বৈশাখ সংখ্যা

বাঙালির সংস্কৃতি: অপরাজেয় লেনদেন

বাংলাদেশের মানুষের কাছে ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি প্রায় বিমূর্ত রূপ ধারণ করেছে। বিষয়টি বোঝার জন্য যাদেরকে নিয়ে কথা বলা দরকার- অর্থাৎ দেশের জনগণ- তারা এখন পর্যন্ত জানতেই পারলো না, বুঝতেও পারলো না যে, ‘সংস্কৃতি’ ব্যাপারটা কী! বহু ‘উচ্চশিক্ষিত’ লোকও সংস্কৃতি বলতে কেবল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকেই- নাচ-গান-নাটক-চলচ্চিত্র-শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদি বুঝে থাকেন। বলাবাহুল্য এগুলো সংস্কৃতিরই অংশ, পুরোটা নয়। ‘সাংস্কৃতিক’ শব্দটির সঙ্গে সংস্কৃতির মিল থাকায় এই বিপত্তি।

অথচ ‘সংস্কৃতি’র সীমানা বিশাল, অর্থও ব্যাপক। এ সম্বন্ধে সবচেয়ে সুন্দর কথাটি পড়েছিলাম একটি লেখায়- culture is the man made part of the environment (হারস্কোভিটস)।  অধ্যাপক পবিত্র সরকার এটিকে ব্যখ্যা করেছেন এভাবে- ‘মানুষ আসার আগে পৃথিবী যে অবস্থায় ছিল আর মানুষ আসার পর পৃথিবীর যে অবস্থা দাঁড়ালো এই দুইয়ের তফাত হলো সংস্কৃতির তফাত। পৃথিবীর জীবন প্রতিবেশে মানুষের সৃষ্ট যা কিছু সে সবই সংস্কৃতি বাকিটা প্রকৃতি।’ [সূত্র : লোকভাষা লোকসংস্কৃতি, পবিত্র সরকার]।

এরকম আরেকটি সংজ্ঞাও ভালো লেগেছিল- ‘Historically created designs for living, explicit and implicit, rational, irrational and nonrational which exist at any time as potential guides for the behaviour of men (ক্লাইড ক্লাকহোন ও উইলিয়াম কেলি)।  মানে দাঁড়ালো- ঐতিহাসিকভাবে সৃষ্টি হওয়া জীবনযাপনের নানা ছক (ডিজাইন), যা কখনো প্রকাশ্য কখনো গোপন, কখনো যুক্তিসম্মত, কখনো অযৌক্তিক, কখনো যুক্তি নিরপেক্ষ (অর্থাৎ যেখানে যুক্তি-অযুক্তির প্রশ্ন তোলাই অবান্তর) এবং যা যে-কোনো সময়ে একটি জনগোষ্ঠীর আচরণকে পরিচালিত করে তাই-ই হচ্ছে সংস্কৃতি। অধ্যাপক পবিত্র সরকার যুক্তিসম্মত উপকরণের উদাহরণ হিসেবে খাদ্য, পোশাক ইত্যাদির উল্লেখ করেছেন, অযৌক্তিক উপাদান হলো ধর্ম বা সংস্কার-কুসংস্কার (যেহেতু এগুলো মূলত বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, যুক্তির ওপরে নয়), আর ভাষা হচ্ছে যুক্তিনিরপেক্ষ উপাদান।

যাহোক, সংস্কৃতি সম্বন্ধে এভাবে অনেক কথাই বলা যায়, বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আমাদের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যাবলীর প্রভাব নিয়েই রচিত হতে পারে আলাদা একটি প্রবন্ধ, যেমন হতে পারে খাদ্যাভাস, উৎপাদন পদ্ধতি, উৎসব-পার্বন, পোশাক-আশাক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি নিয়েও। কিন্তু এই রচনায় আমি বিশেষভাবে কথা বলতে চাই সংস্কৃতি ও ধর্ম নিয়ে। অর্থাৎ আমাদের সংস্কৃতির ওপর ধর্মের প্রভাব এবং প্রচলিত ধর্মসমূহের ওপর আমাদের সংস্কৃতির প্রভাব কী রূপে প্রত্যক্ষ করা যায়, তার একটু সুলুক-সন্ধান করে দেখতে চাই।

