯৮৮ কি ’৮৯ সালের দুপুরবেলা, ঝিনাইদহ শহরের বাস কাউন্টারে বসে যখন আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘ইনাকে চেনো?’
আমি বললাম, ‘না।’
‘ইনার নাম সেলিম আল দীন। চিনেছ?’

 

আমি অবাক হয়ে যাই। বললাম, ‘পড়েছি। আপনার লেখা নাটক সম্পর্কে আমার একটা ধারণা আছে। আপনিই সেলিম আল দীন?’

 

সেলিম আল দীন মাথা ঝাঁকান। আমি একের মধ্যে দুই পেয়ে গেলাম। কেমন যে ভালো লাগল! সৈয়দ শামসুল হক ও সেলিম আল দীন বসে আছেন আমার সামনে। ঝিনাইদহ শহরের এক ছোট বাস কাউন্টারের মধ্যে। তারা কুষ্টিয়ার বাস এলে সে বাসে উঠলেন। আমি আর আমার বন্ধু হুমায়ুন বাইসাইকেলে চড়ে চলে গেলাম হোস্টেলে। আমরা তখন ‘ঝিনেদা থিয়েটার’ করি। ঝিনেদা থিয়েটারও বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের অঙ্গসংগঠন। পরদিন কুষ্টিয়াতেও গেলাম। কুষ্টিয়া শিল্পকলা একাডেমিতে গ্রাম থিয়েটারের সম্মেলনে আমাদের ঝিনেদা থিয়েটারের নেতৃবৃন্দরা ছিলেন। আমি গেছি সৈয়দ হক ও সেলিম আল দীনের সঙ্গে যদি পুনরায় দেখা হয়, এই আশায়। সেই আশা পূরণ হয়নি। কারণ সৈয়দ হক ও সেলিম আল দীন খুব ব্যস্ত ছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায় কুষ্টিয়া শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে আমি ঢাকা থিয়েটার প্রযোজিত, নাসিরুদ্দিন ইউসুফ নির্দেশিত সেলিম আল দীনের নাটক ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’ দেখেছিলাম। ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’তে দেখা হুমায়ুন ফরীদির অভিনয় আজও আমার মনে আছে। একটা দৃশ্যে ফরীদি দর্শকের উদ্দেশে চোখ মেরেছিলেন। এখনও মনে আছে। টেলিভিশনে তখন তুমুল জনপ্রিয় হুমায়ুন ফরীদি। এর পনেরো-ষোলো বছর পর, যখন আমি ঢাকায় থাকি এবং আমার বন্ধু সরয়ার, বাজার যাকে চেনে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নামে, সরয়ার যখন ওর প্রথম সিনেমা ‘ব্যাচেলর’ বানাচ্ছিল, সেই ‘ব্যাচেলর’-এ আমি ফরীদি ভাইকে পেলাম কক্সবাজার সি-বিচে, ফরীদি আমার কো-আর্টিস্ট। আমি প্রামাণ্য চরিত্র ‘টোকন’। তিনি ফিকশন ক্যারেক্টর আবরার ভাই। প্রায় ১২-১৪ বছর পেরিয়ে গেছে, ‘ব্যাচেলর’ বানানোর। এর মধ্যেই, কয়েক বছর আগে এক পয়লা ফাল্গুনে ফরীদি ভাই মরেও গেলেন।

 

তো সেদিন যখন সৈয়দ হককে তার গুলশানের বাসায় আড্ডাচ্ছলে বললাম ঝিনাইদহের সেই কথা, হক ভাইয়ের তো তা মনে থাকার কথা না। মনে নেইও। শুনে হক ভাই বললেন, ‘তো লিখেছ এটা কোথাও যে, তুমি আমাকে প্রথম কোথায় দেখেছিলে?’
বললাম, ‘না, লিখিনি।’
হক বললেন, ‘লিখে ফ্যালো। মজার স্মৃতি। তার মানে তুমি ঝিনেদাতেই আমাকে প্রথম দেখেছিল?’
‘হ্যাঁ।’
‘লিখো কোথাও।’
‘লিখব।’
‘লেখার বিকল্প নেই।’ হক বললেন।

 

সত্যি। লেখার বিকল্প নেই বলেই আমরা সৈয়দ শামসুল হককে চিনি। জানি। তিনি কী বলতে চেয়েছেন, জেনেছি। তিনি কী বলতে পেরেছেন, জানি। তিনি কী দিতে চেয়েছেন, আমরা পেয়েছি। বাংলা ভাষা পেয়েছে সৈয়দ হককে। গল্প-কবিতা-উপন্যাস-নাটক-চিত্রনাট্য-গীত রচনা-ছবি পরিচালনা-ছবি আঁকানো, ভাস্কর্য নির্মাণ- কী করেননি তিনি? বাংলা ভাষায় রবীন্দ্র-পরবর্তী এত ফল্গুধারার লেখক বা সব্যসাচী লেখক আর কে?

