ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

বিজলী মার্কা সাবান অথবা কালের পোস্টমাস্টার || রুমা মোদক

রুমা মোদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ২৯ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিজলী মার্কা সাবান অথবা কালের পোস্টমাস্টার || রুমা মোদক

রুমা মোদক

রূপে চমক আনে বিজলী মার্কা সাবান

দোকানে ঝুলানো বিজ্ঞাপনটিতে দাঁত কেলিয়ে হাসছে উঠতি নায়িকা নিশি। মাত্রই সিনেমা করতে এসে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে মেয়েটি, যতটা না অভিনয় দিয়ে তার চেয়ে বেশি এক ক্রিকেট তারকাকে ঘিরে স্ক্যান্ডেলিংয়ের জন্ম দিয়ে। পত্রিকা খুললেই তাদের প্রেম-যৌনতা নিয়ে রগরগে নিউজ। দোকানে ঝুলানো নিশির উগ্র হাঁ খোলা জামার বগল কাটা হাতে সবুজ রঙের বিজলী মার্কা অসহায় ম্লান সাবানটির দিকে তাকিয়ে আব্দুল খালেকের কথা ভাবতে না ভাবতেই আব্দুল খালেক এসে ‘সুইটি স্টোর’র সামনে দাঁড়ায়। উপজেলা সদরের বাজারের মেইন পয়েন্টে একচালা টং দোকানটি মনিহারি দোকান হিসাবে এলাকায় সুপরিচিত। কেননা হরেক রকম জিনিস মেলে এখানে। মূলত প্রতি সপ্তাহে বিক্রয়কর্মীরা নানা কিসিমের পণ্য গছিয়ে দিয়ে যায়, ঝুলিয়ে দিয়ে যায় নিত্যনতুন বাহারি বিজ্ঞাপন। এ ক্ষেত্রে ঈমান আলী যে নীতি মেনে চলে, তা হলো সে সেই পণ্যই রাখে যে পণ্য বিক্রয়কর্মীরা বাকিতে দিয়ে যেতে রাজি হয়। বিক্রি হলে টাকা- এই শর্তে অনেক বিক্রয়কর্মী রাজি হয়, অনেকে হয় না। এই নতুন সাবানটিও এক বিক্রয়কর্মী গছিয়ে দিয়ে গেছে একই নীতিতে। আর কেউ না হোক প্রায় প্রতি সপ্তাহে সাবানের খোঁজে আসা আব্দুল খালেক যে একবার ঢুঁ মারবেই, তাতে কোনো সন্দেহই ছিল না ঈমান আলীর। দীর্ঘ পাঁচ থেকে সাত বছর তো হবেই। ঈমান আলী দেখছে আব্দুল খালেক সুইটি স্টোরে আসে, এ সাবান সে সাবান, নতুন আসা সাবান, পুরোনো সাবানের মোড়ক সব উল্টেপাল্টে দেখে, গন্ধ শুকে তারপর অপেক্ষাকৃত নতুন সাবানটি কিনে নিয়ে চলে যায়। আশপাশের দোকানদারদের ধারণা, এটা তার বাতিক। দোকানে দোকানে ঘুরে সাবান খোঁজা। তারা বিরক্ত হয়। কিন্তু ঈমান আলী হয় না। তার একটা অনুক্ত কারণ অবশ্য আছে, ঈমান আলী যদিও তা কাউকে বলে না এমনকি আব্দুল খালেককেও না, তা হলো এই যে ঈমান আলীও খালেকের মতোই নিঃসন্তান। খুব আগ্রহ নিয়ে সামনে দাঁড়ানো আব্দুল খালেককে নতুন আসা সাবানটি দেখায় ঈমান আলী- একডা বালা গতরের হাবান নু আইছে খালেক বাই! আব্দুল খালেকের দৃষ্টি বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে ঈমান আলী বাতিকগ্রস্ততার ছায়া খুঁজে পায় না। ঈমান আলীর বোধ হয়, আব্দুল খালেক কিছু খুঁজছে। দৃষ্টিতে তার বাতিকগ্রস্ততা নয়, অনুসন্ধিৎসা। কী খোঁজে আব্দুল খালেক, ঈমান আলী বুঝতে পারে না।

 