১৯৪০-দশকের গোড়ার দিকে (এপ্রিল, ১৯৪১) বিনয়কুমার সরকার ‘বেঙ্গলি কালচার অ্যাজ এ সিস্টেম অব মিউচ্যুয়াল আককুলটুরেশনস’ শিরোনামে যে প্রবন্ধটি লিখেছিলেন, সেটিতে তিনি এ বিষয়ে এক গভীর ও সুদুরপ্রসারী প্রসঙ্গের অবতারণা করেন যা  বাঙালির সংস্কৃতি সম্বন্ধে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়। ১৯৪২ সালে লেখাটির বাংলা অনুবাদ করেন ক্ষিতি মুখোপাধ্যায়। শুধু অনুবাদই নয়, রচনাটির অনুপঙ্খু বিশ্লেষণও হাজির করেন তিনি। এই লেখা ও এর বিশ্লেষণের মূল কথটি হলো সংস্কৃতির বিনিময়। আককুলটুরেশনস শব্দটির ব্যাখ্যা এরকম- 

‘কোনো সংস্কৃতি অন্য সংস্কৃতির ভিতর প্রবেশ করিতে থাকিলে দ্বিতীয় সংস্কৃতিটার অল্পবিস্তর অথবা বেশকিছু রদবদল ঘটিতে থাকে। এই দুই সংস্কৃতি হইতে সংস্কৃতির নতুন গড়ন বা ছাঁচ গড়িয়া ওঠে।...দুই সংস্কৃতির মেলামেশার প্রণালীকেই আককুলটুরেশনস বলা যায়।...আর মিউচ্যুয়াল আককুলটুরেশনস মানে পারস্পরিক সংস্কৃতি-বিনিময়, বা সংস্কৃতির লেনদেন।’ [সূত্র : বাঙলায় দেশী-বিদেশী (বঙ্গ-সংস্কৃতির লেন-দেন), বিনয় সরকার, ১৯৪২]

তাঁরা দেখালেন, আদি বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য সংস্কৃতির বিনিময়ের ফলে নতুন সংস্কৃতির ধরন কীভাবে পাল্টে গেল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দিকটির প্রতি তাঁরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, সেটি হলো বাংলায় বিভিন্ন ধর্মের প্রবেশ এবং এর প্রভাবে বাঙালি সংস্কৃতির রূপান্তর, একইভাবে বাঙালি সংস্কৃতির প্রভাবে বাইরে থেকে আসা ধর্মগুলোর রূপান্তর। তাঁদের মতে- শুধু ইসলামই নয়, হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মও বাংলা অঞ্চলে বিদেশী ধর্ম। এইসব ধর্মের আগমনের আগেও এ অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব কোনো ধর্ম ছিল- তাঁরা এর নাম দিয়েছেন বাঙালি ধর্ম। তাঁরা এ-ও বললেন-  ইসলাম আসার আগে এ অঞ্চলের সমস্ত মানুষ হিন্দু বা বৌদ্ধ ছিল- ঐতিহাসিক এই ধারণাটিই ভুল। বরং এক বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠি অ-হিন্দু বা অ-বৌদ্ধ রয়ে গিয়েছিল, বা কেউ-কেউ সেসব ধর্ম গ্রহণ করলেও তা এমনভাবে তাঁদের আদি সংস্কৃরি ছাঁচে ঢেলে পরিবর্তিত করে নিয়েছিল যে, তাদেরকে বড়জোর নিম-হিন্দু বা নিম-বৌদ্ধ বলা যায়। ইসলাম আগমনের ফলে এই অঞ্চলের বিরাট সংখ্যক অ-হিন্দু বা অ-বৌদ্ধ, সঙ্গে কিছু হিন্দু এবং কিছু বৌদ্ধও নতুন ধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিসর্জন দেয়া এ ক্ষেত্রেও ঘটেনি। ফলে প্রত্যেক ধর্মই বাঙালি ধর্মের দাপটে নিজেদের আদি রূপ খুইয়ে নতুন এক রূপ লাভ করে। এ বিষয়ে তাঁদের মতামত-

