ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

লাল সবুজের মেলা || রফিকুর রশীদ

রফিকুর রশীদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২০, ১২ এপ্রিল ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
লাল সবুজের মেলা || রফিকুর রশীদ

ছবি : সংগৃহীত

এক.
প্রজাপতিটা অনেকক্ষণ থেকেই ঘুরছে।
নানা রঙের কারুকাজ খচিত পাখা মেলে উড়ছে। সেই সকাল থেকে উড়ছে। বাগানের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে সারা। কোথাও দু’দণ্ড স্থির হয়ে দাঁড়ায় না। কেবল ঘুরে বেড়ায়। কেবল পাখা নাড়ায়। সকালের সোনারোদ পড়ে ঝিলমিল করে ওঠে তার পাখা। একবার চোখে পড়লেই ঝলসে যায় চোখ। বাগানের ফুলেরা হেসে ওঠে। পাঁপড়ি মেলে আদরমাখা গলায় আহবান জানায়,
এসো ভাই প্রজাপতি, আমার কাছে এসো!
চোখ মেলে তাকায় প্রজাপতি, কিন্তু ফুলের কথা শোনে কি শোনে না সেটা ঠিকমতো বুঝা যায় না। পাখা মেলে উড়ে যায়। রাতজাগা রজনীগন্ধার অভিমান হয়। ঘাড় দুলিয়ে অভিমান করে,
আসবে না আমার কাছে!

প্রজাপতি তখন অনেক দূরে। হাস্নাহেনার ঝাড় তাকে ডাকছে হাতছানিতে। না না, শুধু হাস্নাহেনা হবে কেন, তাকে ডাকছে তো অনেকেই। গোলাপ, যুঁথি, টগর, চামেলি- সবাই ডাকছে। এমন কি কেউ কেউ প্রজাপতির মন ভোলাবার জন্যে সেই পুরানো গানটা পর্যন্ত গাইছে- ‘প্রজাপতি প্রজাপতি, কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা...।’
না, আজ সে গানের সুরে মোটেই ভোলে না। এক নিমিষের জন্যে কোথাও যদি বা দাঁড়ায়, পরক্ষণেই উড়ে যায়। টুকটুকে লাল নীল ঝিলিমিলি ছবি আঁকা রঙিন পাখা মেলে সে ঘুরে বেড়ায় সারা বাগান। আজ সকাল থেকেই তার মনটা খুব চঞ্চল। তার মন বলছে, খুব নিকটেই কোথাও একটা বড় কিছু ঘটছে, বা ঘটতে চলেছে। কী সেই ঘটনা, তা সে জানে না। তবে সকাল থেকেই সে গোয়েন্দার মতো গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঘুরে ঘুরে চলেছে। উড়ে উড়ে চলেছে। কোথাও যদি সামান্য ক্লু খুঁজে পাওয়া যায়!
আসলে কান্ডটা ঘটছে কী এমন?

প্রজাপতি ভাবে, তার সাথে ওই লম্বা ঠ্যাংঅলা ফড়িংয়েরই বা কী সম্পর্ক?
হ্যাঁ, আজ সকালে ঘুম ভাঙবার পর সেই ফড়িংটার সঙ্গেই তার প্রথম দেখা। স্বাস্থ্য যতোই মোটা তাজা হোক, নির্ঘাৎ ওটা ঘাসফড়িংই হবে। শিশির ধোয়া সকালে সে যেন বা স্নান করে উঠেছে। গায়ের রং কী যে টলটলে সবুজ! এমন গাঢ় সবুজ রং বুঝি আর হয় না। প্রজাপতি দেখতে পায় এমন ঘন সবুজ রং দেখে লাল ঠোঁটের এক সবুজ টিয়ে পাখি লজ্জায় গাছের খোঁড়লে মুখ লুকায়। বাব্বা, ওই সবুজ ফড়িংটার কী যে এমন ব্যস্ততা! গাছের টিয়েপাখি কিংবা উড়ন্ত প্রজাপতির দিকে তার ফিরে তাকাবারও যেন সময় নেই। লম্বা লম্বা ঠ্যাং উঁচিয়ে সাতসকালে মেতে উঠেছে দৌড়োদৌড়িতে। প্রজাপতি দু’পাখা নাড়িয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
ও ভাই ফঙিং! সকালবেলা কিসের এত ছুটোছুটি?

