বৈশাখ সংখ্যা

বাঙালির খাসলত

পৃথিবীর সব জাতিই নিজেদের মহান ভাবে, বাঙালিরাও তাই ভাবে- যদিও অন্যদের থেকে একটু বেশি। তাতে দোষের কিছু নেই। দোষ-গুণ মিলিয়েই বাঙালি, যদিও দোষের ভাগটা একটু বেশি চোখে পড়ে। তাতেও দোষের কিছু নেই। কারণ এটি প্রমাণ করে, বাঙালি চক্ষুষ্মান জাতি। চক্ষুষ্মান জাতি বলেই বাঙালি প্রায়ই চোখ ওল্টায়, মাঝেমধ্যে সামান্য কারণেই তার চোখ কপালে ওঠে, অথবা তার চোখ টেরায়। এই চোখ-টেরানোটা অন্যদের উন্নতি দেখলে, অবশ্যই। নিজের উন্নতি ছাড়া অন্য কারও উন্নতি বাঙালির পছন্দ নয়, যদি না সে-উন্নতি বিমূর্ত কোনো বস্তু হয়। যেমন বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নতি, অথবা নিজের সুবিধা বাড়াবে সে রকম কোনো উন্নতি। যথা রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা অথবা বিদ্যুৎ সরবরাহে উন্নতি।

বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রসঙ্গে আমার এক প্রতিবেশীর কথা মনে পড়ল। এক রাতে আমাদের পাড়ায় লোডশেডিং চলার সময় পাশের পাড়ার দালানগুলোতে আলো দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘ইচ্ছে করছে ওই পাড়ার ট্রান্সফরমারটি ভেঙে দিয়ে আসি।’ আমি এক পা এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘অথবা ওই দালানগুলোকেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে আসি।’ না, আমাদের একজনও ইচ্ছাপূরণে ব্রতী হইনি। বাঙালি মুখে যতটা বিধ্বংসী, অন্তরে ততটা নয়, এতেই রক্ষা।

বাঙালির খাসলত নিয়ে চিন্তিত ছিলেন মহর্ষি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার কাছে বাঙালি এবং মানুষ সমার্থক শব্দ ছিল না। এ জন্য তিনি বাংলা-জননীকে দুষেছেন। রবীন্দ্রনাথের বাংলা জননীর মতো আমাদের অনেক বঙ্গীয় জননী সন্তানদের আশকারা দিয়ে দিয়ে তাদের মনুষ্যপদবাচ্য হওয়ার পথটি বন্ধ করে দেন। সন্তানকে ‘অমানুষ’ করার পথে অনেক বঙ্গীয় জননী ভালো-মন্দ বিবেচনাটা হারিয়ে ফেলেন। তবে তাদের সংখ্যা নগণ্য। বড় সংখ্যার জননীরা বরং সন্তানদের আশকারা দেন কোনো কিছু না ভেবেই। অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করেই। এই অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করার প্রবণতাটা বাঙালি হয়তো তার জননী থেকে উপহার হিসেবে পায় এবং অল্প বয়স থেকেই এটি তার খাসলতের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্য অবশ্য জননীদের দুষে লাভ নেই- বঙ্গীয় জননী সন্তানপ্রেমে অন্ধ। আমরা জানি, পৃথিবীর সব জননীই অল্পবিস্তর এই অন্ধত্বের শিকার, বঙ্গীয় জননীর ক্ষেত্রে অন্ধত্বটা একটু বেশি, এই যা। অবশ্য সৎসন্তানের কথা এলে অন্ধত্বটা দ্রুতই ঘুচে যায়। তখন ভিন্ন বিবেচনা কাজ করে, সে বিবেচনায় নাই বা আমরা গেলাম।