চারা গাছে নতুন পাতা

খুব ভোরে গরুর দুধ দুইয়ে, গরু দুটোকে পাশের বিছরায় ডিকরা দিয়ে, দুই লিটার দুধ এসিসটেন্ট ম্যানেজারের বাংলোয় পৌঁছিয়ে, বাকি দুধটুকু ঘাগড়ায় ভরে সোয়ামি বীরেন উড়াংকে খাইয়ে দাইয়ে উপজেলা সদরের বাজারে পাঠিয়ে, নিজে দুটো মুখে দিয়ে কাজে যায় রূপালী উড়াং। সেই কবে উড়িষ্যা থেকে এসেছিল পূর্বপুরুষেরা, তখন থেকেই একই জীবন, পরম্পরাক্রমে। বাইরের পৃথিবী যতই বদলাক বীরেন উড়াং রূপালী উড়াংরা তার খবর রাখে না। দুধ দোয়ানো থেকে এসিসটেন্ট ম্যানেজারের বাংলো ঘুরে আসা সময়টুকুর মাঝে ননদ সুমিত্রা কাঠ কয়লার আগুনে চারটে ভাত আর আশপাশের জংগল থেকে কুড়িয়ে আনা শাকপাতা রান্না করে রাখে। সারা দিনের খোরাক। ঘরে বছর ছুঁতে যাওয়া যমজ বাচ্চা। বাচ্চা হবার পর বদলি কাজে ননদ সুমিত্রাকে পাঠালেও মাস খানেক হলো কাজে জয়েন দিয়েছে রূপালী। দৈনিক ১৭ কেজি পাতায় সপ্তাহে ৮৫ টাকা মজুরি। পঞ্চায়েতের ঠিক করা রেইট। যদিও প্রথমটায় লেবাররা আপত্তি করেছিল, এত কম টাকায় পোষাবে কী করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পঞ্চায়েতের কথাই মেনে নিতে হয়েছে। কেন না এই নতুন পঞ্চায়েত যে তারাই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। তাদের কথা মানা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু অদক্ষ হাতে সুমিত্রা দিনে ১৭ কেজি পাতাও তুলতে পারত না। ফলে দৈনিক পঁচাশি টাকা থেকে কমে যেত মজুরি। সপ্তাহান্তে তলবের দিনে সবাই যখন ফুর্তিতে অরুণের তৈরি হাড়িয়া খেত, বীরেন-রূপালী তখন বিষণ্ন মুখে বসে থাকত ঘরের দাওয়ায়। অবশেষে বছর না ঘুরতেই কাজে জয়েন দেয় রূপালী। পাতা তোলায় ওর মতো দক্ষ আশপাশে আর কেউ নেই। বাচ্চাগুলো থাকে সুমিত্রার জিম্মায়। গরুর দুধে জল মিশিয়ে বোতলে ভরে নিয়ম করে বাচ্চা দুটোকে খাওয়ায় সুমিত্রা। দুধের বোতলগুলো ভরতে ভরতে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেয়ার প্রয়োজন বোধ করে রূপালী। বোতলগুলো ঘরের কোণায় বাঁশের পাল্লায় ঠেস দিয়ে বাইরে রাখা প্লাস্টিকের জগটা নিয়ে দৌড়ায় টিলার উপরে সারি সারি চা-গাছের আড়ালে। এখানেই প্রাকৃতিক কাজ সারতে হয় তাদের। রিংয়ের পায়খানা বানানোর জন্য কোম্পানি ঋণ দেয় বটে, তবে তার টাকা কেটে রাখে মজুরি থেকে। এমনিতেই মজুরির টাকায় এনজিওর কিস্তি দিয়ে আর রেশন তুলে বাকি কিছুই থাকে না। খাওয়া জুটুক না জুটুক, এনজিওর হার্মাদ ব্যাটাগুলো কিস্তি না দিলে ঠিক গরুগুলো নিয়ে চলে যাবে। ভাগ্যিস সামনের জমিতে যে ধান হয় তা দিয়ে মাস ছয়েকের খোরাকি হয়ে যায়, নইলে না খেয়ে মরতে হতো।

 