 

 সৈয়দ শামসুল হক, পাশে টোকন ঠাকুর

 

আশি পেরিয়ে, একাশি পেরিয়ে যাচ্ছেন সৈয়দ শামসুল হক। কিন্তু তারুণ্য তার কমে না। প্রেমিক মন তার নেভে না। এখনো সৈয়দ শামসুল হক তুমুল প্রেমিক, আমি জানি। এই নিয়ে তার সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়। কোনো দ্বিধা নেই। হকের সঙ্গে কথা হয় টোটাল আর্ট নিয়েই। একবার, ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আমন্ত্রণে এক সন্ধ্যায় কবিতা পড়তে গেলাম গুলশানে। সর্বজনাব সৈয়দ হক। ১৪ জন কবিতা পড়বেন। শাহনাজ মুন্নী আর আমিই জুনিয়র। মধ্যে নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, রুবী রহমান, কামাল চৌধুরী, আসাদ মান্নান...। অডিয়েন্স সীমিত, শ’ খানেক। প্রথমেই ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারে ১৪ জনকে শুভেচ্ছা জানান গওহর রিজভী। বিরাট গুরুগম্ভীর পদের মানুষ তিনি কিন্তু কবিতার আসরে হাস্যোজ্জ্বল। সেই অনুষ্ঠান হয়েছিল মূলত ভারতীয় হাইকমিশনের অফিসার অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা-প্রেম থেকেই। সন্ধ্যা থেকে কবিতা পাঠে চলল রাত দশটা পর্যন্ত। তারপর ডিনার। ডিনারের আগে মদ্যপান। নানান ধরনের বোতল দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অপেক্ষায়। বোতলের পাশে অপেক্ষা করছে কিছু মানুষ। যে যা নিতে চাচ্ছে, তাকে তাই ঢেলে দিচ্ছে। হক ভাইয়ের সঙ্গে আনোয়ারা সৈয়দ হকও আছেন। আসলে অনুষ্ঠানটির আমন্ত্রণের সময়ই বলে দেওয়া ছিল, ‘আমন্ত্রণ, আপনি ও আপনার মিসেস...।’ আমি চেষ্টা করেছিলাম কাউকে ‘মিসেস’ সাজিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু বেশি রাত হয়ে যেতে পারে ফিরতে, তাই যে দু-একজনকে বলেছিলাম, তারা রাজি হয়নি। একাই গিয়েছিলাম। মিসেস না থাকলে কি করব? গিয়ে দখি, গুণদাও একাই গেছেন। গুণদা ডিভোর্সি। আমি সিঙ্গেল। যাই হোক, বোতল দাঁড়িয়ে আছে, আমরা ওখানে ছিলাম। হক ভাই বললেন, ‘টোকন কি নিচ্ছো?’
‘হক ভাই, আমি ব্ল্যাকলেভেল।’
‘আমাকেও ব্ল্যাকলেভেল দাও।’

 

সে রাতে সবাই ভেসে যাচ্ছিল জলমগ্ন স্রোতের দিকে। সেই স্রোতে, সেই ছোট ছোট ঢেউ আমার এখনো মনে আছে। কড়া এসির মধ্যেও ধূমপান চলছে দেখে, সেই এম্বেসি-নির্ভর গাম্ভীর্যের মধ্যেও আমি ধরিয়ে ফেললাম নেটিভ তামাকের স্টিক। প্রথম টের পেলেন গুণদা। তাই পাওয়ার কথা। গুণদা বললেন, ‘তোমার কাছে ছিল?’
‘ছিল।’
আমি তো ছেড়ে দিয়েছি। ‘‘আমার কণ্ঠস্বর’ পড়ে সেটা পাঠক জানেও যে, আমি আর খাই না। দাও তো একটান।’’
গুণদা টান দিলেন। হক ভাই বললেন, ‘তোমার ঐ এইটে পড়ার কবিতাটি আমার বেশ লেগেছে। ঐ যে, শান্তা। যে কবিতা ক্লাস এইটে উঠেছে এবারে।’
রাত টলে যাচ্ছিল। আমরা তো যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে কেউ ওয়াইন, কেউ ভোদকা, কেউ ব্ল্যাকলেভেলে আছি...

