বৈশাখ সংখ্যা

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় নববর্ষ উদ্‌যাপনের ঐতিহ্য

বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি অঞ্চলে বেশ কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের বসবাস রয়েছে। তাদের অনেকে বাঙালি না-হলেও বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনের বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু তাদের সেই ঐতিহ্যের তৎপরতা নিজস্ব জাতিগোষ্ঠীর কৃত্যমূলক অনুষ্ঠান ও উৎসবের মধ্যে সীমায়িত থাকে।

প্রচলিত যে চিত্রটি প্রতি বছর আমরা দেখতে অভ্যস্থ তা হলো- বাংলা বর্ষপঞ্জির হিসাবে প্রতি বছর চৈত্র মাসের দ্বিতীয়ার্ধ এলেই বাংলাদেশের সংস্কৃতবান শহুরবাসী জনতা পহেলা বৈশাখকে বাঙালির নববর্ষ হিসেবে পালন করার বিভিন্ন প্রস্তুতি নিতে থাকেন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেল, জাতীয় প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান পহেলা বৈশাখ ‘বাঙালির নববর্ষ’ হিসেবেই মহাসমারহে উদ্‌যাপন করে থাকে। রমনার বটমূলে ছায়ানটের যে অনুষ্ঠান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা সবখানেই বাঙালির নববর্ষ হিসেবেই পহেলা বৈশাখ বরিত হয়ে থাকে।

গ্রাম পর্যায়ে বাংলাদেশের বিচিত্র সাংস্কৃতিক তৎপরতার সন্ধানে নেমে বহু বছর ধরে লক্ষ করেছি পহেলা বৈশাখ শুধু বাঙালির উৎসব নয়, পহেলা বৈশাখ এদেশে বসবাসরত বেশ কিছু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নববর্ষ। অথচ, পহেলা বৈশাখে বাঙালির নববর্ষ পালনের জাতীয় তৎপরতার মহাডামাডোলের মধ্যে চাপা পড়ে যায় বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নববর্ষ উদ্‌যাপনের সুবিস্তৃত ও বর্ণিল আয়োজন। এই পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে যখন ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জন করে তখন এদেশের অন্যান্য ভাষাভাষী জনগণের সংস্কৃতিকে সমান গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার দাবি রাখে। তাই বর্তমান প্রবন্ধের অবতারণা।

বাঙালি জনগোষ্ঠীর বাইরে পহেলা বৈশাখে এ দেশীয় অন্যান্য যে সব জাতিগোষ্ঠী তাঁদের নববর্ষ উদ্‌যাপন করে বলে তথ্য পাওয়া যায় তারা হলেন- পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১১ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী (তথ্য : হাফিজ রশিদ খান), এছাড়া বৃহত্তর সিলেট জেলার মনিপুরি জনগোষ্ঠী। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের সীমা ছাড়িয়ে পহেলা বৈশাখ তথা ১৪ এপ্রিল বার্মা এবং থাইল্যান্ডেও নববর্ষ পালিত হয়। আমরা সেদিকে যাব না, আমরা আজকের লেখায় পহেলা বৈশাখে বাংলাদেশীয় যে সকল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নববর্ষ তাদের নববর্ষ উদ্‌যাপনের বিবরণ উপস্থাপন করব।

বৃহত্তর পার্বত্যাঞ্চল চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি আর বান্দরবান জেলা মূলত চাকমা, মারমা, ম্রো-মুরং, তঞ্চ্যঙ্গা, বোম, খিয়াং, পাঙ্খু, লুসাই, ত্রিপুরা, খুমী, চাক ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর বসতি এলাকা। এখানকার প্রতিটি জনগোষ্ঠীরা বেশ ঘটা করে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ নিজস্ব ভঙ্গি ও রীতি বর্ষবিদায়-বর্ষবরণ করে থাকে। বাংলা বছরের শেষ দুদিন থেকে পহেলা বৈশাখ পর্যন্ত খুব ধুমধামের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী তাদের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের উৎসব উদ্‌যাপন করে। উল্লেখ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের একেক জনগোষ্ঠীর নববর্ষ উৎসবের নামও একেক রকম।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী পহেলা বৈশাখে বৈসু বা বৈসুক নামে নববর্ষ উৎসব উদ্‌যাপন করে। ত্রিপুরাদের বৈসু বা বৈসুক শুরু হয় পহেলা বৈশাখের দুই দিন আগে থেকে, যার প্রথম দিনে থাকে হারি বৈসু, দ্বিতীয় দিনে বিসুমা এবং তৃতীয় অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের দিন থাকে বিসিকাতাল বা আতাদাক। শেষ দিনটিই ত্রিপুরারা নববর্ষ হিসেবে উদ্‌যাপন করে। নববর্ষ হিসেবে ত্রিপুরারা তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে ‘গোড়াইয়া নৃত্য’ পরিবেশন করে। ২০-৩০ জন নারী-পুরুষ নর্তক-নর্তকী নিয়ে গঠিত হয় একেকটি গোড়াইয়া নৃত্য দল। বৈসুকের দিনে এই গোড়াইয়া নৃত্য দল পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে নৃত্য পরিবেশন করে।