রবীন্দ্রনাথের মতো আরেক চিন্তক বাঙালির খাসলত নিয়ে চিন্তিত ছিলে। তিনি নীরদচন্দ্র চৌধুরী। চৌধুরী মহাশয়ের চোখে বাঙালি আত্মঘাতী। ‘আত্মঘাতী বাঙ্গালী’ নামে তার বইটি বের হওয়ার পর তার অভিমতের পক্ষে-বিপক্ষে বহু তর্ক হয়েছে। আমার নিজেরও সংশয় ছিল বাঙালি আত্মঘাতী কি না এ বিষয়ে। কিন্তু ডজন ডজন বিলিয়নপতি বাঙালির বাড়ি, পুকুর আর কারখানা থেকে ত্রাণের টিন উদ্ধারের পর এই সংশয়ের নিরসন হয়েছে। কাবিখার টিন চুরি করে এসব বাঙালি যে এখন জেভাখার (জেলের ভাত খাওয়া) জন্য লাইন দিচ্ছে, তাতে আত্মঘাতিতার সব নিদর্শন ফুটে উঠেছে। চৌধুরী মহাশয় নিশ্চয় পরকালে এই ভেবে শান্তি পাচ্ছেন, তাকে আর কেউ উন্নাসিক বলে গালি দেবে না।

উন্নাসিক কথাটা এখানে এমনি বলা হয়নি, বাঙালি চরিত্রের অন্যতম একটি উপাদান এই উন্নাসিকতা। এমনিতে বাঙালির নাক বোঁচা, কিন্তু সামান্য অধস্তনের সামনে, বিশেষ করে সে যদি ক্ষমতা এবং বিত্ত-সম্পর্কে অধস্তন হয়, বাঙালির নাকটা উঁচু হয়ে যায়। অ-খাঁটি বাংলায় একে নাক ফোলানোও বলা হয়। বাঙালি একসময় নাকটা উঁচু করলেও অন্য সময় সেই প্রিয় নাকটা কেটেও ফেলতে পারে। এই কেটে ফেলাটা পরের যাত্রাভঙ্গের জন্য। বাঙালির খাসলতে এই ভয়ানক উপাদানটি প্রকৃতই আত্ম (নাক) ঘাতী। পৃথিবীর আর কোনো ভাষায় ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গের’ সমতুল্য কোনো প্রবাদ-প্রবচন আমি খুঁজে পাইনি।

এই যে ‘কোনো ভাষায় পাইনি’ বলে দিব্যি এক বিরাট সামান্যীকরণ করে ফেললাম, এটিও বাঙালির খাসলতের একটা দিক- এই অতিকথন, অতিশয়োক্তি, অতিরঞ্জন। বাঙালির প্রিয় একটি আবেগের উচ্চারণ হচ্ছে ‘পৃথিবীর আর কোথাও...’; পৃথিবীর আর কোথাও এমন সবুজ নেই; পৃথিবীর আর কোথাও এমন শান্তি নেই ইত্যাদি। বটে। কথাটা বলছে কে? না, বলছেন কেশবপুরের দক্ষিণ গ্রামের আবদুল বাসেত, যিনি জীবনে যশোর জেলা সদরই দেখেননি। ঢাকা তথা বিশ্ব দেখা তো দূরের কথা! কিন্তু আবেগ বলে কথা।

২. আবেগের প্রসঙ্গে এসে একটুখানি বিরতি নিয়েছি; একটুখানি বিজ্ঞাপন বিরতি। যেহেতু আবেগের ফাঁদে পড়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল রীতিমতো। কিন্তু বাঙালির খাসলত নিয়ে লিখতে বসে আবেগাক্রান্ত হওয়া চলবে না। এজন্য একটুখানি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়াটা জরুরি। বৈজ্ঞানিক মানে নিরাবেগ, বিশ্লেষী। বিশ্লেষণের সুবিধার জন্য অতঃপর বাঙালির খাসলতের পুরোটা না বিবেচনা করে এর স্বীকৃত উপাদানগুলোর কয়েকটি নিয়ে আলোচনা চলতে পারে। একটি হাতির মাথা, কান, পা, শুঁড় ছুঁয়ে দেখে যদি অন্ধ বাঙালি হস্তীদর্শন করতে পারে, তা হলে খাস্তদর্শনে খাসলতসমগ্রের একটা প্রতিরূপ তো অন্তত পাওয়া যাবে। অনেক ভেবেচিন্তে বাঙালির খাসলত-উপাদানগুলোর একটি তালিকা তৈরি করেছি। তালিকা তৈরিতে ভাবনা-চিন্তা প্রচুর লাগলেও কষ্ট তেমন হয়নি: একটুখানি আত্মদর্শন, কিছুটা পরদর্শন- এই যা তকলিফ। আপনি এই তকলিফটুকু করলে হয়তো উপাদানের সংখ্যা কমবে। সে-রকম হলে বাড়তি উপাদানগুলো নিজগুণে ছেঁটে ফেলবেন। ধন্যবাদ।