সামনের দু’পায়ে ভর দিয়ে ফড়িং লাফিয়ে ওঠে। প্রজাপতি তবুও অনুনয় করে,
দাঁড়াও না শুনি কিসের এমন ব্যস্ততা!
কথা না বলে ফড়িং শুধু আড়চোখে একবার চেয়ে দ্যাখে। প্রজাপতি ডাকে, অ ফড়িং ভাই!
এবার মুখ খোলে প্রজাপতি। রেগে মেগে বলে, ফড়িং নয়, বলো ঘাসফড়িং। সবুজ ঘাসপাতা পছন্দ হয় না তোমাদের?
অ মা! পছন্দ হবে না কেন! খুব পছন্দ হয়। কিন্তু তোমাদের হয়েছেটা কী?
কী আবার হবে! আমরা জমায়েত হব।
তার মানে? মিটিং মিছিল করবে নাকি?
আরে ধ্যাৎ!
না না, পুব পাড়াতেও দেখলাম- বেশ কটা ফড়িং...
আবার ফড়িং! বলো ঘাসফড়িং!
সরি!

ফড়িংটা রাগেরাগেই বলে- ‘আমরা পতাকা হব।’
তারপর উত্তেজিত ভঙ্গিতে লাফাতে লাফাতে কোথায় যেন চলে যায়। সেই তখন থেকে প্রজাপতির ভাবন হয়- বলে কী ফড়িংটা! পতাকা হবে মানে! কিসের পতাকা, কেমন পতাকা! ফড়িংয়েরও শখ ভালো!

দুই.
বেলা বাড়তে বাড়তে ওরা সবাই বেশ গুছিয়ে যায়। গুছিয়ে যায় মানে একত্রে জড়ো হয়। বেলা তখন কত? বড়জোর দশটা। মাথার উপরে মেঘমুক্ত আকাশের সূর্য। ঝকঝকে রোদ্দুর। আকাশটাই যেন বা রোদ ঝল্মলে শামিয়ানা। যা হোক সেই দিগন্ত বিস্তৃত সামিয়ানার তলে রাজ্যের যতো ঘাসফড়িং হয়েছে একত্রিত।
সারা বাগান ঘুরতে ঘুরতে প্রজাপতি এই পুব প্রান্তে এসে ওদের দেখে অবাক হয়ে যায়। দুটো চারটে ঘাসফড়িংয়ের সঙ্গে প্রতিদিনই তার দেখা হয়। কিন্তু এতোগুলো ঘাসফড়িং এক সঙ্গে দেখার এমন চমৎকার সুযোগ তো আগে কখনো হয়নি। ভারি ভাবনা হয়- এরা সবাই কি এই বাগানেরই বাসিন্দা? নাকি বাইরে থেকেও এসেছে কেউ কেউ? অনেককেই তার বেশ মুখ চেনা মনে হয়। ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখে প্রজাপতি।

হ্যাঁ, সবার চেহারাতেই খুব মিল আছে, সবাই যেন অনেকদিনের চেনা। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে আজ ওরা যেন কেউ তাকে চিনতেই চাইছে না। সবাই খুব ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। কিসের যে এই ব্যস্ততা সেটা কিছুতেই বুঝতে পারে না সে। নেতা মতো সেই লম্বা ঠ্যাংঅলা ঘাসফড়িংটা চারিদিকে ঘুরে ঘুরে কী যেন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, মাঝেমধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ছে, দলের অন্যান্য ফড়িংদের কী সব নির্দেশ দিচ্ছে। সেই নির্দেশ শুনে কিছুটা চঞ্চল হয়ে উঠছে ঘাসফড়িংয়েরা। সামরিক কায়দায় সামনের পা উঁচু করে কেউএগিয়ে আসে, কেউ পিছিয়ে আসে, কেউবা পাশের ফড়িংটির কাঁধের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে সমতা আনে। চমৎকার এক সুশৃঙ্খলভাব সবার মধ্যে। কিন্তু এসব হচ্ছেটা কী?