পহেলা বৈশাখে মারমা ও চাকমা জনগোষ্ঠী যথাক্রমে সাংগ্রাইন ও বিজু নামে নববর্ষ উৎসব উদ্যাপন করে থাকে। চাকমা জনগোষ্ঠী ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মতোই পহেলা বৈশাখের আগের দু’দিন থেকে নববর্ষ উৎসব শুরু করে। যার প্রথম দিন থাকে ‘ফুল বিজু’, দ্বিতীয় দিন ‘মূল বিজু’ এবং শেষ দিনকে তারা ‘গোর্য্যাপর্য্যার দিন’ বলে। তারা মোট তিনদিনব্যাপী নববর্ষ উদ্‌যাপন করে।

বাংলা বর্ষের শেষ দিনের আগের দিন চাকমারা ফুল বিজু পালন করে থাকে। এ দিন ভোরের আলো ফোটার আগে চাকমা নারী-পুরুষ, ছেলেমেয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে ফুল তোলার জন্য বাগানে, বনবাদাড়ে- যেখানে ফুল পাওয়া যায়। নিজের বাগানে তো বটেই, প্রতিবেশীর বাগান থেকে পর্যন্ত ফুল চুরি করতে এ দিন কারো বাধা থাকে না। তাই বলতে গেলে রাতভর সবাই সজাগ থাকে যাতে নিজে ফুল তোলার আগে অন্য কেউ এসে বাগানের থেকে ফুল চুরি করে না নিয়ে যেতে পারে। তোলা ফুলের একাংশ দিয়ে বুদ্ধপুজো দেওয়া হয়, বাকি অংশ নিয়ে দেওয়া হয় নদীতে পুজোর অর্ঘ রূপে। নদীতে ফুল পুজো দেওয়ার আগে গোসল করা হয়। গোসলের সময় আর ফুল দেওয়ার সময় নদীর কাছে প্রার্থনা করা হয়- ‘জু মা গঙ্গী, ম-র পুরোন ঝরঝর আপদবলা, ফিবলা বেগ ধোয় নে যা’ অর্থাৎ ‘প্রণাম হে মা গঙ্গা, আমার পুরানো বছরের যাবতীয় আপদ-বিপদ সব ধুয়ে নিয়ে যাও।’

চাকমাদের বিজু উৎসবের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ বাংলা বর্ষের শেষ দিনকে বলা ‘মূল বিজু’। এই শব্দবন্ধ থেকে বোঝা যায় বিজু উৎসবের মূল বা প্রধান আকর্ষণ হলো এই দিনটি। এ দিন সকালে ছোট ছেলেমেয়েরা থালায় ধান নিয়ে প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে উঠোনে ধান ছিটায় মুরগিদের খাওয়ানোর জন্য। মুরগিদের খাওয়ানো শেষে এবার আসে নিজেদের খাবার পালা। এবার ছেলেমেয়েরা সবাই মিলে প্রতিবেশীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ঘুরে ঘুরে বিজু খেয়ে থাকে। প্রতিবেশীর বাড়িতে ঘুরতে এ দিন দাওয়াতের প্রয়োজন হয় না। প্রতি বাড়িতে পাজনসহ খাবারের বিভিন্ন আয়োজন থাকে। বিভিন্ন পদের সবজির সংমিশ্রণে রান্না করা তরকারিকে পাজন বলা হয়। সম্ভবত পাঁচ অন্ন (পাঁচন) শব্দ থেকেই পাজন শব্দের উৎপত্তি, যা তৈরি হয়  ন্যূনতম পাঁচ পদের সবজি দিয়ে। সবাই চেষ্টা করে পাজনে সবজির পদ বা সংখ্যা বাড়াতে। অনেক ক্ষেত্রে একশ পদেরও বেশি সবজি দিয়ে পাজন রান্না করা হয়। এই পাজন ছাড়াও থাকে পিঠা, পায়েস, সেমাই, শরবত ইত্যাদি অনেক ধরনের খাবার ও পানীয়। পাজনের সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্কদের আপ্যায়ন করা হয় ঘরে তৈরি মদ দিয়ে। সাধারণত মূল বিজুর দিনে ভাত এবং মাছ-মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করা  হয় না। দুপুরে তরুণ-তরুণীরা নদী, কুয়ো থেকে জল তুলে কলসি কাঁধে বয়সীদের গোসল করায়। বৌদ্ধ মন্দিরে বুদ্ধের মূর্তিকে গোসল করানো হয়। গোসল করা বা করানোটা হলো পুরনো বছরের ময়লা-আবর্জনাস্বরূপ আপদ-বিপদ ধুয়ে পূতঃপবিত্র হওয়ার প্রতীক। সন্ধ্যায় মোমবাতি দিয়ে বুদ্ধকে, গঙ্গী মাকে (নদীকে) পুনরায় পুজো করা হয়, বাসায় আলোকসজ্জা করা হয় এবং গোয়ালঘরও মোমবাতি দিয়ে আলোকিত করা হয় এই উদ্দেশ্যে যে, পুরনো বছরের যাবতীয় অজ্ঞানতা, আপদ-বিপদের অন্ধকার যেন দূরীভূত হয়ে যায়।

