বৈশাখ সংখ্যা

কারাগারে বঙ্গবন্ধুর ‘নববর্ষ’ উদ্‌যাপন

বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান উৎসব ‘বর্ষবরণ’। বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহকেরা এই দিনটিকে মননের গভীরে লালন করেন। বাংলা সাল গণনা শুরু হয়েছিলো সম্রাট আকবরের সময়ে। সে সময় থেকে রাজা-বাদশারা এবং জমিদারি আমলে জমিদাররা চৈত্র সংক্রান্তিতে খাজনা আদায় করে পহেলা বৈশাখে প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। কোথাও কোথাও মেলাও বসতো। শুরুটা এভাবেই হয়েছিল। তারপর শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপাসনা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ঘটা করে নববর্ষ পালনের রেওয়াজ চালু করেছিলেন। তবে তিনি এও বলেছিলেন, সেসব যেন কেবল আনুষ্ঠানিকতা-নির্ভর না হয়। যেন আত্মার মুক্তি ঘটে। এরপর পাকিস্তান আমলে যখন পাকিস্তানিরা বাঙালিদের সব কিছুতে শুধু নিষেধাজ্ঞা দিতে শুরু করেছিল, তখন বাঙালিরা নিজেদের সব ঐতিহ্য বেশি করে আঁকড়ে ধরতে শুরু করেছিল। সে সময় পাকিস্তানি গোষ্ঠীর প্রতি প্রবল প্রতিবাদস্বরূপ পালিত হতো ‘নববর্ষ’ পালন বা পহেলা বৈশাখ।

ষাটের দশকে পহেলা বৈশাখ হয়ে উঠেছিলো বাঙালির রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি নিজস্ব সংস্কৃতি-সত্তার কথা জানান দিয়েছিল। তবে সেই আনুষ্ঠানিকতা আজকের মতো এতো আড়ম্বরের সাথে পালিত হতো না। ১৯৬৭ সাল থেকে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব শুরু হয়েছিল। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় মেলা বসতো। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথাও ‘পহেলা বৈশাখ’ পালন হয়নি। যেটা সম্ভবও ছিল না। তখন স্বাধীনতা এবং মুক্তির জন্য চলছিল লড়াই। ১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু পহেলা বৈশাখকে জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং এই দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৮৯ সাল থেকে উৎসবে যুক্ত হয়েছিল চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা। আর ২০১৬ সালে নববর্ষের ভাতা প্রদান শুরু হয়েছে। বর্তমানে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, পেশা নির্বিশেষে বাঙালির প্রাণের উৎসব হয়ে উঠেছে ‘বর্ষবরণ’।

ইংরেজি ১৯৬৭ সাল বা বাংলা ১৩৭৪ সালের পহেলা বৈশাখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কারাগারে। সে দিন কারাগারেই ‘বর্ষবরণ’ হয়েছিল। ভোরবেলা আলম সিদ্দিকী, নূরুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন রাজবন্দি নিজেদের ২০ সেল থেকে কয়েকটি ফুল নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর জেলের সামনে। আবার ২৬ সেল হাসপাতাল থেকে খোন্দকার মোশতাক আহমদও বঙ্গবন্ধুকে ফুল পাঠিয়েছিলেন। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন: ‘আমি ২৬ সেল থেকে নতুন বিশ সেলে হাজী দানেশ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, হাতেম আলি খান, সিরাজুল হোসেন খান, মিজানুর রহমান, মোল্লা জালালউদ্দিন, আবদুল মোমিন, ওবায়দুর রহমান, মহিউদ্দিন, সুলতান, সিরাজ এবং হাসপাতালে খোন্দকার মোশতাক সাহেবকে ফুল পাঠাইলাম নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে। শুধু পাঠাতে পারলাম না পুরানা হাজতে, যেখানে রণেশ দাশগুপ্ত, শেখ ফজলুল হক (মণি)- আমার ভাগনে, হালিম, আবদুল মান্নান ও অন্যরা থাকে এবং ১/২ খাতায় যেখানে শ্রমিক নেতারা, ওয়াপদার কর্মচারী ও কয়েকজন ছাত্র থাকে তাদের মুখে খবর পাঠাইলাম আমার শুভেচ্ছা দিয়ে।’