ডাঙায় তোলা মাছ

নতুন টিলা বাবু বাগানে ঢুকতেই প্রথম ধাক্কা খেয়েছিল প্রচণ্ড দুর্গন্ধে। এ কী অবস্থা, যে দিকে হাঁটা যায়, সেদিকেই মানুষ আর পশুর প্রাকৃতিক বর্জ্যরে দুর্গন্ধ। তার জন্য বরাদ্দ বাসাটি অবশ্য বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সামনে খোলা মাটির রাস্তা পিছনে বেশ খানিকটা খালি জায়গা। ঘর পরিষ্কার করতে করতে সুখেন গল্প করছিল- আগের টিলা বাবু ইখানে ছবজি ছাস করত রে দাদা। তুইও করতে পারবি। খুব ভালো ছবজি হয় ইখানে। শীতের কালে ছিম, টমেটো, ফুলকপি ছব হয়, আবার গরমকালে তরমুজ ও হয় বটে। নতুন আসা টিলাবাবুর অবস্থা তখন সেই পোস্টমাস্টারের মতো, ডাঙায় তোলা মাছের দশা। চা-বাগানের চাকরিটা তার মোটেই পছন্দ ছিল না। পিতৃহীন সংসারে বড় ভাইয়ের পানের টংয়ের ইনকামে আটজনের সংসার প্রায় অচল। পড়াশোনাও খুব বেশি নয়, পাসকোর্সে ডিগ্রির ঘর পার হওয়া, চাকরির বাজারে যা একেবারেই সুলভ। বাড়ির কাছে চা-বাগানে চাকরিটা জুটে গেলে পরিবার থেকে বলতে গেলে জোর করে পাঠিয়েছে তাকে। বন্ধু-বান্ধবরা নানা রকম ভয়ডর দেখিয়েছে। প্রয়োজন আর অনিচ্ছার দোটানায় অবশেষে খুব বেশি দিন থাকা নয় এমন একটা মনোভাব নিয়ে ঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে সে। মাটির মেঝে আর মাটির দেয়াল, বেশ সুন্দর করে নিকানো। পূর্ববর্তী টিলাবাবুর ভরা গার্হস্থ্যর সুনিপুণ ছাপ সর্বত্র। সুখেন বলতে থাকে- বুঝলি রে দাদাবাবু আগের দাদাবাবু নিজের ছেইলাটাকে এই চারকিতে ঢুকানোর কত ছেষ্টা করিল, কিন্তু নাই পারিল। নতুন আসা টিলাবাবুর মৃদু কৌতূহল হয় কেন পারল না জানতে। কিন্তু এই বিরানভূমিতে এসেই মনটা তেঁতো হয়ে আছে, কোথায় নতুন গড়ে উঠতে থাকা শহরের চাঞ্চল্য আর কোথায় এই সাপখোপের বসতি জঙ্গল! কীভাবে দিন কাটবে- এই দুশ্চিন্তায় বিষণ্নতা আঁকড়ে ধরে তাকে, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রশ্ন করার ইচ্ছে জাগে না তার। কিন্তু সুখেন নিজেই বলতে থাকে- ছাইলাটা কেমনে জানি নিছা ভাং ধরিল, রাছতার মোড়ে জুয়ার আছর বছাইতো, কী কেলেঙ্কারি কাণ্ডরে দাদাবাবু।

 

জান দেব তো জমি দেব না

প্রাকৃতিক কাজ সারতে সারতে রূপালী শুনতে পায় দূর থেকে লেবাররা আসছে দলে দলে, তাদের মুখে স্লোগান। হাতে তির-ধনুক, বল্লম, কারো মাথায় ঝাঁকি, রূপালী বাঁ হাতটা মাটিতে ঘষে পরিষ্কার করে ধুয়ে নেয় তাড়াতাড়ি। তার মনে পড়ে আজ বাড়ির সামনে ধানি জমিতে সমাবেশ হবার কথা। পঞ্চায়েতপ্রধান সুধীর বাকতি কাল সন্ধ্যায় বলে গিয়েছিল। দ্রুত পায়ে বাড়ি ফিরে সে, ননদকে ডাকে- ‘হে ছুমিত্রা ছাও গুলারে খাইতে দে দিকিন। হামি এক দৌড়ে দুধটাতো পৌঁছাই দিয়ে আছি। তুর মনেক লাই আজ ছমাবেচ হবে!!’ দুধের বোতলগুলো নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায় রূপালী। দুধটা পৌঁছে দিয়েই সমাবেশে যাবে সে। সুধীর বাকতি বলেছে ওই ধানি জমিগুলো নাকি খাস জমি। সরকার নিয়ে নেবে। আর ধান চাষ করতে দেবে না। যদিও রূপালীদের জমির পরিমাণ সুধীর বাকতির জমি থেকে অনেক কম, তবু যা আছে বছরের অর্ধেক খোরাকি তো হয়, জমিগুলো সরকার নিয়ে গেলে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। দুধারে চা গাচের সারির মাঝে মাটির পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে রূপালীর। ‘ছমাবেছ’ শব্দটা শুনেই তার শরীরে শিহরণ লেগেছে কাল। সিলেট শহরে থাকতে একটা সমাবেশে গিয়েছিল সে। তাদের স্কুলের একটা মেয়ে ধর্ষণ হয়েছিল। স্কুলের ম্যাডামরা মিছিল করে নিয়ে গিয়েছিল, কলেজ থেকে কত নেতারা এসে যোগ দিয়েছিল। সিলেট শহরকে দুভাগ করে চলে গেছে সুরমা নদী, তার উপরে কিন ব্রিজ। এর নিচে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছিল তারা। সিলেটের মেয়র- কী যেন নাম ছিল- ও হ্যাঁ মনে পড়েছে কামরান ভাই, সবাই এই নামেই ডেকেছিল তাকে। কী জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছিল সেদিন। স্কুল থেকে আসা সবগুলো মেয়েকে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেছিল। কেক আর ঠান্ডা খাইয়েছিল। নিজেকে কী ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল সেদিন। সেই জীবনে কত স্বপ্ন ছিল রূপালীর, সব কোথায় হারিয়ে গেল। সেই জীবন আর এই জীবনে কত আকাশ- পাতাল ফারাক।