বিজু উৎসবের তৃতীয় দিন বা বাংলাবর্ষের প্রথম দিনকে বলা হয় ‘গোর্য্যাপোর্য্যা’ দিন অর্থাৎ গড়িয়ে পড়া দিন। হিন্দিতে যেমন জন্মদিনকে বলা হয় ‘সাল গিড়া’ বা ‘বর্ষ গড়িয়ে যাওয়া’র দিন, তেমনি চাকমাদের কাছে পহেলা বৈশাখ হলো বছর গড়িয়ে পড়ার দিন। এ দিন নিকট আত্মীয়দের দাওয়াত দিয়ে ভাত-মাছ-মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। সাধারণত যে গৃহবধূরা অন্যদের আপ্যায়নে ব্যস্ত থাকার কারণে মূল বিজুতে বেশি শরিক হতে পারেননি, তারা এ দিন বাড়ি বাড়ি ঘোরে।

মারমা আর রাখাইন আদিবাসীগোষ্ঠীর কাছে নববর্ষের উৎসব ‘সাংগ্রাইন’ নামে পরিচিত। চাকমারা যেখানে পুরনো বছরের আপদ-বিপদ দূরীভূত করার মানসে নদীতে গোসল করে, বয়সীদের গোসল করায়, সেখানে সাংস্কৃতিক বিবর্তনে বর্র্ষবিদায় ও বর্ষবরণের উৎসব ‘সাংগ্রাইন’ মারমাদের কাছে হয়ে গেছে পানি ছিটানোর ‘জলকেলি’ উৎসব। এ উৎসবে নারী-পুরুষ সবাই অংশগ্রহণ করে পরস্পরের ওপর জল ছিটানোর জন্য।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ম্রো জনগোষ্ঠীও পহেলা বৈশাখে ‘চাংক্রান পোই’ নামে নববর্ষ উদ্‌যাপন করে। ম্রোদের এই উৎসবের নাম এসেছে একটি ফুলের নাম থেকে। ফুলটি সুগন্ধিযুক্ত সুন্দর গঠনের অনেকটা যেন হাসনুহেনার মতো দেখতে। এ ফুল ফোটার অর্থ হলো বছর শেষ হয়েছে, নতুন বছর এসেছে। নববর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে ম্রো-যুবতিরা চাংক্রান ফুল দিয়ে খোঁপা সাজায় আর ম্রো-যুবকেরা পুঙ বা বাঁশির তালে তালে ক্লুবঙ প্লাই বা পুষ্পনৃত্য করে।

চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায় সাড়ম্বরে বিষুব সংক্রান্তি পালন করে। এ উপলক্ষে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন খেলার প্রতিযোগিতা। খেলার মধ্যে বাংলাদেশের সমতল এলাকা থেকে ব্যতিক্রমধর্মী খেলা হলো নাধেং খেলা, ঘিলা খেলা ইত্যাদি। পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত অন্যান্য জেলার আদিবাসীরাও পালন করে বিষুব সংক্রান্তি উৎসব। বৃহত্তর সিলেট জেলার কমলগঞ্জের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের কাছে এ উৎসব ‘বিষু’ নামে অভিহিত। পুরনো বছরের শেষ দিন থেকে শুরু হয়ে একটানা সাত দিন চলে এ উৎসব। বিষু উপলক্ষে চলে পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে বিভিন্ন খাবারের আদান-প্রদান, পাড়ায় পাড়ায় খেলাধুলার প্রতিযোগিতা। খেলার মধ্যে রয়েছে কড়ি, ঘিলা খেলা ইত্যাদি।

বাঙালির বৈশাখী উৎসবের সমান্তরালে বাংলাদেশীয় অন্যান্য জাতিসত্তার বৈশাখী উৎসবকে রাষ্ট্রীয় ভাবেই পালন করা সঙ্গত বিবেচনা করি। জয়তু বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধ জীবনাচার ও সংস্কৃতি, যা বাঙালির সাংস্কৃতিক তৎপরতার পাশাপাশি রূপে, গুণে, বর্ণে আরেক বৈচিত্র্য নিয়ে আমাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সন্ধান দিয়ে ফেরে।

 

আরও পড়ুন : *বাঙালির সংস্কৃতি: অপরাজেয় লেনদেন *বৈশাখ নিজেই যখন পঙ্‌ক্তিমালা *কারাগারে বঙ্গবন্ধুর ‘নববর্ষ’ উদ্‌যাপন *চৈত্র সংক্রান্তি: সামাজিক আচার ও ক্রিয়া