 

ব্ল্যাকলেভেলেই থাকি। কিছু খেলেও, না খেলেও। একবার রাজশাহীতে কবিতা পড়তে গিয়েছিলাম। বিভাগীয় কমিশনারের আমন্ত্রণে। কমিশনার, কবি আসাদ মান্নান। ঢাকা থেকে আরো গিয়েছিলেন আবু বকর সিদ্দিক, নির্মলেন্দু গুণ, মাকিদ হায়দার, অসীম সাহা, শিহাব সরকার, হায়াৎ সাইফ এবং আরো কজন অগ্রজ। আমরা ছিলাম রাজশাহী সার্কিট হাউসে। রাতে, সবাই সার্কিট হাউসে জলমগ্ন, নিদ্রামগ্ন যখন, হক ভাই আমাকে ফোন দিলেন। হ্যালো...
হক ভাই ও আমি সার্কিট হাউস থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কোথাও যাচ্ছি। রাত পায়ের নিচে টলে টলে যাচ্ছে। হক ভাই বললেন, চল পদ্মায়।
পদ্মার পাড়ে কি ঋত্বিক ঘটক দাঁড়িয়ে ছিলেন? বললাম না, রাত টলে টলে যাচ্ছিল। পদ্মা-শহর রাজশাহী কবিতার মতো বেজে বেজে উঠছিল। ঋত্বিককে মনে পড়তে বাধ্য।

 

হক ভাইয়ের ৭৯তম জন্মবার্ষিকীর আয়োজনে আমি আমার ভালোবাসাতেই করেছি। শিল্পকলা একাডেমি অডিটোরিয়াম দিয়ে ব্যাপক সহযোগিতা করেছে। হক ভাইয়ের ওপরে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে সাময়িকী জার্নাল ‘সামান্য কিছু।’ প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা খরচ হয়ে গেল সেই অনুষ্ঠানে। কীভাবে এটা জোগাড় করেছিলাম, আমার দু-তিনজন সহকর্মীই জানে সেই জ্বালা, যন্ত্রণা। কিন্তু ভালোবাসা থাকলে জ্বালা-যন্ত্রণাও সয়ে যেতে হয়।

 

সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে বন্ধুত্বের একটি মজা হচ্ছে, এই কবির মনটা খুবই তরুণ। হাতে ব্রেসলেট পরে থাকেন, নতুন জিন্সের প্যান্ট পরেন, চিন্তায় থাকেন উন্মুক্ত,  তরুণ কবির মতো ঝাঁঝাল, এ দেশে দ্বিতীয়জন কাউকে আমি এমন পাইনি।

 

সাহিত্যের সব শাখাতেই সৈয়দ হক নিরীক্ষায় পর নিরীক্ষা করেছেন। নিরীক্ষা শুধু নিরীক্ষাতেই সীমিত থাকেনি। উত্তীর্ণ ফসল হয়ে উঠেছে। বাংলা ভাষা তাকে ‘সব্যসাচী’ বলে ডাকে, ডাকবেই।

 

এ রকম একজন বড় লেখক, বড় কবি বা বড় ঔপন্যাসিক-নাট্যকারের শরীরে ক্যানসার ঢুকেছে, এটা একটা খবর। এই খবরের সময়টায় তিনি লন্ডনে, চিকিৎসাধীন। এরই মধ্যে কেমো শুরু হয়েছে। হক ভাইয়ের শ্যালিকা, চারুকলায় আমার বেশ সিনিয়র ব্যাচের বিউটি আপার মধ্য দিয়ে আমি একটা যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করি। দেশের গণমাধ্যম বেশ বিচলিত, হক ভাই কবে সুস্থ হয়ে ঢাকায় ফিরছেন, সেসব নিয়ে। আমার ব্যক্তিগতভাবে এ নিয়ে তেমন চিন্তা নেই। আমি জানি, সৈয়দ হকের এষণা থেকেই জানি, তিনি বাঁচতে চান ১১৬ বছর। লালন ফকিরের সমান বয়সি হতে চান লেখক। শরীর তাকে সে পর্যন্ত নিয়ে যাবে, আমারও তাই আকাঙ্ক্ষা। সেদিন খবরে দেখলাম, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজের কাজে লন্ডনে গেলেও রোগী সৈয়দ হকের সঙ্গে দেখা করেছেন। নিশ্চয়ই লেখক সৈয়দ হক এতে প্রাণিত হবেন। এবং তিনি সুস্থ হয়ে ঢাকায় ফিরবেন কিছুদিনের মধ্যেই।