 

হায় বুদ্ধিহীন মানব হৃদয়

সুখেন এসে সকাল বেলায় উঠান ঝাড়ু দেয়, বাসার পেছনে অনুচ্চ বাগানটিতে কোদাল কুপিয়ে মাটি তৈরি করে সবজির চারা লাগানোর জন্য। ততক্ষণে টিলাবাবু উঠে হাত-মুখ ধুয়ে টয়লেট গোসল সেরে নেয়। সুখেন কুড়িয়ে আনা লাকড়ি পুড়িয়ে ভাত ফুটায়, সঙ্গে ডিম ভাজি আর পাশের সবজিখেত থেকে তুলে আনা তিতা করলা কাঁকরোল ভাজি। নতুন টিলাবাবু আন্দাজ করে এই সামান্য কাজে মহাবিরক্ত সুখেন সারাক্ষণ খিটখিট করে। আগের টিলাবাবুর ঘরভর্তি মানুষ ছিল, বৈচিত্র্যময় কাজও ছিল। অবশেষে সুখেন একদিন বলেই ফেলে- তোর এসব টুকিটাকি কাম করিতে হামি আর নাই আসিবেক রে দাদাবাবু। টিলাবাবু চমকে ওঠে। বলে কী? তবে কি ফিরে কুয়ো থেকে জল তুলে, লাকড়ির আগুনে হাত পুড়ে রান্না করে খেতে হবে নাকি, যে কাজ জীবনে করেনি? সর্বনাশ এরকম হলে চাকরিটাই ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু মুখ ফুটে সে আশঙ্কা প্রকাশের আগেই সুখেন বলে- কাল থিকে হামার মাইয়া সক্কাল সক্কাল আসিয়া এই কাজটুকুন করিয়া দিবে। টিলাবাবু হাঁফ ছাড়ে। পরদিন মেয়েটি আসে, কালো কুচকুচে, নাক বোচা, ঠোঁটগুলো উল্টানো তার দিকে তেমন ফিরে দেখে না সে। এ তার ধাত নয়। সঙ্গী বন্ধুদের মতো পারতপক্ষে হ্যাংলার মতো মেয়েদের দিকে সে তাকায় না। তা সে শহরের যতই ডাকসাইটে সুন্দরী হোক। আর এগুলো তো বাগানের কুলি-কামিন। কিন্তু মেয়েটি যখন চোখের সামনে এসে পড়ে না তাকিয়ে উপায় থাকে না। এমনিতেই বাগানের চা-শ্রমিক মেয়েদের বয়স বোঝা মুশকিল। কেশোরোত্তীর্ণ যুবতী বয়সটা পার হলেই তাদের বয়সটা যেন থেমে যায়। রোদেপুড়া উদয়াস্ত শ্রম তাদের বয়সটা যেন বেঁধে ফেলে। মেয়ে আর মেয়ের মাকে দেখতে প্রায় সমবয়সি লাগে। মেয়েটিকে দেখলে বোঝা যায় অবশ্য কেবলই যৌবনপ্রাপ্ত হয়েছে- ‘টিলা বাবু তুই যদি দুধ কিনিয়া আনিচ তো তোকে আমি দুধ চা বানাইয়া খাওয়াতে পারি’ - মেয়েটির কথা যেন জাদুমাখা। টিলাবাবু অগ্রাহ্য করতে পারে না। সত্যি সেদিন টিলায় টিলায় ঘুরে অনেক ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও এক প্যাকেট দুধ কেনার তাড়া তাকে টেনে নিয়ে যায় বাজার পর্যন্ত। পরদিন সকালে মেয়েটির বানানো চা খেয়ে শরীরটা যেন একলাফে চাঙা হয়ে ওঠে। অপূর্ব চা বানায় মেয়েটি। সেদিনই সে মেয়েটিকে সামান্য মনোযোগী দৃষ্টিতে দেখে, বারবার সামনে এসে পড়া একটা প্রাণীর মতোই, বাধ্য চোখে। কিন্তু সেই নির্বিকার চোখে মেয়েটি একটু ব্যতিক্রম হয়ে ওঠে। তার কপালের টিপ, কানের দুল আর নাকের নাকফুল নিয়ে। রংটা কালো হলেও চেহারাখানা বেশ মিষ্টি বোধ হয় টিলাবাবুর। চা খেতে খেতে মেয়েটির গড়বড় করে বলে যাওয়া কথাগুলো কেমন কৌতূহল উসকে নিয়ে আবার নিবৃত্ত করার মতো অদ্ভুত আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। সিলেট শহরে কারো বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করত মেয়েটি। ব্র্যাক স্কুলে ক্লাস টেন অবধি পড়েছে। ওখানেই শহরে বাবুদের মতো চা খেতে শিখেছে। আসছে বছরই এসএসসি পরীক্ষা দিত সে। কিন্তু বাবুর ছেলেটা যেদিন রাতের অন্ধকারে ওকে ঝাপটে ধরে কামড়ে আঁচড়ে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল, তার পরদিনই সে কেঁদেকেটে বাড়ি ফিরে এসেছে, যদিও বাবা-মাকে আসল কারণটা জানায়নি, আজ টিলাবাবুকেই বলল সত্যিটা। মেয়েটার চোখে জল টলমল করে। বিশ্বাসের সুরে বলে সে- ‘আর ই বছরটা থাকতি পারলি মেট্রিক পাস দিতাম রে বাবু।’ মেয়েটির বলার ঢঙে নিশ্চিত হয় টিলাবাবু এ বড় গোপন কষ্টের জায়গা তার। যার মর্যাদা বোঝার কেউ চারপাশে নেই।