আবেগ : আবেগেই মুক্তি, এ রকম একটি যুক্তিতে বাঙালির গভীর বিশ্বাস। অতি আবেগের কারণে বাঙালি গলা ছেড়ে কথা বলে। বাঙালির মতো উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতে আমি আর কাউকে শুনিনি। এমনকি এক রিকশার আরোহী দুই প্রেমিক-প্রেমিকার কথোপকথনও পনের গজ দূরে থেকে আপনি শুনতে পাবেন। আর আবেগের কথা কী আর বলব। বাংলাদেশের ক্রিকেট দল জিম্বাবুয়েকে হারালেও সারা দেশ আবেগে উথলে ওঠে। এ ব্যাপারে মিডিয়ায় আবেগ-প্রবাহটি হয় লক্ষণীয়। ‘বাঘের গর্জনে কাঁপছে বিশ্ব’-এ রকম হুঙ্কার পত্রিকার জ্বলজ্বলে শিরোনাম হয়ে যায়। তবে আবেগের গার্হস্থ্য পরিচয়টিও কম বড় নয়। এক অলস দুপুরে কোনো গৃহিণী ‘দেবদাস’ পড়ে হাঁপুস নয়নে কাঁদেন। এটি বিশুদ্ধ আবেগ। তারপর তার ‘দেবদাস’ পড়ার সুযোগ নিয়ে কাজের মেয়েটি কেন ঘুমাল, সে-অপরাধে খুন্তি গরম করে তার পিঠে ছ্যাঁকা দেন। এটি কোন আবেগ আমি জানি না। কিন্তু এ আবেগ বহুল চর্চিত। এ জন্য আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের বলি, সংসার শুরু করার সময় যেন তারা খুন্তি ব্যবহার না করার শপথ নেয়। ব্যবহার যদি করতেই হয়, তো কাঠের খুন্তি।

হুজুগ : বাঙালির পরিচয় তার হুজুগে। হুজুগ মানে একটা ঢেউ এলে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে তাতে লাফিয়ে পড়া। একেক সময় একেক হুজুগ আসে এবং তাবৎ দেশবাসী তাতে শামিল হয়ে পড়ে। এই পয়লা বৈশাখে কত মানুষই না পান্তা ভাত খাবেন। না, তাদের হঠাৎ ক্ষুধার উদ্রেক হওয়ার জন্য যে খাবেন, তা নয়। অন্যরা যখন খাচ্ছেন, তাঁদের তো খেতেই হবে। পান্তা খেতে ভালো না লাগলেও। অথবা লোকজন কেওক্রাডাং পাহাড়-শীর্ষে অভিযানে যাবেন। দলে দলে। পাহাড়ের টানে নয়, হুজুগের টানে।

