ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

স্মৃতির শহর পিরোজপুর || আহসান হাবীব

আহসান হাবীব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৬, ২৮ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
স্মৃতির শহর পিরোজপুর || আহসান হাবীব

বাবার নামে সড়কের নামফলকের সামনে আহসান হাবীব

এই তো কিছুদিন আগে প্রায় পনের-ষোল বছর পর গিয়েছিলাম পিরোজপুর শহরে। পিরোজপুর হচ্ছে আমার শৈশবের আনন্দ-বেদনার শহর। সেই ’৭০ সালে পিরোজপুর ছিল ছোট্ট একটা মহকুমা শহর। আমার বাবা সেখানে এসডিপিও হয়ে বদলি হয়ে গিয়েছিলেন। আমার দাদা তখন বেঁচে ছিলেন। তার বয়স তখন ১০০ বছর। তিনি ছিলেন পীর টাইপের মানুষ। তিনি অগ্রিম অনেক কিছু বলে ফেলতে পারতেন। তিনি বাবার বদলির কথা শুনে বললেন, পানির দেশে ফয়জুর রহমানের বিপদ হবে, ওখানে না যাওয়াই ভালো। কিন্তু আমরা তখন সব ভাইবোন বাবা-মা মিলে একটা বিশাল লঞ্চে করে পানির দেশের উদ্দেশে ভেসে চলেছি। গন্তব্য পিরোজপুর।

 

সত্যি সেই সময় শহরটা ছিল ছবির মতো। হুলারহাট নামে একটা স্টিমার ঘাটে নামতে হয়, তারপর সাপের মতো মসৃণ আঁকাবাঁকা দীর্ঘ রাস্তা পার হয়ে মূল শহরে পৌঁছাতে হয়। রাস্তাটা এত সুন্দর যে এখনো চোখে ভাসে। ওই শহরে একটা মাত্র গাড়ি ছিল তখন। সেটা ভাড়া খাটে হুলারহাট টু পিরোজপুর শহর পর্যন্ত। কালো রঙের ভাঙাচোরা একটা মরিচ মাইনর গাড়ি। তখন মহকুমা পুলিশ অফিসারের বিরাট ক্ষমতা। আমাদের ছিল সুন্দর একটা বাড়ি, সামনে পুকুর। রাতের বেলা যখন আমাদের সেই প্রাচীন নকশাকাটা বাড়িটার ছায়া পড়ত পুকুরের শান্ত জলে তখন মনে হতো যমুনার জলে তাজমহল ভাসছে (যদিও তখনো যমুনা বা তাজমহল কিছুই দেখিনি)। বড় ভাই বলত ‘পিরোজপুরের তাজমহল’।

 

বড় ভাইবোনেরা সবাই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, ছুটি ফুরোলেই তারা হলে চলে যেত। বাড়িতে ছোট বোন আর আমার একচ্ছত্র দাপট। আমি যখন বাড়ি থেকে বের হতাম। তখন আশপাশে ফিসফাস শুনতাম ‘নতুন এসডিপিও সাহেবের ছেলে’ ‘নতুন এসডিপিও সাহেবের ছেলে’। আমার তখন ভাব বেড়ে যেত। আরো ছোটবেলায় যখন বগুড়া পিটি স্কুলে পড়তাম, তখন আমাদের ক্লাসে ডিসির ছেলে পড়ত। তার ছিল প্রচণ্ড ভাব। পিরোজপুরে এসে আমিও সে রকম প্রচণ্ড ভাব নিয়ে চলতাম। একবার রাস্তায় আমাকে দেখে হুলারহাটের দিকে যাওয়া সেই একমাত্র কালো মরিচ মাইনর গাড়ি হার্ড ব্রেক করে থেমে গেল। শুধু থেমে গেলই না, সব প্যাসেঞ্জারকে নামিয়ে দিয়ে আমাকে মোটামুটি জোর করে উঠিয়ে নিল। কেন? এসডিপিও সাহেবের ছেলেকে গাড়িতে করে একটু ঘোরানো যাক। কি জ্বালা!

পরে মা শুনে দিল ধমক, ‘তুই একা একা উঠলি কেন?’

‘আমার কি দোষ, ওরা এমনি এমনি গাড়িতে ঘোরালো যে।’

 

 বাবার কবরের পাশে লেখক

 