 

আমার মাটি আমার মা। জান থাকিতে দিব না

ঘরে ঢুকে নিভে যাওয়া আগুনে ফুঁ দিয়ে পানির মগটা বসিয়ে দেয় রূপালী। নিজেই গাছ থেকে কাঁচা পাতা তুলে এনে গুঁড়ো করে রোদে শুকিয়ে পাতা বানায় সে। সেই পাতা আর এক চিমটি লবণের এক মগ চা সকাল সকাল না খেলে শরীরটা ম্যাজম্যাজ করে। ও দিকে যতই বেলা বাড়ছে, উত্তাল হচ্ছে মাঠ, সুমিত্রা উত্তেজিত- ‘অ বউ কখন যাবি রে, সবাই তো চলিয়া আসিছে।’ দ্রুত চুমুকে চা-টা শেষ করে বাইরে বেরুতে যাবার পথেই দেখা হয়ে যায় এনজিও কর্মকর্তাদের সাথে। দু পক্ষই সমান বিরক্ত হয় এই মুহূর্তের সাক্ষাৎ। এনজিও কর্মকর্তারা ক্ষোভ ঝাড়ে- বাব কী কষ্ট করে আসতে হলো আজ, রাস্তাঘাট সব বন্ধ। ঘটনা কী রে রূপালী। সমান ক্ষোভেই রূপালী উত্তর দেয়- আর আছার টাইম নাই পাইলি! আজ ওখানে ছমাবেছ হচ্ছে। কিসের সমাবেশ- এনজিও কর্মকর্তা কৌতূহলী হয় একটু। সেই কৌতূহলে আরো খেপে ওঠে রূপালী- ‘এখন এত্তো কিছু কওয়ার টাইম তো নাই, টাকা লিয়া বিদায় হ দিকিন। ওই যে জমিন দেখছিস, ওটার ফসলে দুবেলা খাবার তো জুটে, মজুরির টাকা তো ছব তুরাই নিয়ে নিস, সেই কবে গাই কিনে ঋণ নিছিলাম, কিস্তি তোদের ফুরায় না। এখন ছুনি সরকার ওখানে ইকোনমি জুন বানাবে। হাছপাতাল করবে, ফ্যাক্টরি করবে...’ রূপালী বিড়বিড় করে রাগে। এনজিও কর্মকর্তা না সরকার- রাগটা ঠিক কার ওপর বোঝা যায় না। রাগের আগুনে ঘি ঢালে তারা- ভালোই তো তোদের ভালো চাকরি হবে, ভালো চিকিৎসা হবে। মুখের বিড়বিড়ানি এবার মুখ ঝামটায় রূপ নেয়- ‘উ হামার ঢের জানা আছে। চাকরি দিবার নাম করে জমিগুলান নিবে, তারপর মোদের আর নাই চিনিবে। ছব বাবুদের আমার হাড়ে হাড়ে চিনা আছে। ছে ফ্যাক্টরির বাবু বল আর কোম্পানির বল।’ রূপালীর বলার ভঙ্গিতে কর্মকর্তা দুজন চুপ মেরে যায়। ওরা খেপে গেলে মুশকিল। গোঁয়াড়ের মতো এক কথা এক শবার বলবে। বছর খানেক ধরে ঋণের কিস্তি নিতে এসে বেশ চেনা হয়েছে এদের। তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পাল্টায় একজন কর্মকর্তা- আচ্ছা শোন আজ থেকে নতুন বাবু আসবে টাকা নিতে। সে আসছে আমাদের পিছনেই, বোধ হয় কোথাও আটকেছে। এক্ষুনি এসে পড়বে। যা তুই সমাবেশ সেরে আয় আমরা একটু অপেক্ষা করি। নতুন বাবুকে তোদের চিনিয়ে দিয়ে যাবে।

