ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ফুটবলের প্রেমে সবকিছু তুচ্ছ মনে হতো || জাকারিয়া পিন্টু

জাকারিয়া পিন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪৩, ২৭ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফুটবলের প্রেমে সবকিছু তুচ্ছ মনে হতো || জাকারিয়া পিন্টু

জাকারিয়া পিন্টু, ছবি : আমিনুল ইসলাম

১৯৫৭ সাল। আমি তখন স্কুলে পড়ি। স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠলাম আমরা। যেদিন ফাইনাল তার দুদিন আগে থেকে আমার মা অসুস্থ। ফাইনালের দিন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম খেলব না। আমি মায়ের পাশে বসে থাকলাম। কিন্তু মা আমাকে খেলতে যেতে বললেন। সেই সময় অনেক কষ্ট করে ঢাকা থেকে আমার জন্য একজোড়া বুট কিনে আনিয়েছিলেন মা। সেই বুটজোড়া পড়েই খেলতে গেলাম। খেলার তখন ১০ কি ১৫ মিনিট বাকি। আমার করা গোলে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল আমাদের দল। তখন খবর পেলাম মায়ের অবস্থা বেশ  গুরুতর। তিনি আমাকে দেখতে চান। আমি ভাবলাম খেলা শেষে ট্রফি ও মায়ের দেয়া বুটজোড়া নিয়ে হাজির হবো। খেলা শেষ হলো, ট্রফি এবং সেই বুটজোড়া নিয়ে ঠিকই বাড়ি ফিরলাম; মায়ের কাছে। কিন্তু মাকে আর পেলাম না। মা আমার ততক্ষণে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

 

বাবার মৃত্যুর সময়ও আমি কাছে থাকতে পারিনি। তখন আগা খান গোল্ডকাপ চলছিল। আমি টুর্নামেন্ট কমিটিতে ছিলাম। মোহামেডান আর কেপিটির ম্যাচে একটি গোল নিয়ে হঠাৎ ঝামেলা বাধল। এমন সময় খবর এলো, বাবা অসুস্থ। আমাকে শেষবারের মতো দেখতে চান। কিন্তু আমি তখন টুর্নামেন্ট কমিটির দায়িত্বে, ফলে ঝামেলা না মিটিয়ে যেতে পারলাম না। পরে আবার নতুন করে খেলা শুরু হলো। এক সময় খেলা শেষও হলো। যখন আমি বাসায় ফিরলাম তখন রাত ১১টা। গিয়ে শুনি বাবা নেই। তখনই বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটলাম। বাড়ি গিয়ে বাবাবে দাফন করলাম।

এখানেই শেষ নয়। ফুটবলের প্রেমে পড়ায় আমার কাছে সবকিছুই তুচ্ছ মনে হতো। মা ও বাবার মৃত্যুর সময় পাশে থাকতে পারিনি। বিয়ে করার পর বাসরও করতে পারিনি। বাসর রাতে আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম ফুটবল খেলতে। আমার এক ছেলে তিন মেয়ে। তাদের জন্মদিনেও আমি ঠিকমতো কখনো থাকতে পারিনি। এমনকি তাদের ভালো নামও আমি ঠিকমতো বলতে পারব না।

 

বাবা সেনাবাহিনীর ডাক্তার ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আমিও ডাক্তার হই। কারণ, আমি বড় ছেলে। কিন্তু ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা কখনোই আমার ছিল না। ছোটবেলা থেকেই আমি ফুটবলার হতে চেয়েছিলাম। ১৯৫৬ সালের ঘটনা। বঙ্গবন্ধু তখন বড় নেতা। একবার তিনি গিয়েছিলেন আমাদের পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া সফরে। তার আগমনে আমরা প্রীতি ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নিই। সেখানে প্রধান অতিথি করি বঙ্গবন্ধুকে। ম্যাচে আমি একটি গোল করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু আমার খেলা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।  ম্যাচ শেষে আমাকে বললেন, তুই তো অনেক ভালো খেলিস। আমি নিশ্চিত তুই একদিন বড় ফুটবলার হবি।

বাবা যে আমাকে ফুটবলার বানাতে চান না, কথাটি তিনি কার কাছ থেকে যেন শুনেছিলেন। ম্যাচ শেষে তিনি সরাসরি বাবাকে তার হাতে হাত রাখতে বললেন। হঠাৎ এমন আচরণে বাবা বেশ ভড়কে গেলেন। বাবা আসলে সে সময় এর কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। হাত রাখার পর বঙ্গবন্ধু বাবাকে বললেন, তোমার বড় ছেলেকে ফুটবলার বানাও। তাকে ডাক্তার হওয়ার জন্য চাপ দিও না। এরপর বাবা আর কখনোই আমাকে ডাক্তার হওয়ার জন্য চাপ দেননি।

