ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শোভনের স্বপ্ন

মো. রহমত উল্লাহ্‌ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৪, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শোভনের স্বপ্ন

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

|| মো. রহমত উল্লাহ্‌ ||  

কাগজ কুড়াতে কুড়াতে ক্লান্তি আসে শোভনের। পিঠের ওপর বস্তা নিয়ে আর কতক্ষণ নুয়ে নুয়ে হাঁটা যায়। ব্যথা হয়ে গেছে ঘাড়- পিঠ-কোমর-হাঁটু! সেই দুপুর থেকে কাগজ কুড়ানো শুরু। মাত্র অর্ধেক হয়েছে বস্তা। আগের মত এখন আর পাওয়া যায় না কাগজ। পলিথিনে বাজার করে সবাই। ছেঁড়া কাগজের দামও অনেক কম। কোত্থেকে যে আসে এত টোকাই!

তারা আগে আগেই কুড়িয়ে নিয়ে যায় সব কাগজ। কখন ভরবে এই বস্তা। অর্ধেক বস্তা কাগজ নিয়ে ফিরে গেলে, মা খাবার দিবেন না রাতে। দ্রুত হাত-পা চালায় শোভন। ক্ষুধা ও পিপাসায় শুকিয়ে যায় বুক। ঘন হয়ে ওঠে শ্বাস-প্রশ্বাস। গায়ের ময়লা চামড়া বারবার ঢুকে যায় বুকের হাড়ের ফাঁকে ফাঁকে। কাঁপতে থাকে হাড়সর্বস্ব হাঁটু। কোসা নৌকার মত শুয়ে পড়ে পার্কের পাকা বেঞ্চিতে। সামান্য ব্যথা পায় পিঠের হাড়ে। তথাপি শুয়ে থাকে কষ্ট করে। ধীরে ধীরে সোজা হয় শিরদাঁড়া। সামান্য আরাম লাগে পিঠে। টান পড়ে পেটে; যেন এখনই ছিঁড়ে যাবে খোলের চামড়া। বেড়ে যায় ক্ষুধার আগুন! এতক্ষণ নুয়ে ছিল বলে মনে হয় ক্ষুধার জ্বালা টের পায়নি এতটা। শোভন হাত-পা ছেড়ে শুয়ে থাকে চোখ বন্ধ করে।
 
শুয়ে শুয়ে সে ভাবে, এর চেয়ে গ্রামেই সে অনেক ভালো ছিল।  থাকা-খাওয়ার কোন অসুবিধা ছিল না মতি কাকার বাড়িতে। ভাত দিত তিন বেলা। কাজ বলতে ছিল কয়েকটি গরু চরানো। প্রতিদিনই সুযোগ পাওয়া যেত খেলার। গলা ছেড়ে গাওয়া যেত গান। কেন যে এই বস্তিতে চলে এলেন মা, আজো বোঝেনি শোভন। মনে আছে মায়ের সেই কথা-‘চল বাবা, এখানে আর থাকা যাবে না। এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।’
মুখে পানির ছিটা লেগে ছন্দপতন হয় শোভনের ভাবনায়।
 
চোখ খুলেই দেখে একগাল হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কনক। পালিয়ে যায় সব ক্লান্তি-কষ্ট। চট করে উঠে বসে শোভন। কনকের হাত থেকে টেনে নেয় পানির জগ। গড়গড় করে পান করে দুই গ্লাস পানি। অর্ধেক পাউরুটি বাড়িয়ে দেয় কনক- ‘নেও একজনে দিছে।’
শোভনের ছোট বোন কনক। পানি বিক্রি করে পার্কে। অর্ধেক পাউরুটি ভাগ করে খায় ভাই-বোন।
‘এই টুক্ কাগজ টোকাইছ মাত্র! মজা বুঝবানে রাতে!’ শোভনকে মায়ের বকুনির ভয় দেখায় কনক। চিপ দিয়ে ওঠে শোভনের বুকের ভিতর! বলে, ‘কনক, কিছু কাগজ টোকাইয়া দে না আমার লগে।’ ঘাড় নাড়িয়ে না করে কনক। তারপর ‘এই পানি, ঠান্ডা পানি ’ বলতে বলতে ছুটতে থাকে সে।  
 