‘বাঙালী হিন্দুরা পরধর্মে দীক্ষাপ্রাপ্ত কনভার্ট মাত্র। ইংরেজ খৃষ্টিয়ানরা, মিশরের মুসলমানরা, ইরানের মুসলমানরা যেমন পরধর্মে দীক্ষিত, বাঙালীরাও অবিকল তাই।...হিন্দু সংস্কৃতি ও হিন্দুধর্ম সেকালের বাঙলার ‘অনার্য’ নর-নারীর পক্ষে বিদেশী জিনিস। কিন্তু বাঙালী জাত এই বিদেশী ধর্ম ও সংস্কৃতিকে নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতির বশে আনিয়াছিল। তথাকথিত আর্যধর্ম ও সংস্কৃতি অনার্য সংস্কৃতির প্রভাবে পড়িয়া অনার্যীকৃত হইয়াছে। ইহাকে বলিব অবাঙালী সংস্কৃতির বাঙালীকরণ। হিন্দুধর্ম বা বৌদ্ধধর্ম অনায়াসে বাঙালীদের জয় করিয়া লইতে পারে নাই। বাঙালী ধর্মের নিকটও ইহাদের মাথা নোয়াইতে হইয়াছে।...আর্যধর্ম যেমন বাঙলাদেশকে জয় করিয়াছে, বাঙালী ধর্ম-ও তেমনি ইহাকে নাজেহাল করিয়াছে। জয়টা এক তরফা হয় নাই- ধর্মান্তর বা মতান্তর গ্রহণটা হইয়াছে পারস্পরিক। বাঙলাদেশে খুব বেশী লোককে পরধর্ম (হিন্দুত্ব) স্বীকার করানো সম্ভব হয় নাই। অসংখ্য নরনারী অহিন্দু, অর্থাৎ বাঙালী বা অনার্য রহিয়া গিয়াছিল।...বাঙালীর সৃষ্টিশক্তি ইসলামকেও সহজে পথ ছাড়িয়া দেয় নাই। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের মতো ইসলামকেও বাঙালীদের নিকট পরাজয় স্বীকার করিতে হইয়াছে। এই সকল ক্ষেত্রে ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতিকেও বুঝিয়া রাখিতে হইবে।...বিদেশী সংস্কৃতিগুলোর উপর স্বদেশী সংস্কৃতির প্রভাব গভীরভাবে লক্ষ্য করিবার বিষয়।’  [সূত্র : বাঙলায় দেশী-বিদেশী (বঙ্গ-সংস্কৃতির লেন-দেন), বিনয় সরকার, ১৯৪২] 

এর ফল কী রকম সুদূরপ্রসারী হয়েছিল তার প্রমাণ হিসেবে বলছেন-

‘বাঙালী হিন্দু ও বাঙালী মুসলমানদের আচার-ব্যবহার ও চালচলনে মিল আছে। কারণ কি? সাধারণের ধারণা- হিন্দুদের কেহ কেহ মুসলমান হইয়া যাওয়ায় এইরূপ ঘটিয়াছে। কথাটার ভিতর কিছু সত্য আছে। কিন্তু আসল কারণ- হিন্দু ধর্মের মতো মুসলমান ধর্মেও অনার্য বাঙালী আদিম লোকদের আচার-ব্যবহার আর চালচলন ঢুকিয়া গিয়াছে। হিন্দু ও মুসলমান দুই ধর্মেই ‘বাঙ্‌লামি’র প্রলেপ পড়িয়াছে। হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের উপর খাঁটি স্বদেশী সংস্কৃতি দিগবিজয় চালাইতেছে। এই কথাটা মনে রাখিলে বাঙালী হিন্দু এবং মুসলমানদের রীতিনীতির ভিতর ঐক্য ও সাদৃশ্যগুলো সহজে বুঝিতে পারিব। দুই সংস্কৃতিই ‘বাঙালীকরণের’ প্রভাবে অনেকটা একরূপ দেখাইয়া থাকে।’ [সূত্র: বাঙলায় দেশী-বিদেশী (বঙ্গ-সংস্কৃতির লেন-দেন), বিনয় সরকার, ১৯৪২]

অর্থাৎ বিভিন্ন ধর্মের আগমনে আদি বাঙালি সংস্কৃতি তার রূপ পরিবর্তন করেছে বটে, কিন্তু এই সংস্কৃতি এতটাই শক্তিশালী এবং আধিপত্যবিস্তারী ছিল যে, প্রবল পরাক্রমশালী হিন্দুধর্ম বা ইসলামধর্মও তাদের নিজেদের ‘আদি’ রূপ ধরে রাখতে পারেনি, বরং আদি বাঙালি সংস্কৃতির প্রভাবে দুটো বিপরীত মেরুর ধর্ম কখনো-কখনো একইরূপ প্রদর্শন করতে বাধ্য হয়েছে, এখনও হচ্ছে। লেনদেন হয়েছে বটে, তবে বাঙালি সংস্কৃতি পরাজয় স্বীকার করেনি।

এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত আলোচনা আছে আবু জাফর শামসুদ্দীনের লোকায়ত সমাজ ও বাঙালী সংস্কৃতি গ্রন্থভূক্ত বাঙালীর সমন্বিত লোক সংস্কৃতি প্রবন্ধে। তিনি অবশ্য বিনয় সরকারের মতো আর্যপূর্ব বাঙলার ইতিহাস খুঁজে দেখেন নি, চর্যাপদের সময়কাল থেকে (অষ্টম-নবম খৃষ্টাব্দ) বর্তমানকাল পর্যন্ত ইতিহাসকে নির্ভর করে বাংলার লোকজীবনে প্রবহমান সংস্কৃতির সমন্বিত রূপটির ধরন-ধারণ ব্যাখ্যা করেছেন।

‘হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে এখনও বাংলাভাষাভাষী অঞ্চলের গান বাজনা তাল সুর লয় এবং নৃত্য ও বাদ্যযন্ত্র অভিন্ন। নির্দিষ্ট কয়েকটি ধর্মানুষ্ঠান এবং মৃতের সৎকার প্রভৃতি ব্যতিরেকে বাকী সকল প্রকার আনন্দোৎসব মেলা প্রভৃতিতে সকলে একত্রিত হয়। লাঠি খেলা, তরবারি ও রামদার খেলা, হাডুডু ও দাইড়া খেলা প্রভৃতি সকল ধর্মাবলম্বী মানুষের ক্রীড়া। বাসগৃহের নির্মাণ কৌশল ভিতরের আসবাব, নকশি কাথা, শয্যা, তৈজসপত্র, কৃষি যন্ত্রপাতি, অস্ত্র-শস্ত্র সবকিছু অভিন্ন। এ মাঠের জমিতে সকলে পাশাপাশি চাষ করে এবং একই ফসল ফলায়। উৎপাদন পদ্ধতিও অভিন্ন। ধর্মীয় বিধানে বিশেষভাবে নিষিদ্ধ কয়েকটি দ্রব্য ব্যতিরেকে ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল বাঙালীর খাদ্য তালিকা ও পাক প্রণালী অভিন্ন।...সকল বাঙালী পল্লীবাসীর পোশাক পরিচ্ছদ অলংকারপত্র প্রসাধন দ্রব্য প্রভৃতি আগেও অভিন্ন ছিল, কিঞ্চিৎ উন্নতির পর এখনও অভিন্ন আছে।’ [সূত্র : লোকায়ত সমাজ ও বাঙালী সংস্কৃতি আবু জাফর শামসুদ্দীন] 

আর্যরা এ দেশে আসার আগেই যে এখানকার জনগণের স্বাধীন সাংস্কৃতিক জীবন ছিল তার অনেক প্রমাণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন- বাংলার গ্রামগুলো ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ, বিভিন্ন পেশার লোকজন এক গ্রামে একসঙ্গে বাস করতো, রাজ-রাজড়াদের উত্থান-পতন তাদের এই স্বাধীন জীবনে খুব কমই প্রভাব ফেলতো। কিন্তু আর্যদের আগমন, পরবর্তীকালে বৌদ্ধ-হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের আগমন তাদের সাংস্কৃতিক জীবনে প্রভাব ফেলে। তবে এই প্রভাব যতো না রাজনৈতিক কারণে তারচেয়ে বেশি দার্শনিক কারণে পড়েছে। যখনই যে ধর্ম এখানে এসেছে, তখনই এখানকার জনগণ তাদের নিজেদের সুবিধামতো একে ‘সংশোধন’ করে গ্রহণ করেছে। তিনি মনে করেন ‘ফান্ডামেন্টাল’ বলে জগতে কোনো জিনিসই নেই, এমনকি ইসলাম নিজেও তার জন্ম থেকেই যে ‘ফান্ডামেন্টাল’ নয়, বরং এতে তার পূর্ববর্তীকালের অনেক ধর্ম ও সামাজিক আচার ব্যবহারের সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে। তিনি অনেকগুলো উদাহরণ দিয়ে সেটি প্রমাণও করেছেন। আর ভারতবর্ষে ইসলামের আগমন সম্বন্ধে তাঁর মত- 