 

 অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

 

জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ আসে

সেদিন বাগানের টিলায় টিলায় ঘুরে কাজে মন লাগে না টিলাবাবুর। মেয়েটার মায়াভরা মুখ আর জল টলমলে চোখ সারাবেলা তাকে মোহগ্রস্ত করে রাখে। চুম্বকের মতো অনিবার্য আকর্ষণ তার গড়বড় করে বলে যাওয়া কথাগুলোর। নিজের সাথে নিজেই দ্বন্দ্বে জড়ায় সে। শহরের পড়ালেখা করা জীবনটা খুব পছন্দের মেয়েটার, খুব আক্ষেপের তার অসমাপ্ত শিক্ষাজীবন। আচ্ছা সে কী পারে মেয়েটাকে তেমন একটা জীবন ফিরিয়ে দিতে- মর্যাদা দিয়ে? ভাবনার অন্তরালে গোপন ইচ্ছাটা শনাক্ত করে ভয় লাগে তার। দূর এটা কী করে সম্ভব? কিন্তু সব অসম্ভব বাস্তবতা জেনেও প্রবৃত্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে টিলাবাবু। দুপুরের সূর্য ঠিকঠাক মাঝ আকাশে যাবার আগে আগেই সেদিন বাসায় ফিরে টিলাবাবু। চারপাশ সুনসান, নাম জানা-না জানা অসংখ্য পাখিদের সম্মিলিত কলরব, গনগন আগুনের পাশে রান্নারত মেয়েটিকে এই ধেয়ে আসা দুপুরের রঙে অপূর্ব অপার্থিব লাগে টিলাবাবুর। চুলার ধার থেকে মেয়েটিকে টেনে বুকে তুলে আনে সে। মেয়েটি পূর্ব অভিজ্ঞতার তিক্ততায় প্রথম হাত-পা ছুড়ে কিন্তু টিলাবাবুর স্পর্শে কেমন মমতা আর নির্ভরতার ছায়া খুঁজে পায় মেয়েটি, যখন টিলাবাবু বলে- তোকে আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবার ব্যবস্থা করে দেব রে। নিশ্চিত এটাই মেয়েটির দুর্বলতম জায়গা, যেখানে হাত রাখে টিলাবাবু। মেয়েটি গলে যায়। না ধীরে ধীরে সলতে ছুঁয়ে  জ্বলতে থাকা মোমের মতো নয়। চুলার পাশে ভুল করে রাখা মোমবাতির মতো দ্রুত। টিলাবাবুর বিছানায় তার অনভিজ্ঞ শরীরের চাপে অদ্ভুত ভালোলাগায় মিশে যেতে থাকে মেয়েটি। ম্যাট্রিক পাসের স্বপ্ন, অন্য একটা জীবনের স্বপ্ন তার ব্যথাতুর শরীরের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু টিলাবাবুর কেমন গা ঘিনঘিন করে মোহগ্রস্ততার ঘোরের আগুন নিভে যাবার পর। মেয়েটির শরীরে, নাকের নিচে, ঠোঁটের ওপরে শরীরের কোনায় কোনায় জমে থাকা ঘামের দুর্গন্ধ তাকে বিপর্যস্ত করে রাখে অনেকক্ষণ।

 

দিন কয়েক পরে মেয়েটি নিজেই মুখ খুলে- হামারে একটা ছাবান কিনিয়া দে না টিলাবাবু। চুলার কাছে ছারাদিন বছে বছে ভীষণ গান্ধা লাগে রে। টিলাবাবুর হুঁশ হয়। সত্যি তো এটা তো তার মাথাতেই আগে আসার কথা ছিল। সেদিন সাবান দিয়ে গোসল করে মেয়েটি যখন কাছে আসে, নিজেকে গার্হস্থ্য পুরুষ লাগে টিলাবাবুর, পাশে শোয়া মেয়েটিকে বোধ হয় নবপরিণীতা আহ্লাদি বউ। প্রথমবার পাপবোধ নয়, দাম্পত্য সুখের স্বাদ তার মিলনকে মধুর করে তোলে। সেদিন প্রথম পরপর দুবার পুরুষ হয় টিলাবাবু।

 