আড্ডা : আড্ডা পেলে সবচেয়ে নির্জন বাঙালিও মশগুল হয়ে পড়েন। এই ‘নির্জন বাঙালি’ কথাটি পরস্পরবিরোধী, ইংরেজিতে যাকে বলে অক্সিমরনিক, যেমন গরম বরফ। আড্ডার জন্য নির্দিষ্ট কোনো জায়গার প্রয়োজন নেই, সময়েরও বাধ্যবাধকতা নেই। তবে কাজের সময়ে, সম্ভব হলে কার্যক্ষেত্রে আড্ডা দেওয়াটা বাঙালির সু-খাসলত। প্রমাণ চাইলে কাল সচিবালয়ে চলে যান, অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-লাউঞ্জগুলো ঘুরে যান। বাঙালি পুরুষ আড্ডায় বসলে চা-সিগারেটপিয়াসী হয়ে যান। সেই চায়ের জোগান নানাভাবে আসে, প্রায়ই অন্তপুর থেকে এবং চা দিতে দেরি হলে আড্ডার মেজাজে থাকা স্বামীপ্রবরেরা তদীয় স্ত্রীকে ভর্ৎসনা করেন। এতে দাম্পত্য কলহ সৃষ্টি হয়। কিন্তু আড্ডা চলে, কারণ এর বিকল্প নেই। আমি দেখেছি ক্লাস ফেলে ছাত্রছাত্রীরা আড্ডা দেয়, অনেকে তাস খেলে। সতাস আড্ডা অবশ্য ভিন্ন জিনিস। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাণিজ্যও বটে।

আড্ডায় বাঙালি রাজা-উজির মারে। এই ‘কিলিং কিংস অ্যান্ড মিনিস্টারস’ বাঙালি খাসলতের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বাস্তবে বাঙালি দু-এক কিং এবং মিনিস্টারকে বধ করলেও মুখে বধ করেছে এবং করছে-এর হাজার হাজার গুণ। রাজা-উজির মারার অন্য নাম গুল-গাপ্পা। বাঙালির নিধনের তালিখায় গুল-গাপ্পা আছে বড় জায়গাজুড়ে। ‘আমার দাদা ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম গ্রাজুয়েট’-এ রকম গুল এখন একটি ১৪ বছরের ছেলেও মারে, যা তার ক্লাস এইট পাস পিতামহও একসময় মারতেন। ‘আমার এই আছে, সেই আছে’-এসব কথা এমন লোকও বলে, যে ঘুমায় ছেঁড়া কাঁথার নিচে।

রাজা-উজির মারার সঙ্গে যুক্ত আরেক বাঙালি খাসলত-উপাদান। সংক্ষেপে একে পিএনপিসি বলা যায়। বছর ত্রিশ আগে এক মার্কিন মহিলা কবি কিছুদিনের জন্য বাংলাদেশে আসেন। যাওয়ার আগে তিনি বাঙালিসুলভ আবেগের বশে কান্নাকাটি করে জানিয়েছিলেন, যে জিনিসটির তিনি সবচেয়ে অভাব বোধ করবেন এবং যা তিনি আনন্দিত-রপ্ত করেছেন, তা হলো পিএনপিসি, অর্থাৎ পরনিন্দা পরিচর্চা। আমি তাকে বলেছিলাম, এ চর্চা আমেরিকাতেও আছে। তিনি স্বীকার করে নিয়ে বলেছিলেন, এ দেশে এটি একটি শিল্প এবং অসহিংস।

গান্ধীজির প্রভাবে কি না কে জানে, এই অহিংসতার উপস্থিতি পিএনপিসি-কে একটি আকর্ষণীয় বাধ্যবাধকতায় পরিণত করেছে। এক বাঙালি আরেক বাঙালিকে প্রতিদিন ব্যাকুল আগ্রহ এবং উৎসাহ নিয়ে বলে ‘অমুক না...হুঁ’  অথবা ‘অমুক ভাবি না... হুঁ’। এবং অতিদ্রুত অমুকের অথবা অমুক ভাবির চরিত্র অসহিংসভাবে বধ হতে থাকে। তবে উদ্বেগের কারণ নেই। কেননা, হয়তো একই সময়ে, অমুক অথবা অমুক ভাবি বলছেন, ‘তমুক না... হুঁ’।  প্রকৃতির ভারসাম্য!