 

ছবি বানাব। ছবির নাম, ‘খেলারাম খেলে যা’। হক ভাই বললেন, ‘বাবর হিসেবে কাকে ভাবলে?’
বললাম, ‘এখনো কাউকে ঠিক করিনি। খুঁজছি। আপনাকেও অ্যাক্ট করতে হবে।’
‘বেশি রেখো না। ধকল তো।’

 

না না। আপনি করবেন সৈয়দ হক চরিত্রই। প্রামাণ্য টনে। আর বাবর থাকবে ফিকশনের উল্লেখিত বয়স অনুযায়ী, চল্লিশ পেরুলো যার, কপালের কাছে মাথায় চুল এক জায়গায় সামান্য একটু পাক ধরেছে। তাতে তাকে ভালোই লাগে দেখতে। বাবরের হাসিটাই বেশি সুন্দর। মেয়ে পটাতে কাজে দিচ্ছে খুব। কে হবে বাবর আলী?
খুঁজছি। ১৯৭০ সালের চল্লিশ পেরুনো বাবরের একাধিক বালিকা বন্ধু আছে, বাবর সেই বালিকাদের নিয়ে যা যা করে, তাই, কেন করে তাই, বাবরের ক্রোধের কারণ কী? এ-সবই মুখ্য হয়ে উঠবে। দেশভাগ বাবরকে ভেঙে দিয়েছে, বাবর তো দেশ ভাগ করেনি। এইসব থাকবে ‘খেলারাম খেলে যা’তে। এসব নিয়ে হক ভাইয়ের সঙ্গে আমার নানান আলাপ-সালাপ হয়। ছবি-চিত্রকলার আলাপের ফাঁকে ফাঁকে কবিতার নানান পঙ্ক্তি এসে সৈয়দ হকের মুখে উচ্চারিত হয়। সৈয়দ হক উচ্চারণ করেন তার নিজের লেখা পঙ্ক্তি, কখনো তার বন্ধু আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর পঙ্ক্তি। শামসুর রাহমানের সঙ্গেও তার বন্ধুত্ব ছিল প্রগাঢ়, ছিল কাইয়ুম চৌধুরী, আলমগীর কবির, জহির রায়হান বা সন্ধানীর গাজীর সঙ্গে। বন্ধুত্ব ছিল ফয়েজ আহমদের সঙ্গে। আসলে সৈয়দ হক যে যুগের সন্তান, তখন বন্ধুত্ব একটা বিষয়ই ছিল, যেটা মানুষ আমৃত্যু বয়ে নিয়ে যেত। বন্ধুত্ব রক্ষাটা দায়িত্ব মনে করত। এখন অন্য যুগ। বাণিজ্যই সব। তবু এ যুগে এসেও, আমি অনুভব করি, বাংলা ভাষার এই যে এত বড় মাপের একজন সব্যসাচী লেখক হক, তার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কী? অগ্রজ-অনুজ সহযাত্রীই শুধু? আমার মনে হয়, এর বাইরে দিয়ে চলে যায় সম্পর্কের রেখা। তাই, আই ফিল ইট, আমিও সৈয়দ হকের এ যুগের এক বন্ধু। আমি তাকে অগ্রজে পাই, বন্ধুত্বে পাই। এই বন্ধুত্ব বয়ে নিয়ে যেতে পারায় তুমুল আগ্রহ আমার।

 

হক ভাই, ঢাকায় চলে আসেন। দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। কাগজওয়ালারা আমাকে খালি লেখার চাপ দিচ্ছে। কিন্তু আমি কি ডাক্তার, যে একজন রোগ-আক্রান্ত মানুষকে নিয়ে একাধিক লেখা লিখব?
লিখছি এ জন্যে যে, আমি তাকে ভালোবাসি। যারা লিখতে বলছে, তারাও সেই ভালোবাসা থেকেই বলছেন। যারা পড়বে, তারা তো সৈয়দ হককে ভালোবাসেনই।
ভালোবাসাই সত্য। ভালোবাসাই অমৃতস্য।

 

১৪ জুন, ঢাকা



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুন ২০১৬/এএন/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়