রূপের গোপন রহস্য, বিজলী মার্কা সাবান

আব্দুল খালেক গভীর রাতে যখন সাবানের মোড়কটা উল্টে পাল্টে দেখে, গন্ধ শুঁকে। তখন ফজিলা বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে শোয়। বিয়ের চার বছরের মাথায় যখন বোঝা গেল তাদের বাচ্চাকাচ্চা হচ্ছে না, তখন থেকেই শুরু হয়েছে উৎপাত। দুদিন পরপর নিত্যনতুন সাবান নিয়ে হাজির হয় আর রাতে বিছানায় যাবার আগে গোসল করতে বাধ্য করে। কেন করায়, কী বৃত্তান্ত জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তর নেই। শীত-গ্রীষ্ম একই অবস্থা। মাঘ মাসের শীতে গরম পানিতে বালতি ভরে রাখতে হয়। আব্দুল খালেক সাবানের মোড়কটা খুলতে খুলতে বিড়বিড় করে- এইডা এক মুশকিল, হাবানের উফকারিতা গতর অ না মাখলে টিক বুঝা যায় না। ফজিলা এই ভূমিকার উদ্দেশ্য বুঝতে পারে। এত্তো রাইত্তে আইজকা গোসল করতে খইবাইন না- ফজিলা মুখ ঝামটা দেয়। বউয়ের পাশে বসে মাথায় হাত বুলায় অসহায় আব্দুল খালেক- বুঝঅ না কিতার লাগি, ঘর অ কি অশান্তি ক ও, আরেখডা বিয়ার লাগি আম্মার ফ্যানফ্যানানি শুনতে তোমার বালা লাগে না আমার? আব্দুল খালেকের মিষ্টি কথায় মোটেই পটে না ফজিলা, খেপে ওঠে- তুমারে খোন ফীরে খইছে নিত্য নয়া হাবান দি গোসল করলে বাইচ্ছা ফয়দা অইবো? খোন ফিরে খইছে, আইজখা খওন লাগবো। বাইচ্ছা-খাইচ্ছা অয় না, ইখান ত আল্লার ইচ্ছা। ডাখতর-খবিরাজ ত কম দেখাইরাম নায়। হাবান দি গোসল করনের ইখিতা বাতিখ তুমার, কত্তোদিন জিগাই, হাছা মাত মাত না খেনে? বাচ্চা না হওয়ার অক্ষমতায় আড়ষ্ট হয়ে থাকা নিরীহ ফজিলার হঠাৎ অগ্নিমূর্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে আব্দুল খালেক। আজ আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, মশারির ভিতরে ঢুকে চুপ করে শুয়ে পড়ে সে। আব্দুল খালেক জানে যত রাগ করুক নারীমন তো, ঠিক আজ না হয় কাল নতুন সাবান দিয়ে গোসল সেরে স্বামীর সাথে শুতে আসবে, বলা তো যায় না আল্লা ইচ্ছায়...

 

পৃথিবীতে কে কাহার?

টিলাবাবু বারবার ঘড়ির দিকে তাকায়। আটটা বেজে গেছে।  একটু পরেই বের হতে হবে তাকে। সুখেনের মেয়েটা এখনো আসেনি। ভোর ছটায় আসে যে মেয়ে, আজ তার হলো কী, অস্থির লাগে তার। অস্থিরতার অবসান ঘটিয়ে বেলা নয়টার দিকে, মেয়েটি বাসার পিছন দিয়ে ঢোকে। আনম্র লজ্জায় লাল হয়ে টিলাবাবুর সামনে দাঁড়ায়। ঘটনা কী? মেয়েটি জানায় সে পোয়াতি হয়েছে- ‘হিছাব কইরে দেখছি পাঁচ হপ্তার গর্ভ রে টিলা বাবু। যেইদিন তুই ছাবান কিনিয়া আনলি ছেইদিন।’ ঘটনার আকস্মিকতায় ভ্যাবাচ্যাকা খেতেও ভুলে যায় টিলাবাবু। কী বলতে হয়, কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। মেয়েটি বলতেই থাকে- ‘বাপ ভীষণ খেইপেছে রে বাবু, তুর ইখান আর কাম করিতে নাই দিবেক।’ এবার বিছানায় বসে মেয়েটি নির্বিকার আবদার জানায়, যেন তার স্বতসিদ্ধ অধিকার- ‘তুর বাড়িত হামাকে কুনদিন লয়ে যাবি ক।’ গলায় তার আশঙ্কা ঝরে- ‘বেছি দেরি করিলে মা খালাছ করিয়া দিবে কিন্তু ক। তুর ছাও হামি খালাছ করিতে পারিব না রে বাবু।’ মেয়েটির নিরপরাধ-নিষ্পাপ আবেদনের সামনে ঘামতে থাকে টিলাবাবু। সম্পূর্ণ অচেনা এক সংকটে দিশেহারা লাগে তার। ঠিক তখন বাইরে সুখেনের গলা শুনা যায়- ‘দাদাবাবু বাড়ি আছিস নাকি রে, দাদাবাবু...।’ বাপের গলা শুনে দৌড়ে আবার যাবার পথ ধরে মেয়েটি বাড়ির পিছন দিয়েই। ঘরে ঢুকেই প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ে সুখেন যা বলে তার মর্মার্থ এই যে- গরিব বলে তার কী ইজ্জত সম্মান নেই, ঘটনার কথা পঞ্চায়েতকে জানানো হয়েছে। তারা আজ সন্ধ্যায় নাটমন্ডপে সালিশ ডেকেছে। সে যেন উপস্থিত থাকে। সর্দারও লোক পাঠাবে খবর জানিয়ে। ক্ষোভে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে করতে সুখেন চলে যাবার পর হুঁশ হয় টিলাবাবুর। আধ ঘণ্টা খানেক সময় নেয় সে সিদ্ধান্ত নিতে। এসব চাকরিবাকরি, চলতি মাসের বেতন, শরীরী প্রেম- প্রেমের ফসল সব পিছনে ফেলে সাথে করে নিয়ে আসা একমাত্র ব্যাগটি আবার সাথে নিয়ে গঞ্জের গাড়িতে উঠে বসে সে চিরতরে।

