সারা বাংলা

থানার সামনে বন্যপ্রাণীর হাট, মামলা ঠুকবে কে?

দর্শকপ্রিয় ‘হাওয়া’ সিনেমায় ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২’ লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে দেশব্যাপী কিছুদিন ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। এদিকে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার ২০০ গজ ও পৌরসভার ১০০ গজের ভেতরেই নিয়মিত বেচাকেনা হচ্ছে খাঁচাবন্দি পশু-পাখি। প্রশাসনের সক্রিয় তদারকির অভাবে দেদারসে চলছে এই হাট। পরিবেশবাদীদের ভাষ্য, ‘হাওয়া’র তো রফা হলো; এবার মামলা ঠুকবে কে?

পৌর শহরের বঙ্গবন্ধু স্কয়ারের জাতীয় বীর আবদুল কুদ্দুস মাখন পৌর মুক্তমঞ্চ ময়দানটি এখন জেলাবাসীর কাছে ‘পাখির হাট’ হিসেবেই পরিচিত। সপ্তাহের শুক্র ও সোমবার এই মাঠে হাট বসে। হাটে ময়না, টিয়া, শালিক, কোয়েল; বিদেশি প্রজাতির অস্ট্রেলীয় জাতের মার্জিকা, বেঙ্গালোর, প্রিন্স, গিনিপিগ, প্রজাতিভেদে কবুতর ও খরগোশসহ নানা ধরনের বন্যপশু-পাখি বিক্রি হয়। 

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন থাকলেও এই হাটের ক্রেতা-বিক্রেতারা সেটার ‘থোড়াই কেয়ার’ করছেন। খাঁচাবন্দি পশু-পাখিদের এমন বেচাকেনায় প্রশাসন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোও নীরব। অথচ দেশে ‘দ্য ফরেস্ট অ্যাক্ট-১৯২৭’ আইনও কার্যকর আছে। এ ছাড়া বন্যপ্রাণী ধরা ও বিক্রি দণ্ডনীয় অপরাধ। রয়েছে ছয় মাসের জেল-জরিমানার বিধান। তবুও প্রশাসনের চোখে যেন ‘কাঠের চশমা’। 

রাইজিংবিডির প্রতিবেদক জানায়, অস্থায়ী এই হাটে এক জোড়া টিয়া বিক্রি হয় পাঁচ হাজার টাকায়। এ ছাড়াও বিদেশি প্রজাতির মার্জিকা ৩০০-৬০০, বেঙ্গালোর ৬০০-৭০০, প্রিন্স ৫০০- ১০০০, শালিক ৩০০- ৫০০, গিনিপিগ ১০০-১৫০০, কোয়েল জোড়া ১০০, কবুতর প্রজাতিভেদে ২০০ থেকে ৪ হাজার, খরগোশ ১ থেকে ৪ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নদী ও প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা সামাজিক সংগঠন ‘নোঙ্গর’-এর সভাপতি শামীম আহমেদ রাইজিংবিডিকে বলেন, শহরের প্রাণকেন্দ্রে এত বড় পাখির বাজার বসার পরও প্রশাসন এ ব্যাপারে কিছু করছে না— সেটা দেখে আমরাও অবাক হই। বন্যপাখি খাঁচাবন্দি করে রাখার অধিকার কারও নেই। পাখিরা যদি খাঁচাবন্দি হয়ে থাকে তাহলে পরিবেশের ভারসাম্য ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়বে। এই বাজারে অভিযান চালাতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ জরুরি। 

আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুর গ্রাম থেকে পাখি কিনতে এই হাটে এসেছেন মোহাম্মদ আবির মিয়া। তার শখ, এক জোড়া টিয়া কিনে পোষ মানাবেন। ‘বন্যপাখি পোষা আইনে নিষেধ আছে’— এমন প্রশ্নে তিনি হাসি দিয়ে বলেন, ‘শখ করে পাখি পুষবো। মেরে ফেলার জন্য তো আর কিনবো না!’

জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমরানুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, কবুতর বিক্রি করে জানি। বন্যপাখি বিক্রি করলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান পরিচালনা করা হয়। তারপরও এ সপ্তাহেই খোঁজ নেওয়া হবে। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পশু-পাখির হাটের এই যাত্রা বহু বছর আগে থেকেই। এক সময় জগতবাজার, পরে পর্যায়ক্রমে বোডিং মাঠ, মৌড়াইল রেলগেট, সুপার মার্কেটের সামনে, পুরনো কাচারির সামনে, পুরনো জেলখানা হয়ে বর্তমানে পৌর মুক্তমঞ্চ ময়দানে এই হাট বসছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জজ কোর্টের আইনজীবী (দেওয়ানি ও ফৌজদারি) নাসির মিয়া রাইজিংবিডিকে বলেন, পাখি খাঁচার মধ্যে আটকিয়ে রাখা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। পৌরসভা ও থানার সামনেই যদি বন্যপাখির হাট বসে তাহলে প্রশাসনের গাফিলতি আছে। প্রশাসনকে এ ব্যাপারে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

মোদ্দাকথা, প্রশাসনের সঠিক তদারকি না থাকায় পাখির সরবরাহ ও বিক্রি বন্ধ হচ্ছে না। বিষয়টি যাদের দেখার কথা (বন বিভাগের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট) তারা এক্ষেত্রে কার্যত নিষ্ক্রিয় বলে অভিযোগ পরিবেশবাদীদের। তারা বলছেন, কোন বাজারে বন্যপ্রাণী বিক্রি হচ্ছে, কারা বিক্রি করছে- এ সংক্রান্ত তথ্য চাইলেই পাওয়া সম্ভব। তারপরও কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যেভাবে বন্যপ্রাণী ধরা ও নিধন হচ্ছে, তাতে অনেক পাখি এখন বিলুপ্ত প্রায়। এতেও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়তে পারে। 

এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইয়ামিন হোসেন রাইজিংবিডিকে বলেন, সপ্তাহে দুই দিন শহরের প্রাণকেন্দ্র বন্যপাখির বাজার বসে; সেটি আমাকে কেউ জানায়নি। পাখির বাজারের ব্যাপারে জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন ইউএনও।

পড়ুন: খাঁচাবন্দি পাখি, কী ভাবছেন তারা?

তবে জেলা প্রশাসকের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এদিকে, ‘দ্রুত অভিযান পরিচালনা হবে’— এমন আশ্বাস দিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার মেয়র নায়ার কবির। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, পাখি ব্যবসায়ীদের অনেকবার জায়গা থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা একেক সময় একেক জায়গায় বসে। আমাদের পক্ষ থেকে কয়েকবার অভিযান দেওয়া হলেও তারা জায়গা বদলিয়ে ফের অন্যখানে বসে যায়। শহরের প্রধান জায়গায় এ হাট বসে শুনেছি। অচিরেই অভিযান দিয়ে তুলে দেবো।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দায়িত্বরত বন বিভাগের কর্মকর্তা মো. শাহজাহান রাইজিংবিডিকে বলেন, গত কয়েকদিন আগে অভিযান পরিচালনা করে একটি বানর উদ্ধার করে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে উন্মুক্ত করেছি। আর কয়েকটি টিয়া ও শালিক পাখিকে আকাশে ছেড়ে দিয়েছি। সামনের পাখির হাটে ফের অভিযান পরিচালনা করা হবে।