বঙ্গবন্ধু তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন জেলের মধ্যে ছোট ছোট জেল ছিল, কারো সাথে কারো দেখা হতো না। বিশেষ করে রাজবন্দিদের বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এ সম্পর্কে লিখেছিলেন: ‘এরা (রাজবন্দিরা) তো রাষ্ট্রের শত্রু!’ এখানে বিস্ময়বোধক চিহ্ন দিয়ে রাষ্ট্রকে ব্যঙ্গ করেছেন বঙ্গবন্ধু। যাই হোক সেদিন তাঁরা শুধু ফুল দেওয়া-নেওয়া করেই বাঙালি সংস্কৃতির সবচেয়ে বড়ো উৎসব সম্পন্ন করেননি। পুরোনো ২০ সেলের সামনে কম্বল বিছিয়ে গানের অনুষ্ঠানেরও আয়োজন হয়েছিল। অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন রাজবন্দি নূরে আলম সিদ্দিকী, নূরুল ইসলাম ও হানিফ খান। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন: ‘বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার, শুধাংশু বিমল দত্ত, শাহ মোয়াজ্জেম আরও কয়েকজন ডিপিআর ও কয়েদি, বন্দি জমা হয়ে বসেছে। আমাকে যেতেই হবে সেখানে, আমার যাবার হুকুম নাই তবু আইন ভঙ্গ করে কিছু সময়ের জন্য বসলাম। কয়েকটা গান হলো, একজন সাধারণ কয়েদিও কয়েকটা গান করল। চমৎকার গাইল। ... ছোট হলেও জলসাটা সুন্দর করেছিল ছেলেরা। আমি কারাগার থেকে আমার দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই।’

এই দিন রাজবন্দি মিজানুর রহমান চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে একটি কবিতাও লিখে পাঠিয়েছিলেন। বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান উৎসব ‘বর্ষবরণ’ বঙ্গবন্ধুর জীবনে সে দিন এভাবেই সম্পন্ন হয়েছিল। বোঝা যাচ্ছে কারাগারের বন্দিজীবন বাঙালির প্রধান পুরুষ বঙ্গবন্ধুকে বর্ষবরণে বাধা দিতে পারেনি, বাধা দিতে পারেনি কোনো রাজবন্দিকেই। ফুল, গান, কবিতা- সবই উপস্থিত ছিলো সেদিন কারাগারে। আর সবচেয়ে বেশি করে যা উপস্থিত ছিলো তা হলো বাঙালিত্ব বা বাঙালি জাতীয়তাবাদ।  এই বাঙালিত্বই আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে।

বর্তমান সময়ে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের মতো বাঙালিরাও এক নির্মম কারাগারে দিন যাপন করছে। এ কারাগার হলো করোনা-কারাগার। বাংলা ১৪২৭ সাল বা ইংরেজি ২০২০ সালও করোনাকারাগারে কেটে গেলো। লোক সমাগম নিষেধ। বিশ্বের সমস্ত মানুষ রয়েছে গৃহবন্দি। ১৪২৭ সালের বর্ষবরণ তাই ভার্চুয়ালি পালন করা হয়েছিল। অনলাইনে লোকে বর্ষবরণের গান শুনেছে। অনলাইনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অনুষ্ঠান করেছে, ফেসবুক-ইন্সট্রাগ্রামে শাদা-লাল পোশাক পরে ছবি দিয়েছে। অনেক জায়গায় পাড়া বা অ্যাপার্টমেন্টের লোকেরা এক হয়েও বর্ষবরণ-উৎসব করেছে। কোথাও কোথাও কোনো কোনো সংগঠন ছোট ছোট অনুষ্ঠান করেছে। এভাবে প্রতিকূল পরিবেশে বাঙালি বরণ করেছে নতুন বছরকে। ছায়ানট তাদের অনুষ্ঠানে সাধারণত যে খরচ হয়, সে টাকা দুস্থদের মধ্যে দান করে দিয়েছে। সবার আশা ছিল ১৪২৮ সালকে আড়ম্বরের সঙ্গে বরণ করবে। কিন্তু করোনা আরও জেঁকে বসেছে। চলছে মৃত্যুর মিছিল। তাই এ বছরও ঘরে থেকে বর্ষবরণ উৎসব করতে হবে।