মেল বন্ডিং : আমার সেই মার্কিন কবি মহিলার কাছে আবার ফিরে যাই। তিনি ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরেফিরে সলাজ মুখে একদিন আমাকে বললেন, ‘তোমাদের এখানে গে কালচারটা তো বেশ কড়া।’ আমি বুঝতে না পেরে তার দিকে শূন্য দৃষ্টি মেলে দিলে তিনি জানালার বাইরে রাস্তার দিকে আমার সেই দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। রাস্তায় জোড়ায় জোড়ায় ছেলেরা জড়াজড়ি করে যাচ্ছে। তাদের হাত একে অন্যের হাতে, নয়তো পরস্পরের ঘাড়ের ওপর দিয়ে পেঁচানো। ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু সন্দেহ নেই। কিন্তু অতি অবশ্যই এতে গে সংস্কৃতির কিছু নেই। আমি কবিকে বললাম, ‘এই গে সেই গে নয়, এটি আদি ইংরেজি মধু... অর্থাৎ হাসিখুশি। এই জড়াজড়িটা শুধুই বাংলাদেশি মেল বন্ডিং। পুরুষতান্ত্রিক বাঙালি সমাজে এক পুরুষ আরেক পুরুষকে নিজের স্ত্রীর থেকেও স্বস্তিদায়ক সঙ্গী ভাবে।

প্রেম-প্রীতি : বাঙালির জীবনে প্রেম-প্রীতির প্রকাশটা খুবই আত্মকেন্দ্রিক। বাঙালি প্রথমত আত্মপ্রেমী, তারপরও জননী ও পরিবারপ্রেমী। প্রতিবেশীকে ভালোবাসার জন্য মহাপুরুষেরা অনেক বাণী দিলেও বাঙালি শুধু ভালোবাসে প্রতিবেশীর কন্যাটিকে। প্রতিবেশীর তালগাছটাও বাঙালি ভালোবাসে। সে জন্য তালগাছ নিয়ে বিরোধ থাকলেও এবং সালিস মানলেও বাঙালি তালগাছটির দখল নিতে ব্যগ্র হয়। তালগাছের প্রেমে পড়েই এই অবস্থা।

বাঙালি আরো ভালোবাসে অ-নিজ সম্পদ, মাঝেমধ্যে পরস্ত্রী। বাঙালি প্রেম-প্রীতি প্রকাশে সবচেয়ে কৃপণ কাজের মানুষের প্রতি। বিশেষ করে তারা কন্যাশিশু হলে। কন্যাশিশুরা একটু বড় হলে অবশ্য অনেক গৃহকর্তা তাদের ভালোবাসেন। তবে সে ভিন্ন কথা। জননীকে ভালোবাসা বাঙালি খাসলতের মহৎ দিক। কিন্তু সে শুধু নিজের জননীকে। অন্যের জননী, এমনকি বঙ্গজননীও এই ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত।

ঈর্ষা : ঈর্ষা একটি সার্বজনীন আবেগ, যাকে মহামতী নিৎসে বলেছেন, ‘রেসত্মো’। এতে প্রমাণিত ইউরো-চরিত্র ঈর্ষাপরায়ণ, তবে বাঙালি খাসলতে এর প্রকোপ প্রবল। কথা আছে যে পাঁচ পাপী বাঙালি নরকে নিক্ষিপ্ত হলে তাদের পাহারা দেওয়ার জন্য কোনো ফেরেশতার প্রয়োজন হবে না। তাদের কেউ পালাতে গেলে অন্য চারজন তাকে টেনে ধরে রাখবে।

নদী ও নৌকা : বাঙালির সামষ্টিক অবচেতনে নদীর অবিরাম উপস্থিতি। নদী ছিল একসময় বাঙালির হাইওয়ে, নৌকা তার বাহন। এখনো অবচেতনে বাঙালি নৌকা বায়। রিকশা চালাতে গিয়ে রিকশা বায়, বাস চালাতে গিয়ে বাস বায়। বাংলাদেশের রাস্তায় কোনো বাহন সোজা চলে না। সব সময় এঁকেবেঁকে চলে, মধ্যিখান দিয়ে। বাঙালি হাঁটেও এঁকেবেঁকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের লম্বা করিডরগুলোতে ছেলেমেয়েরা মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে, যেন নৌকা চালাচ্ছে।

আহ্লাদ : কথায় আছে, আহ্লাদে আটখানা হওয়া। আহ্লাদে অষ্টখ- হয়ে যাওয়াটা বাঙালি খাসলতের একটি পরিচয়। সামান্যতেই আহ্লাদিত হয় বাঙালি, যার জন্য সে ঠকে। কিন্তু ঠকলেও স্বীকার করে না, তাতে আহ্লাদে টান পড়বে।