 

 

এরপরের ঘটনা ১৯৭৩ সালে। বঙ্গবন্ধু তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। আমি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক। আমরা মালয়েশিয়ায় যাবো মাদরেকা কাপ খেলতে। যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তখন তিনি আমাকে চিনে ফেললেন। বললেন, তুই জাকারিয়া পিন্টু না! আমি বলেছিলাম না তুই একদিন বড় ফুটবলার হবি। এই টুর্নামেন্টে আমাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দরকার নেই। তবে তোরা যে স্পৃহা নিয়ে ৯ মাসে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিস সেই স্পৃহা নিয়ে খেলিস। দেখিস এমনিতেই ভালো করতে পারবি। যা আমি দোয়া করে দিলাম। তখন মাদরেকা কাপের চ্যাম্পিয়ন ছিল মিয়ানমার। নিয়মানুযায়ী মাঠে সবার আগে তাদের প্রবেশ করার কথা। কিন্তু আমরা সদ্য স্বাধীন দেশ হওয়ায় আমাদের আগে মাঠে প্রবেশ করতে দেওয়া হলো। আমরা যখন মাঠে প্রবেশ করলাম তখন ৪০ হাজার দর্শক দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে শুরু করল- শেখ মুজিব, বাংলাদেশ, শেখ মুজিব, বাংলাদেশ।

আমি মনে করি, আমার ফুটবলার হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান বঙ্গবন্ধুর। তিনি সেদিন আমার বাবাকে প্রতিজ্ঞা না করালে হয়তো আমি ডাক্তার জাকারিয়া পিন্টু হতাম। ফুটবলার জাকারিয়া পিন্টু হতাম না।

 

ছোটবেলায় রোজা এলেই আমাদের মধ্যে ঈদের আমেজ শুরু হয়ে যেত। আমরা সমবয়সীরা পাল্লা দিয়ে রোজা রাখতাম। কে কয়টা রোজা রাখতে পারল সেটা নিয়ে চলত হিসাব-নিকাশ। আমাদের একটা দল ছিল। সাহরি খাওয়ার সময় হলে সবাই মিলে মানুষকে ডেকে তুলতাম। কখনো যদি সাহরি খেতে উঠতে না পারতাম তখন খুব কষ্ট লাগত। ঈদ আসার আগে আগে জামা-কাপড় কেনার প্রতিযোগিতা চলত। কে কতো ভালো পোশাক কিনতে পারল। তবে আমরা পোশাক লুকিয়ে রাখতাম। ঈদের দিন ছাড়া বের করতাম না। যদি আমার পোশাক দেখে অন্য কেউ সেরকম কিনে ফেলে সেই ভয়ে। তখন অবশ্য পোশাকের এতো দাম ছিল না।

চাঁদ দেখার মধ্যেও ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আমাদের মধ্যে একটা ধারণা ছিল নিজ চোখে চাঁদ না দেখলে ঈদ হবে না। ২৯ রোজার দিন বিকেল হওয়ার পর থেকেই আমরা দলবেঁধে চাঁদ দেখতে যেতাম। চাঁদ দেখতে পেলে কী যে খুশি হতাম- আজও তা মনে পড়ে।

 

ঈদের দিন সকাল সকাল উঠে গোসল করতাম। এরপর দলবেঁধে এ বাড়ি ও বাড়ি বেড়াতে যেতাম। কেউ কাউকে তখন এতো ঘটা করে দাওয়াত দিত না। এমনিতেই দাওয়াত হয়ে যেত। সে সময় সবাই মিলে খাওয়ার মধ্যে যে কী মজা ছিল, বলে বোঝানো যাবে না। বড় হবার পর অবশ্য এমন মজা আর পাইনি। তখন ফুটবলেই ডুবে ছিলাম। তবে সে সময় রোজা রেখে ফুটবল খেলতাম। আর রোজা রেখে যে কয়টা ম্যাচ খেলেছি, আল্লাহর রহমতে সবকটা ম্যাচই জিতেছি। রোজা রেখে যখন খেলতাম তখন ভক্তদের পাগলামি দেখেছি। ম্যাচ শেষ হলে সবাই ইফতার নিয়ে হাজির হতো। তারা বলত- ভাই আমরা জানি আপনি রোজা রেখে খেলেছেন। আমার ইফতারটা নেন। কে কার আগে আমাকে ইফতার দিবে এ নিয়ে প্রতিযোগিতা লেগে যেত। অবশ্য বড় হয়ে সব সময় চেষ্টা করেছি পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে।

 

 

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুন ২০১৬/পরাগ/এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়