প্রবল কৌতূহল জাগে প্রজাপতির মনে। ঘাসফড়িংয়ের এই বিশাল জমায়েতের একেবারে শেষের দিকে সে চুপ করে নেমে পড়ে। তাকে দেখে ঘাস উল্টিয়ে তাকায় হাল্কাদেহী এক ঘাসফড়িং। প্রজাপতি সোজাসাপ্টা তাকেই আঁকড়ে ধরে,
আমাকে তোমাদের সঙ্গে নেবে ভাই?
ঘাসফড়িংটা বলে,
না না, সেটা কী করে হবে!
কেন, কেন?
আহা, তুমি তো আর আমাদের মতো সবুজ নও!
সবুজ না হোক, আমার পাখায় পাখায় কত রঙ কত কারুকাজ...

না, তবুও না। আজ আমাদের লাল সবুজের মেলা। এখানে অন্য রং চলবে না যে!
তাই! আমার এত রং, তবু কাজে লাগবে না?
ঘাসফড়িংটা বিরক্ত গলায় বলে,
বলছি তো এটা লাল সবুজের মেলা। অনেক রঙ কী হবে!
প্রজাপতির মনে খুব দুঃখ হয়। এতদিন বহুজনের মুখে বহুরকম প্রশংসা শুনে এসেছে। প্রজাপতির সৌন্দর্য নিয়ে কত রকম গান-কবিতাও শুনেছে। কিন্তু আজ সে তার ঘাটতির দিকটা টের পায়। নিজের চেহারা যতোই সুন্দর হোক, এদের এই সবুজের বন্যায় তা যেন ভেসে যায়, তলিয়ে যায়। না, শুধু সবুজ হবে কেন, ওই যে রক্তলাল গোলাপ আছে মাঝখানে। ছোট্ট একটুখানি গাছে ফুটেছে বটে সূর্যের মতো গোলাকার এক রক্ত গোলাপ। সেই লাল বৃত্তকে ঘিরে ওই ঘাসফড়িংয়েরা ঘন হয়ে সুশৃঙ্খলভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছে। ফলে এ এক অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে।

প্রজাপতিটি উড়তে উড়তে এক নজরে ভালো করে দেখতেই এতক্ষণে আবিষ্কার করে- এ যে দেখছি বাংলাদেশের পতাকা হয়ে গেছে! তার মানে- ওরাও কি গিনেস বুকে নাম তুলতে চায় নাকি! এই তো কদিন আগে ঢাকায় রচিত হলো মানবপতাকা। পতাকা হাতে সমবেত হয়েছিল ২৭ হাজার মানুষ। তাই বলে এরা কি ফড়িং পতাকা তৈরি করতে চায়!
উড়ন্ত হেলিকপ্টারের মতো করে পাখা মেলে খুব ভালো করে তাকায় প্রজাপতি। চোখ জুড়িয়ে যায় পতঙ্গপতাকার সৌন্দর্যে। আহ্ কী অপরূপ সবুজের ঢেউ! মাঝখানে লাল গোলাপ। কিন্তু অসাধারণ এই পতাকার কথা কোন গিনেসবুকে লেখা হবে? ওরা কিছুতেই দলে নেয়নি বটে, তবু অসাধারণ এই লাল সবুজের মেলা থেকে কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারে না রঙিন প্রজাপতি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ এপ্রিল ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়