হাঙ্গামা : পানির সংকটকালে যেকোনো শহরের কলতলায় যে দৃশ্যের অবতারণা হয়, তার নাম হাঙ্গামা। হাঙ্গামা বাঙালি খাসলতের উত্তেজক একটি উপাদান। এর প্রকাশ নানা ধরনের ভাঙচুরে। ভাঙচুর বাঙালির প্রিয় একটি খেলা। ক্রিকেট-ফুটবলের চেয়েও। বাঙালি হাঙ্গামা করে পরের গাড়ি অথবা কাচ লাগানো যেকোনো স্থাপনার ওপর, অন্যের ওপর এবং অরণ্যের ওপর। গাছপালা নিধনে বাঙালি বিশ্বজয়ী। কোনো গাছকে তার ডালপালা নির্মমভাবে কেটে-ছেঁটে ফেলার আগে বাঙালির শান্তিÍ নেই। ঢাকা শহরে যদি একটি গাছ আপনি দেখাতে পারেন, যেখানে বাঙালি-পরশুরামের কুঠার পড়েনি, আপনাকে আমি এক শ টাকা দেব। তবে, সবচেয়ে নির্দয় হাঙ্গামা হয় অরক্ষিত মেয়েদের ওপর। তাদের ওপর হাঙ্গামার সময় কোনো কোনো বীরপুঙ্গব বাঙালি অ্যাসিড নামক পদার্থ ব্যবহার করে। অ্যাসিড কিছু বাঙালির শৌর্যবীর্যের প্রতীক।

জমিদার : বাঙালি মাত্রই নিজেকে জমিদার ভাবে। এবং এভাবে জমিদারে পরিণত হয়ে সে জমিদারের কায়দা-কানুন, দুর্ব্যবহার ও ঔদ্ধত্য রপ্ত করে ফেলে। দুপুর দুইটায় ঢাকা শহরের উত্তপ্ত কোনো রাজপথের পাশে দাঁড়ানো কোনো সিএনজি স্কুটারের চালককে জিজ্ঞেস করুন- ভাই, যাবেন? আপনি কোনো উত্তর পাবেন না। কেননা, প্রশ্নটা করা হয়েছে একজন জমিদারকে। বলাবাহুল্য, আপনি যদি সশস্ত্র ক্যাডার হন, আপনিই তখন জমিদার। চালক তখন বলবে- স্যার, আপনার জন্যই বসে ছিলাম।

কাকের মাংস : কাক তার স্বজাতির মাংস খায় না, কিন্তু বাঙালি কাকের সমকক্ষ হতে পারেনি। বাঙালি একে অপরের মাংস ভক্ষণ করে, এ ক্ষেত্রে ভক্ষিতেরা হয় দুর্বল এবং দরিদ্র। পিটিয়ে মানুষ মারাকে অনেক বাঙালি একটি নিষিদ্ধ আনন্দ হিসেবে দেখে। নিষিদ্ধ বলেই এর চর্চা যথেষ্ট হয়। এটি মাদক গ্রহণ থেকেও সুখকর।

প্রবাদ-বাগধারা ইত্যাদি : বাংলা প্রবাদ-প্রবচন, বাগধারা ইত্যাদি থেকে তার খাসলতের ভালো পরিচয় জোটে। স্থানাভাবে একটিমাত্র উদাহরণ দেওয়া হলো : নেপোয় মারে দই। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন : আমরা সবাই নেপো, আমাদেরই দইয়ের রাজত্বে।

আরও পড়ুন : *বাঙালির সংস্কৃতি: অপরাজেয় লেনদেন *বৈশাখ নিজেই যখন পঙ্‌ক্তিমালা *কারাগারে বঙ্গবন্ধুর ‘নববর্ষ’ উদ্‌যাপন *বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় নববর্ষ উদ্‌যাপনের ঐতিহ্য *চৈত্র সংক্রান্তি: সামাজিক আচার ও ক্রিয়া