আবার কাগজ কুড়াতে শুরু করে শোভন। লজ্জা লাগে কাগজ টোকানি। এর চেয়ে ভালো হতো টেম্পুর ভাড়া কাটা। প্রতিদিনই পাওয়া যায় নগদ টাকা। চালকও হওয়া যায় এক সময়। কিন্তু পরিচিত বড়লোক না থাকলে পাওয়া যায় না টেম্পুর কাজ। অথচ সেই পরিচিতরাও মেরে দেয় টাকা। সে নিজেই দেখেছে একদিন। পার্কে যাচ্ছিল টেম্পুতে করে। ভাড়া কাটছিল তার সমান একটি ছেলে। খুব খেয়াল করছিল শোভন, কীভাবে করতে হয় এই কাজ। ছেলেটি বার বার ভাঁজ করছিল দশ টাকার একটি নোট। হঠাৎ ঢুকিয়ে দিয়েছে হাফপ্যান্টের গোপন পকেটে। সেই ছেলেটির প্রতি এখনো রয়ে গেছে শোভনের ঘৃণা।

শোভন দ্রুত কাগজ কুড়াতে থাকে।  পেয়ে যায় বেশ ক’টি খালি বোতল। অনেকটা ফুরফুরে হয় মন। সন্ধ্যার আগেই পুরো হয়ে যায় বস্তা। আনন্দে ভরে ওঠে বুক! ফিরে যায় বস্তির দিকে।             
বিশাল আবাসিক এলাকা। পাকা রাস্তার সমনেই একটি স্কুল। কোন মাঠ নেই। এই রাস্তাটুকুই দালানবাসীর হাঁটা-চলা ও খেলাধুলার জায়গা। রিকশা সাইকেল চালায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে। এখানে এলে শোভনের খুব ভাল লাগে। সময় পেলেই সে আসে এখানে। বসে থাকে একা একা। বস্তিতে থাকে বলে অংশ নিতে পারে না খেলাধুলায়। অন্য দিনের চেয়ে বেশি ভালো লাগে আজ। অনেক সুন্দর মনে হয় সাইকেলগুলো! একেকটা একেক রকম! একটার চাকা পিচঢালা রাস্তার মত কালো। জিহ্বার মত লাল অন্যটির টায়ার। নারিকেল পাতার মত সবুজ কোনটার প্যাডেল। সিটের রং যেন কুটুমপাখির মতো হলুদ। ক্রিং ক্রিং, টুং টাং শব্দ করে ছুটছে সাইকেল। অপলক তাকিয়ে আছে শোভন।

দেখতে দেখতে মনে হয় সে নিজেও চালাচ্ছে একটি। প্রতিযোগিতায় নেমেছে শোভনের সমবয়সী তিনজন। নিজেকেও প্রতিযোগী ভাবছে শোভন। সাইকেল নিয়ে ছুটছে মনে মনে। কার আগে যেতে পারে কে। প্যাডেল চালায় সে দ্রুত। নিজেকে কল্পনা করে সবার আগে। যখন যে সাইকেল আগে থাকে, তখন সেই সাইকেলের চালক মনে হয় নিজেকে। রাস্তার এ মাথায় আর ও মাথায়।  চলতে থাকে যাওয়া আসা। ক্রিং ক্রিং, ক্রিং ক্রিং। ঘুরে আসে কয়েক বার।

হঠাৎ মনে হয়, সাইকেল চড়ে স্কুলে যাচ্ছে সে! পরনে আকাশি শার্ট ও নেভি ব্লু প্যান্ট। পিঠের ওপর বই-খাতা ভর্তি ব্যাগ। টিফিন বক্সে ডিম-পরোটা ও কলা। নিজেকে কল্পনা করে ক্লাসের ফার্স্ট বেঞ্চের ছাত্র। সবার আগে বলতে পারে পড়া। করতে পারে অঙ্ক। অনেক আদর করেন স্যারেরা। খেলায় ডেকে নেয় বন্ধুরা।
 
মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসে মাগরিবের আযান। রিকশা সাইকেল নিয়ে সবাই চলে যায় যার যার বাড়ি। বন্ধ হয়ে যাওয়া গেটের বাইরে থমকে দাঁড়ায় শোভনের অপলক দৃষ্টি !



লেখক : অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়