শিল্প ও সাহিত্য

তীব্র প্রেমবোধ আমাকে সর্বদা তাড়িত করেছে: নির্মলেন্দু গুণ

প্রেম এক অন্তহীন প্রক্রিয়া। পরস্পরের প্রতি আকর্ষণই সৃষ্টির মূল রহস্য। আমার তো সবাইকেই পেতে ইচ্ছা করে। শুধু যে নারীকে তা নয়, আমার যে কুকুরটি মারা গেছে আমার ভেতর তার জন্য প্রচণ্ড হাহাকার আছে। এরকম সবাইকে কেন্দ্র করেই আমার হাহাকার আছে। তবে এটা ঠিক, কবি হিসেবে ঘুরে-ফিরে নারীকে কেন্দ্র করে আমার যত রকমের অনুভূতি আছে, তার মধ্যে কামের অনুভূতিকেই সবচেয়ে আনন্দদায়ক সৎ-অনুভূতি বলে আমার মনে হয়। যদি বলা হয়, তুমি একটি অনুভূতিকে বেছে নাও। তাহলে আমি কিন্তু কাম-অনুভূতিটাকেই বেছে নেব। মনের মধ্যে জায়গা থাকলে সেখানে অনেককে আশ্রয় দেয়া যায়। 

নারীর প্রতি পুরুষের বা পুরুষের প্রতি নারীর এক ধরনের কামতৃষ্ণা জাগ্রত হচ্ছে। ফলে এটারই একটা সভ্য-সংস্কৃত প্রকাশ হচ্ছে ‘প্রেম’। এই প্রেমটা কোনো মৌলিক রিপু নয়, মৌলিক রিপু হচ্ছে ‘কাম’। মানুষ আর অন্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো, নিজেদের পরিবর্তন করার শক্তি মানুষের আছে। আমাদের ভেতর যে প্রকৃতি প্রদত্ত হয়েছে, সে প্রকৃতি পরিবর্তন করার ক্ষমতাও আমাদের রয়েছে। আমি আদিম পূর্বপুরুষকে লালন করি, সেজন্য আমি সকল প্রকার প্রিজুডিস থেকে মুক্ত।

আমি চাই পৃথিবীতে হোক চিরবসন্ত- চির-আনন্দ: মহাদেব সাহা

আমার আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ডে একটি কবিতা আছে ‘আমি দশ দিগন্তে দশ নারীকে নিয়ে শুই’। অর্থাৎ আমি চারিদিক থেকে নারীবেষ্টিত একটা কল্পনার জগত গড়ে তুলি। তার ভেতরে আমি বাস করি। সংসারে থেকে পরাধীন চিত্ত নিয়ে বড় হওয়ার চেয়ে স্বাধীন চিত্ত নিয়ে ছোট থাকাটাকেই বেশি পছন্দ করি আমি। আমার এক প্রকারের স্বাধীন মনোবাসনা আছে।   

নারীর চিত্ত জয়ের বাসনা কবির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ- আমার দিক দিয়ে সেটা এখনো চলমান। এটা সুন্দরের কাছে কবির আত্মসমর্পণেরই একটি পর্যায় বলে আমি মনে করি। আমার মধ্যকার ভালোবাসার আকুতি নারীদের স্পর্শ করেছে। আমি কল্পনা করে খুব বেশি এগুতে পারি না। একটা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয় আমার কবিতা। কাউকে উপলক্ষ্য করে, মানে কাউকে মুগ্ধ করার ইচ্ছে থেকে আমার কবিতা রচিত হয়। 

কবি হচ্ছেন তিনি, যিনি মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তার মৌলিক অনুভূতিগুলোর সজাগ-জীবিত রূপ নিজের মধ্যে উপলব্ধি করেন। বাইরের দিক থেকে আমাকে হয়তো মনে হবে যে আমি জরাগ্রস্ত। কিন্তু কল্পনার জগতে আমি সতেজতাকে বিসর্জন দেইনি, বা আমি তার কাছে পরাভূত হইনি। 

একবার আমি বাবাকে আমার ‘সর্বগ্রাসী হে নাগিনী’ কবিতাটি শোনাতে পেরেছিলাম। কিন্তু এই কবিতা শুনে বাবা খুব মর্মাহত হয়েছিলেন। এ কবিতার মধ্যে আছে ‘পিতা নয়, মাতা নয়, কারো মৃত্যু নয়, কেবলই নারীর মৃত্যু সারাক্ষণ জুড়ে থাকে আমার হৃদয়।’ নারীকে আমি সবসময়ই আরো উচ্চে তুলে ধরেছি; যে গণহত্যাও আমাকে স্পর্শ করে না, পিতার মৃত্যু, মাতার মৃত্যু নয়, পিতা নয়, মাতা নয়, গণহত্যা নয়, নারীর মৃত্যুজুড়ে থাকে আমার হৃদয়ে। আমার কাছে নারী এখনো একই রকম আছে। 

নারীর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আমার ‘চৈত্রের ভালোবাসা’ বইটার প্রেক্ষপট মনে পড়ছে। ১৯৭৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের লেখক শিবনারায়ণ রায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তার সঙ্গে তার পরমা সুন্দরী কন্যা মৈত্রেয়ী রায় এবং তার স্ত্রী শ্রীমতি গীতা রায়ও এসেছিলেন। মৈত্রেয়ী রায়কে দেখে আমি খুবই মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমার ‘চৈত্রের ভালোবাসা’ বইটা পুরোটাই তাকে উদ্দেশ্য করে রচিত। মৈত্রেয়ীর চিত্ত জয় করবার জন্য আমাদের কবিদের মধ্যে অলিখিত প্রতিযোগিতা ছিল। তখন আমি মৈত্রেয়ীকে মুগ্ধ করার জন্য কিছু কবিতা রচনা করেছিলাম। সেগুলোর উদ্দেশ্যই ছিল ওর চিত্তকে নাড়া দেয়া। ‘চৈত্রের ভালোবাসা’ গ্রন্থের প্রথম কবিতাটির নাম ‘পিপীলিকা’, ‘প্রয়োজন ছিল না মোটেও তবুও সঞ্চয় আমার’ কবিতাগুলো পড়ে মৈত্রেয়ী আমার প্রেম স্বীকার করেছিল। 