হ্যাঁ, উৎসব চলবে অবশ্যই। কারণ এ উৎসব বাঙালি সংস্কৃতির প্রধানতম অংশ। একটা সময় ছিল যখন শুধু হালখাতা করা হতো। আবার হালখাতার উৎসব না করলেও দোকানে দোকানে মিষ্টি রাখা হতো। দোকানে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে যারা যেতেন তাদের মিষ্টি খাওয়াতেন দোকানের মালিকরা। দু’একটি জায়গায় মেলাও বসতো। এভাবেও নববর্ষ পালন হয়েছে। তখন ওটাই ছিলো চল। সময়ের সাথে সাথে আনুষ্ঠানিকতার পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশে পহেলা বৈশাখে মহাযজ্ঞ হয় যেন। বাংলাদেশের প্রতিটি বাঙালির মনে এর ছোঁয়া লাগে। পোশাকে, খাদ্যে, উপহারে, অনুষ্ঠানে সব অনুষ্ঠানকে ছাড়িয়ে গেছে পহেলা বৈশাখ। এটা আমাদের সংস্কৃতির একটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু করোনাকালে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতেই হবে। ইন্টারনেট শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে মানুষের মনকে কাছাকাছি এনেছে। তাই অনলাইনেই বাঙালি জাতি এবারও মিলিত হবে সংস্কৃতির প্রধান এই উৎসবে।

অর্থাৎ কারাগারে থাকলেও আনুষ্ঠানিকতা হবে। বঙ্গবন্ধু যেমন করেছিলেন। শত্রুদের দ্বারা বেষ্ঠিত ছিলেন, তাদেরই কথার প্রতিবাদস্বরূপ পালন করেছিলেন পহেলা বৈশাখ। বর্তমান করোনা-কারাগারে থেকেও ভার্চুয়াল আনুষ্ঠানিকতা হবে। তবে মনে রাখা দরকার বাংলাদেশের এই প্রাণের উৎসবগুলো আস্তে আস্তে আনুষ্ঠানিকতানির্ভর হয়ে উঠছে। মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিকবোধ বা আত্মিক শুদ্ধতার সঙ্গে উৎসবগুলোর যোগাযোগ কমে যাচ্ছে। এটা জাতির জন্য কল্যাণকর নয়; অনেকটা আত্মঘাতী। তাই আত্মিক যোগাযোগ বাড়ানো প্রয়োজন।

প্রাচীনকালে বাঙালিদের জীবনযাত্রায় এক ধরনের শুদ্ধতা বা ধ্যান ছিল। সেটা ফিরিয়ে আনা খুব জরুরি। করোনাকালের এই সময়ে সেই ধ্যান ফিরিয়ে এনে আমরা নিজের মনে শুদ্ধ হয়ে উঠতেই পারি। করোনা মহামারিতেও থেমে থাকেনি ধর্ষণ, অপহরণ, হত্যা, চুরি-ছিনতাই, ঘুষ-দুর্নীতি, মানুষকে অপদস্থ করা, ম্যুরাল ভাঙা, ভাঙচূড়, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন অপকর্ম। থেমে থাকেনি সংখ্যালঘুদের অপমান-অপদস্থ করা, তাদেরকে বাস্তুচ্যুত করা। যারা এই কাজগুলো করে তারা যদি এগুলো বর্জন করে শুদ্ধ হয়ে উঠতো, মানবিক হয়ে উঠতো তাহলে বাঙালি জাতি মুক্তি পেতো। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা আর মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। ‘স্বাধীনতা’ তিনি এনে দিয়েছেন। কিন্তু ‘মুক্তি’ আনার আগেই তাঁকে মেরে ফেলা হলো। সেই মুক্তি এখনো আসেনি। আজকের নববর্ষে করোনা-কারাগারে আবদ্ধ থেকে তাই বাংলাদেশের মানুষ ধ্যানে ফিরে যাক, নিজের আত্মার শুদ্ধতা আনুক। মনের সমস্ত হীনতা ঘুঁচে যাক। করোনা-কারাগারে অনুষ্ঠিত নববর্ষের প্রত্যাশা- আনুষ্ঠানিকতার গৌণতা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মার জরা-জীর্ণতা মুছে ফেলে শুদ্ধ হয়ে উঠুক মানব জাতি। পৃথিবী করোনামুক্ত হোক। পৃথিবী সমস্ত প্রাণের বাসযোগ্য হোক।। 

২৬ চৈত্র ১৪২৭, লালমাটিয়া  

আরও পড়ুন : *বাঙালির সংস্কৃতি: অপরাজেয় লেনদেন *বৈশাখ নিজেই যখন পঙ্‌ক্তিমালা *বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় নববর্ষ উদ্‌যাপনের ঐতিহ্য *চৈত্র সংক্রান্তি: সামাজিক আচার ও ক্রিয়া