 

লইড়তে হইলে লইড়বো, মইরতে হইলে মইরবো

স্লোগানের উত্তাপ বাড়তে থাকে। শহর থেকে, রাজধানী থেকে সাংবাদিক, মিডিয়াকর্মী, সমাজকর্মী, এনজিও কর্মী উৎসুক জনতায় জনারণ্যে পরিণত হয় পুরো বাগান। মাইল মাইল দূর থেকে শোনা যায় শ্রমিকদের সম্মিলিত স্লোগান- ‘লইড়তে হইলে লইড়বো, মইরতে হইলে মইরবো।’ গলা ফাটিয়ে স্লোগানে তাল মিলায় রূপালী। মগের মুল্লুক নাকি দেশটা? কয়েক পুরুষ ধরে জমিতে চাষ করছে তারা। আজ সরকার বললেই সেটা সরকারি হয়ে যাবে? হঠাৎ পিছন থেকে ঘাড়ে হাত রাখে কেউ, রূপালী ফিরে তাকায়। এনজিও কর্মকর্তা ডাকেন- ‘একটু উঠে আয়, নতুন বাবুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। ওর কাছেই কিস্তির টাকা দিবি এখন।’ সমাবেশ ছেড়ে ওপরে টিলায় উঠে আসে রূপালী। নতুন বাবুকে দেখে চমকে উঠে সে- টিলাবাবু তুই!! আব্দুল খালেকও বিস্মিত- তুই এখানে রূপালী? এনজিও কর্মকর্তারা অবাক- আপনারা দুজন পরিচিত নাকি? আব্দুল খালেক শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। এখন তাদের সাথে অতিরিক্ত কথা বলার সময় নেই। অনেক, অনেক খবর নিতে হবে তার। রূপালীকে টেনে আড়ালে আনে আব্দুল খালেক- ‘তোর এখানে বিয়ে হয়েছে রূপালী? বাচ্চা কয়টা তোর।’ এসব পারিবারিক ব্যক্তিগত আলাপে খুব আগ্রহ নেই রূপালীর। কোমরে গুঁজা টাকাটা আব্দুল খালেকের হাতে তুলে দিয়ে আঙুল তুলে বাড়িটা দেখায় সে- ঐ যে হামার বাড়ি, ছাওয়ালরা আছে দেখে যা। রূপালী নেমে যায় বৃহত্তর প্রয়োজনের আয়োজনে, কোথায় সেই নতুন যৌবনের অবাস্তব স্বপ্ন? ভীষণ বাস্তবের মুখোমুখি অতীতটা খুব মূল্যহীন ওর কাছে। আব্দুল খালেক টের পায়।

 

তবু আব্দুল খালেক মনে ক্ষীণ আশা নিয়ে নেমে যায় রূপালীর বাড়ির দিকে। উঠোনেই খেলছে যমজ বাচ্চা দুটো। বোকার মতো ক্ষীণ আশায় এদিক সেদিক তাকায় আব্দুল খালেক, কিসের আশায়- আশার গভীরে যেতে যেতে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে সে অপরাধে- অপরাধবোধে। হঠাৎ ঘরের দাওয়ায় রাখা সাবানের কৌটোটি চোখে পড়ে আব্দুল খালেকের, কোনো সংকোচের ধার না ধেরে কৌটোটি হাতে নেয় সে, নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুঁকে, সেই অপূর্ব দিনটির গন্ধ খুঁজে পায় আব্দুল খালেক। রূপালী বলেছিল ওর বাচ্চা নষ্ট করতে চায় না সে। রূপালীকে ডাকতে ইচ্ছে হয় তার কিন্তু রূপালীর গলা তখন স্লোগানে উচ্চারিত- ‘লইড়তে হইলে লইড়বো, মইরতে হইলে মইরবো।’ এখন গলা ফাটিয়ে ডাকলেও রূপালী শুনবে না।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জুন ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়