তুলনামূলকভাবে আমি বাংলা ভাষায় সবচাইতে অকপটে সত্যকে প্রকাশ করার সাহস দেখিয়েছি। এটি আমার আত্মজীবনী পাঠ করলে পাঠক জানতে পারবেন। আমি হোটেলে খেয়ে পয়সা না দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে এসেছি । আমি জুয়া খেলেছি, মদ্য পান করেছি, নেশায় আসক্ত হয়েছি। এই তথ্যগুলো গোপন করতে পারতাম কিন্তু গোপন করিনি। তার অর্থ এই নয় যে, আমি আমার জীবনের সব সত্য প্রকাশ করেছি। কিছু সত্য প্রকাশ করেছি। সেজন্য হয়তো পাঠকের প্রত্যাশা আমার কাছে বেশি। আমি তাদের সকল প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছি বা পারব বা ভবিষ্যতেও করব এরকম নয়। আমার মনে হয় যে কিছু সত্য আমি যেটা কবিতার মধ্যে বলেছি ‘সংরক্ষিত রবে কোনো কোনো জীবনের কাছে আজীবন।’ বিশেষ করে নারীর সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক সে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমি আমার সব সত্য প্রকাশ করিনি। কিন্তু সামাজিক জীবনে আমার যে অবস্থান সেই অবস্থানকে গোপন করতে চাইনি।

আমাদের নোবেল ওরিয়েন্টেড অমর্ত্য সেনের প্রথম স্ত্রী লেখিকা নবনীতা দেব সেন। তিনি আমার সম্পর্কে একটা লেখা লিখেছিলেন। তিনি লিখেছেন: ‘কবি নির্মলেন্দু গুণের প্রেমের কবিতার একটি সংকলন আমাকে কেউ একজন উপহার দিয়েছিল। সে উপহার পাওয়ার পর আমি কবিতার বইটি খুলে প্রথমেই চমকে উঠলাম উৎসর্গপত্রটি দেখে। সেই উৎসর্গপত্রে কবি বলেছেন- ‘প্রেম ও কামের অগ্নিতে যাদের হৃদয়কে আমি দগ্ধ করেছি।’

নবনীতাদি বলেছেন: ‘আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম একজন কবি এত গর্ব, এত অহঙ্কার নিয়ে উৎসর্গ করছে!’

আমার এতো গর্ব, এতো অহঙ্কারের উৎস কী? আমার তো অঢেল সম্পদ নেই, পেছনে অনেক নেতাকর্মী নেই। বরং নিজেই অর্থ কষ্টে ভুগেছি অনেক সময়। পালিয়ে বেড়িয়েছি। কোথায় পেলাম এতো শক্তি? ভালোবাসা থেকেই এতো শক্তি পেয়েছি। 

প্রেমের কবিতা দেশ নিরপেক্ষ, কাল নিরপেক্ষ। প্রেমের কবিতাগুলো পৃথিবীর সকল জাতির জন্য সকল মানুষের জন্য সত্য। তুলনামূলকভাবে আমি প্রেমের কবিতাই বেশি লিখেছি। কিন্তু রাজনৈতিক কবিতাগুলো আমাদের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বেশি পঠিত। যদিও প্রেমের কবিতাতেই আমার অন্তরের আগ্রহ বেশি এবং নারীর প্রতি আমার ভালোবাসা, তীব্র প্রেমবোধ আমাকে সর্বদা তাড়িত করেছে। বিভিন্নজনের কাছে শুনেছি, ‘তোমার চোখ এত লাল কেন’- এই কবিতা পড়ার পর অজস্র মানুষ আছে যারা ওই নারীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যে নারী মাথায় হাত রেখে এসে বলবে- ‘তোমার চোখ এত লাল কেন।’

জীবনের একটা বিশেষ ধর্মই হচ্ছে প্রেম। নর-নারীর যে সম্পর্ক সে সম্পর্কটা আমি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি এবং আমার কবিতার মধ্যে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। আমার কবিতার পাঠক প্রচুর আছেন। তো প্রেমের ক্ষেত্রে আমার বক্তব্যটা হচ্ছে যে, জীবনে একটাই প্রেম হয় বা প্রেম একবারই এসেছিল জীবনে আমারি দুয়ার প্রান্তে- ঠিক এটাতে আর স্থির থাকতে পারিনি। একবার একটা কবিতার মধ্যে লিখেছিলাম: ‘মনস্থির করা হয়তো সম্ভব অদৃশ্য ঈশ্বরে... অসম্ভব জীব বংশে নারী কিংবা নরে’

অর্থাৎ জীবন্ত সত্তা যা সে কখনো স্থির হতে পারে না; কোনো সুনির্দিষ্ট স্থির হতে পারে না। কারণ এই মানুষের চিত্ত। চিত্ত মানে নিত্য পরিভ্রমণ এবং নিত্যনতুনের দিকে তার আকর্ষণ। 

অনুলিখন: লায়লা ফেরদৌসী