‘ভারতে যে ইসলাম রাজকীয় ধর্মরূপে পাকাপাকিভাবে প্রবেশ করে সেটা হযরত মোহাম্মদ (দঃ) প্রবর্তিত আরবমরুর ‘নির্ভেজাল’ ইসলাম ছিল না। এ ইসলাম ইরান, মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশ পার হওয়ার কালে সে সব দেশের বহু লোকাচার সহ, প্রবর্তিত হওয়ার ৬০০ বছর পর, তুর্ক আফগান বিজয়ীদের সঙ্গে আসে।’  [সূত্র : লোকায়ত সমাজ ও বাঙালী সংস্কৃতি আবু জাফর শামসুদ্দীন]

বাংলাদেশে মুসলমান জনগোষ্ঠীই সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু যে-ইসলাম ধর্মের বিধিবিধান তারা মেনে চলেন, তার স্বরূপটি বুঝে নিতে হলে আমাদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে ইসলামের ইতিহাস নিয়ে কথা বলার। আমি যে ইতিহাসের কথা বলছি সেটি রাজা-বাদশাহদের ইতিহাস নয়- জনগণের ইতিহাস যা সবসময় অলিখিতই থেকে যায়। প্রথমেই যা বলা দরকার তা হলো- বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে ইসলাম গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে মূলত সুফি-সাধক ধর্মপ্রচারকদের কারণে, শাসক শ্রেণির জন্য নয়। শাসকদের ধর্ম দেখে যারা ধর্ম পরিবর্তন করে তারা আর যাই হোক সাধারণ জনগণ নয়, উচ্চশ্রেণির সুবিধাবাদী লোকজন। এ অঞ্চলে বিপুলসংখ্যক মানুষ যে ইসলাম গ্রহণ করেছিল তার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্তত তিনটি কারণকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় : ১. ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বর্ণভিত্তিক বিভেদনীতি, অত্যাচার-নিপীড়ন, চাপে ও তাপে সাধারণ জনগণ অতিষ্ঠ ছিল, ২. ঠিক সেই রকম একটি ক্রান্তিকালে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, ও শান্তির বাণী নিয়ে ইসলাম ধর্ম এদেশে প্রবেশ করেছিল, এবং ৩. এ বাণী যারা বহন করে নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা ছিলেন সুফি সাধক- অনাড়ম্বর জীবনযাপন, মানুষের মন বুঝে কাজ করা ও কথা বলার ক্ষমতা, জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান দার্শনিক হওয়া সত্ত্বেও নিরহংকারী সন্তের মতো সাধারণ মানুষদের দুঃখ-দুর্দশা-সংকট-সমস্যার সঙ্গী হতে পারার সহজাত প্রবণতা যাঁদেরকে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- সুফিরা যে-ইসলাম নিয়ে এসেছিলেন তা আরবে উদ্ভাবিত মূল ইসলাম নয়, বরং দার্শনিকভাবে অনেকখানি পরিবর্তিত ও আচারসর্বস্বতা-বর্জিত ইসলাম। সুফিবাদের জন্ম মূলত পারস্যে, মূল ইসলাম ওখানে গিয়ে অনেকখানি পরিবর্তিত হয়ে যায়; আবার এই সুফিরা যখন ভারতবর্ষে এলেন সেই সুফিবাদেরও খানিকটা পরিবর্তন সাধন করতে হলো। কোনো দর্শনই যে দেশকালের পরিপ্রেক্ষিতে তার অবিকৃত রূপ ধরে রাখতে পারে না- এই প্রগতিশীল ধারণাটি সুফিদের মধ্যে ছিল; তাই তাঁরা ভারতবর্ষে এসে এই জনগোষ্ঠীর মন বুঝতে চেষ্টা করলেন। এবং আবিষ্কার করলেন- এই জনগোষ্ঠীর কাছে ইসলামকে গ্রহণযোগ্য করতে হলে প্রেমের কথা বলতে হবে, ভক্তির কথা বলতে হবে। কারণ, এ অঞ্চলে দুটোরই জয়জয়াকার। অতএব সুফিরা মানুষের কাছে বলতে লাগলেন প্রেমের কথা, বোঝাতে লাগলেন স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক দ্বন্দ্বের নয়, প্রেমের। একমাত্র প্রেমের মাধ্যমেই পাওয়া যাবে স্রষ্টাকে- অন্য কোনোভাবে নয়। প্রেম ও ভক্তির এই কথাগুলো এ অঞ্চলের মানুষের কাছে আগে থেকেই পরিচিত ছিল, তার সঙ্গে যুক্ত হলো মানুষে-মানুষে সমতার কথা, ভ্রাতৃত্বের কথা, সমান অধিকারের কথা, শান্তি ও সম্প্রীতির কথা। তরবারী দিয়ে নয়, কঠোর ধর্মীয় আচারসর্বস্বতা দিয়ে নয়, ভয়-ভীতি-হুংকার দিয়েও নয়, স্রেফ শান্তি-সম্প্রীতি-মানবতা-সাম্য-প্রেম-ভক্তি-ভ্রাতৃত্ব ইত্যাদির কথা বলে সুফিরা জয় করে ফেললেন একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে। এমনকি রাজশক্তি-সামাজিক শক্তি বা অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে কোনোরকম দ্বন্দ্বে লিপ্ত না হয়েই তাঁরা সেটি করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁদের দার্শনিক প্রজ্ঞার কারণে। এ অঞ্চলে ইসলামের জয়ের ইতিহাস বলতে বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের কাহিনী বোঝায় না, বোঝায় সুফিদের এই দার্শনিক বিজয়ের ইতিহাস। আর এই ইতিহাস না জানলে বাঙালি মুসলমানের মনোজগৎ বোঝা সম্ভব নয়। এই রচনায় বিষয়টি নিয়ে বিস্ততৃত আলোচনার অবকাশ নেই, মোদ্দা কথা হলো- এ দেশের মানুষের মনোজগতে আছে শান্তি-সম্প্রীতি-ভ্রাতৃত্ব-মানবতা ও সাম্যের প্রতি প্রেম। কোনো মৌলবাদী কঠোর কঠিন তত্ত্ব দিয়ে তাদেরকে জয় করা যায় নি, ভবিষ্যতেও যাবে না। আবু জাফর শামসুদ্দীনের ভাষায়-