পিরোজপুরের গভর্নমেন্ট স্কুলে ভর্তি হলাম। বন্ধুবান্ধব জুটে গেল। এর মধ্যে বড় ভাই ছুটিতে এসে আমাকে পিরোজপুরের লাইব্রেরির মেম্বার করে দিল। স্কুলের পর বন্ধুদের সাথে ছোট্ট শহরটায় ইচ্ছেমতো ঘুরি আর সন্ধ্যা হলে লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে আসি (নিয়ম ছিল সপ্তাহে একবার বই নেওয়া যাবে। আমি প্রতিদিনই বই নিতাম। বৃদ্ধ হিন্দু লাইব্রেরিয়ান কিছু বলতেন না)। কী সুন্দর সব দিন তখন। মাঝে মাঝে বাবার বিশাল নৌকা করে এদিক ওদিক বেড়াতে যাই। বাবার একটা স্পিডবোটও ছিল, সেটাতে করেও বাবা-মায়ের সাথে বেড়াতাম মাঝে মাঝে। বিশেষ করে বড় ভাইবোনরা যখন ভার্সিটি থেকে ছুটিতে আসত, তখন মাঝেমধ্যেই পুরো পরিবার মিলে বিশাল নৌকায় করে বেড়ানো হতো। নৌকাটা ছিল মোটামুটি একটা একতলা বাড়ির মতো, টয়লেটও ছিল ওই নৌকায়। তিনজন মাঝি চালাত সেই নৌকা। আমরা মাঝে মাঝে নৌকার ছাদে বসেও দিব্যি হাওয়া খেতাম।

 

আমাদের সুখের দিনগুলো অবশ্য বেশি দিন থাকল না। ১৯৭১ সালের মে মাসের ৫ তারিখে একটা ফুল স্টপ বসে গেল। তছনছ হয়ে গেল আমাদের পরিবারটা। ওই দিনই পাকিস্তানি মিলিটারিরা বাবাকে হত্যা করল বলেশ্বরী নদীর ঘাটে।

 

পনের-ষোল বছর পর পিরোজপুরে গিয়ে আশ্চর্য হলাম। সেই ছবির শহর আর নেই। প্রচুর দালানকোঠা উঠে গেছে। আমাদের সেই তাজমহল এখন গাড়ির গ্যারেজ। পিরোজপুরে এখন এসি হোটেল আছে, চায়নিজ রেস্টুরেন্ট আছে। সেই পিরোজপুর আর নেই। একদিন হাঁটতে হাঁটতে গেলাম সেই ঘাটে, যেখানে আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছিল, সেটা এখন শহীদ মিনার, ‘শহীদ স্মৃতি ঘাট’। ঘাটে পৌঁছাতেই দু-একজন মাঝি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাকে সাহায্য করল। তারা মনে হয় বুঝেছে আমি কেন এসেছি। ঘাটে দাঁড়িয়ে আমার একটা স্মৃতি মনে পড়ল। একবার বাবা-মা, ভাইবোন সবাই আমাদের সেই নৌকায় করে বলেশ্বরী নদীর এই ঘাটের পাশ দিয়েই ফিরছিলাম। তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছিল, আমার লেখক বাবা নৌকার জানালায় গালে হাত দিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিলেন সূর্যাস্তের দিকে। তিনি হঠাৎ মাকে বললেন, ‘আয়েশা দেখ, নদীর ওপাশটা হচ্ছে জীবন আর এই পাশটা মৃত্যু’।  

 

 ছেলেবেলার স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে লেখক

 

বাবা যে পাশটায় মৃত্যু বলেছেন, সেই পাশেই তাকে হত্য করা হয়েছিল। বড় ভাইয়ের ভাষায় বলতে হয়...ফিনিক ফোটা জোসনায় বলেশ্বরী নদীতে তিনি ভেসে গিয়েছিলেন।

কি আশ্চর্য বাবা-মা, বড় ভাই এখন তারা সবাই স্মৃতি!

 

বাবার নামে একটা রাস্তা আছে এখন পিরোজপুরে। আমরা জানতাম না। তার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। আমার পড়া স্কুলটাও আগের মতোই আছে। আশপাশে অবশ্য নতুন কিছু বিল্ডিং গজিয়েছে। তবে শহর থেকে হুলারহাট ঘাট পর্যন্ত সেই রাস্তাটা অবিকল আগের মতোই আছে। হুলারহাট যাওয়ার সময় পথে কবরস্থানে বাবার কবর দেখতে নামলাম (এটা অবশ্য বাবার দ্বিতীয় করব। প্রথম কবর ছিল বহু দূরে এক নদীর পাড়ে)। কি প্রাচীন একটা কবর! সেখানে অস্পষ্ট অক্ষরে শ্বেতপাথরে লেখা আছে : নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে। বড় ভাই তার পছন্দের বাক্যটি লিখিয়ে এনেছিল। এখন সে-ও আমাদের নয়নে আশ্রয় নিয়েছে।

 

হুলারহাট ঘাটে গিয়ে দেখি খাঁ খাঁ করছে। এখন আর সেভাবে লঞ্চ-স্টিমার আসে না। কারণ, তার চেয়ে দ্রুত সময়ে ঢাকা থেকে পিরোজপুরে এসি বাস আসে। ঘাটের একটা নিচু ক্যাপস্টনের ওপর বসে তাকিয়ে দেখি চল্লিশ বছর আগের সেই নদী এখনো তেমনি আছে। ছোট ছোট ঢেউগুলো শব্দ করে একজন আরেকজনের ওপর ভেঙে পড়ছে। শুধু সেই প্রিয় মানুষগুলো নেই আশপাশে।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুন ২০১৬/এএন/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়