‘ফান্ডামেন্টাল বলে কোনো বস্তু মানবজাতির সামাজিক জীবনে কোন কালে ছিল না, সুতরাং তার পুনঃপ্রবর্তন প্রচেষ্টাও সাফল্যমন্ডিত হওয়ার নয়।’  [সূত্র: লোকায়ত সমাজ ও বাঙালী সংস্কৃতি আবু জাফর শামসুদ্দীন]

কিন্তু চেষ্টাটি বহুকাল থেকেই চলছে, পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত একদল ধর্মান্ধ লোক ও কয়েকটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল এ দেশকে একটি ধর্ম-রাষ্ট্রে পরিণত করার দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দলগুলোও তাদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয়-সমর্থন দিয়ে চলেছে। এমনকি প্রগতিশীলতার মুখোশ পরে কিছু ছদ্মবেশী বুদ্ধিজীবীও তাদের এই প্রচেষ্টার সঙ্গে সামিল হয়েছেন। তাদের এই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলেই ধরে নেয়া যায়। কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতির যে হাজার বছরের ইতিহাস তাতে নিশ্চিত করেই বলা যায়, একে পরাজিত করা যাবে না। বাঙালি তাদের সংস্কৃতিকে চিরকাল অপরাজেয় রূপে দেখতে চেয়েছে, আর চেয়েছে বলেই পরাজিত হতে দেয় নি। এই এতকাল পর এসে তাদেরকে পরাজিত করা যাবে, এটা কোনো মূর্খ ছাড়া আর কে-ই বা ভাববে!          

আরও পড়ুন : *বৈশাখ নিজেই যখন পঙ্‌ক্তিমালা *কারাগারে বঙ্গবন্ধুর ‘নববর্ষ’ উদ্‌যাপন *বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় নববর্ষ উদ্‌যাপনের ঐতিহ্য *চৈত্র সংক্রান্তি: সামাজিক আচার ও ক্রিয়া